Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সরেজমিন : অস্তিত্ব হারাচ্ছে কেওলার হাওর

নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:০৯, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

সরেজমিন : অস্তিত্ব হারাচ্ছে কেওলার হাওর

ছবি : বহুমাত্রিক.কম

মৌলভীবাজার : হাওর-বিল, চা বাগান ও বনাঞ্চল খ্যাত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার একখন্ড জলাশয় কেওলার হাওর। নানা অত্যাচার আর অপরিকল্পিত কর্মকান্ডে মৌসুম ভিত্তিক এই হাওরটি অস্থিত্ব হারাতে বসেছে। মৎস্য প্রজনন, কৃষি উৎপাদন সহ এলাকার লোকজনের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বনকৃত হাওরটির মাঝ দিয়ে সম্প্রতি এসকেবেটর লাগিয়ে অবৈধভাবে নতুন রাস্তা নির্মিত হচ্ছে।

পাশাপাশি খাল খননের মাটিতে তৈরি হচ্ছে বাঁধ। হাওরের জলাশয়ে ভূমিহীনদের দেয়া হয়েছে জমি বন্দোবস্ত। স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে হাওরের খাস জমি দখলে নিয়ে চাষাবাদ করছেন। স্থানে স্থানে মাছের জন্য গর্ত ছাড়াও ব্যক্তিগত এবং যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন মৎস্য খামার গড়ে উঠারও নানামুখী কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ক্ষুদ্র এই হাওরের মাছ দিয়ে প্রবাহিত লাঘাটা নদীতে ক্রসবাধ, মেশিন চালিয়ে পলিবালি উত্তোলন, হাওরের গাঁ ঘেষে গাছ বাগান, বাড়িঘর স্থাপনসহ নানা অপতৎপরতা চলছে। ফলে পূর্বের তোলনায় হাওর ভরাট ও পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও সপ্তাহব্যাপী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। কৃষি উৎপাদন, মৎস্য প্রজনন, জলজ উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জলাভূমি সম্পদ দেশের পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বহুবর্ষীয় ও মৌসুমী জলাভূমি উভয় বিপুল সংখ্যক প্রাণি ও উদ্ভিদের আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে। এই হাওরটির মৎস্য ও কৃষি সম্পদের উপর টিকে আছে স্থানীয় জনসংখ্যার একটি বড় অংশ। স্থানীয় জেলে ও ভূমিহীন কৃষকরা ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্টি। হাওর ও মৌসুম ভিত্তিক জলাভূমির অসংখ্য উদ্ভিদ, ঔষধ, খাদ্য, পশুখাদ্য ও নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করা হয়। মানুষের আগ্রাসন ও সেচ স্কিমের বাঁধ তৈরির ফলে হাওরের আবাসস্থল প্রতিনিয়ত হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

প্রায় ১২০ হেক্টর আয়তনের এই হাওরটি এক সময়ে জলাশয় হিসাবেই পরিচিত ছিল। নিন্মাঞ্চল হিসাবে কৃষকরা এখানকার ভূমিতে বোরো চাষাবাদের উপর নির্ভরশীল। কয়েক বছর আগেও হাওরটির পূর্ণরূপ থাকলেও সময়ের পরিক্রমায় এটি ভরাট হয়ে পড়ছে। বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পলিবালি জমে ও মানবসৃষ্ট নানা অপতৎপরতার কারনে মৌসুম ভিত্তিক হাওরটি ক্রমাম্বয়ে ভরাট হচ্ছে।

উপজেলার পতনঊষার ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নে অবস্থিত কেওলার হাওর মৎস্য প্রজনন ও কৃষি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিল, জলাশয়ে খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়ার বিধান না থাকলেও এই হাওরের বেশ কিছু খাসজমি ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়েছে। ফলে কৃষির উপর নির্ভর করে স্থানীয় ভুমিহীন, কৃষি ও মৎস্যজীবিরা যুগ যুগ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।

সম্প্রতি সময়ে রূপষপুর এলাকা থেকে ধূপাটিলা গ্রাম পর্যন্ত অবৈধ আর অপরিকল্পিতভাবে হাওরের মাঝদিয়ে এসকেবেটর যোগে প্রায় চার ফুট উচ্চতা সম্পন্ন নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছে। এই রাস্তা নির্মাণের ফলে বর্ষায় উজানের পানির সাথে পলি বালি জমে দ্রুত ভরাট ও দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অথচ বাংলাদেশ গেজেট ২০১০ এর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর সংশোধিত ৪ এর ৬ (ঙ) জলাধার সম্পর্কিত বাধা নিষেধ এ বলা হয়েছে-আপাতত: বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, জলাধার হিসাবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা যাইবে না।

এছাড়া বোরো আবাদের জন্য হাওরের মাঝদিয়ে প্রবাহিত লাঘাটা নদীতে ক্রস বাঁধ, নদী থেকে মেশিন যোগে পলিবালি উত্তোলন, নদী সেচ দিয়ে মাছ শিকার, স্থানে স্থানে মাছের গর্ত, বাড়িঘর, গাছ বাগান ছাড়াও বর্ষা মৌসুমে হাওর জুড়ে কারেন্ট জালের ছড়াছড়ি, নদীতে বাঁশের খাটি সহ অবৈধ এসব নানা অপতৎপরতার কারনে ভরাট হওয়া হাওর দিয়ে পানি নিস্কাশন হচ্ছে না। ফলে বোরো মৌসুমে প্রায় ৩০০ হেক্টরের ফসল বিনষ্ট হয়।

লাঘাটাছড়া পাবসস লিমিটেড এর সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান, কমলগঞ্জ হাওর ও নদী রক্ষা আঞ্চলিক কমিটির সদস্য সচিব তোয়াবুর রহমান, সদস্য ফটিকুল ইসলাম বলেন, যেখানে হাওর ভরাট, পানি নিস্কাশনে প্রতিবন্ধকতা ও নিয়মিত জলাবদ্ধতায় রূপ নেয় সেখানে আরও একটি নতুন রাস্তা নির্মাণের কারনে বর্ষাকালে পানির ¯্রােতের সঙ্গে আসা পলিবালি আটকা পড়ে হাওরের অবশিষ্ট অংশ আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ভরাট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া উন্মুক্ত হাওরে পানি নিস্কাশনে প্রতিবন্ধকতার কারনে ভবিষ্যতে বন্যা ও জলাবদ্ধতায় এতদ এলাকার কৃষক সাধারণকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। তারা আরও বলেন, এ ব্যাপারে লিখিত গণ দরখাস্ত উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করা হবে।

কমলগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ শাহদাত হোসেন বলেন, হাওর-বিল এমনিভাবেই ভরাট হয়ে গেছে। কেওলার হাওরে রাস্তা, বাঁধ নির্মিত হওয়ায় পলি আরো আটকে হাওর বিলীন হয়ে যাবে। মাছের অস্থিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। তাছাড়া জলাশয়ের খাসজমি অবৈধভাবে বন্দোবস্ত দেয়া যায় না, এখানে খাসজমিও বন্দোবস্তু দেয়া হয়েছে। এগুলো উদ্ধার করে বিল-হাওর বাঁচানোর জন্য পুন:খনন প্রয়োজন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এর সিলেট বিভাগীয় সমম্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা বলেন, জলাধারের উপর দিয়ে রাস্তা বা বাঁধ দেয়া প্রচলিত আইন অনুযায়ী অবৈধ। যেকোন স্থানে পানি প্রবাহে বাঁধাগ্রস্ত হলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ফসল বিনষ্ট হয়।

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, হাওরের কার্যক্রম না দেখে বুঝা যাবে না। তবে হাওরকে কেন্দ্র করে পরিবেশ, মৎস্য, কৃষি, খাদ্য ও পানি সম্পদ জড়িত। সেজন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করার জন্য আমরা প্রস্তাব করেছি। সেটি হলে আমরা সরেজমিনে সমীক্ষা করে প্রতিবেদন দাখিল করার পর উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ হলে ক্ষতি হওয়ার কথা নয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কমলগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, এটি এলাকার মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে মাননীয় সংসদ সদস্যের মাধ্যমে খাল খনন করা হচ্ছে। এখানে কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশের ক্ষতির কোন আশঙ্কা নেই।

এ ব্যাপারে কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য, সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মোঃ আব্দুস শহীদ এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, এই প্রকল্পের বিষয়টি সরেজমিনে এসে কথা না বললে বুঝা যাবে না। তবে এলাকায় চাষাবাদের স্বার্থেই এটি করা হচ্ছে। বর্ষাকালে ফসল না হলে কিছু যায় আসে না। সারা বছর যাতে মানুষ চাষাবাদ করতে পারে সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer