Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘পাওয়ার হাউজ অব নিউট্রিশন’ নিয়ে কিছু কথা

এস এম মুকুল

প্রকাশিত: ০২:২৫, ১৪ অক্টোবর ২০১৭

আপডেট: ০৩:২৪, ১৪ অক্টোবর ২০১৭

প্রিন্ট:

‘পাওয়ার হাউজ অব নিউট্রিশন’ নিয়ে কিছু কথা

-লেখক

ঢাকা : বর্তমান বাজারে সবচেয়ে সস্তা প্রাণিজ প্রোটিনের উৎস হিসেবে পোল্ট্রির ডিমের চাহিদা ব্যাপক। আমরা জানি, তুলনামূলকভাবে ডিম সস্তা প্রোটিন। ডিমকে বলা হয়- আদর্শ প্রোটিন ফ্যাক্টরি বা ‘পাওয়ার হাউজ অব নিউট্রিশন’ অর্থাৎ পুষ্টির আধার। প্রাণিজ প্রোটিনের মধ্যে ডিম অন্যতম। ডিমে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা হৃদরোগসহ অনেক রোগের বিরুদ্ধে বেশ কার্যকরী। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে- উৎসব আর সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে, স্কুলের টিফিন, রোগীদের পথ্য থেকে শুরু করে মজাদার আধুনিক রেসিপিতে অনন্য স্বাদে ও পুষ্টিতে ডিম ব্যাপকভাবে সমাদৃত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়ার প্রীতি বাড়ছে জনগণের মাঝে। আধুনিক বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, সুস্থ ও সবলভাবে বাঁচার জন্য ডিম একটি পরিপূর্ণ খাদ্য। ডিমে আছে প্রায় সব ধরনের ভিটামিন, দরকারি অ্যামিনো এসিড, খনিজ পদার্থ, ডিমে যে কোলেস্টেরল আছে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক নয়, বরং উপকারী। ডিম উচ্চরক্তচাপ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। ডিম দৃষ্টিশক্তি বাড়ায় এবং চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। ডায়াবেটিস, স্তন ক্যানসার এবং মাইগ্রেনের ঝুঁকি কমায়।

সাধারণত ৫০ গ্রাম ওজনের একটি ডিমে প্রোটিন থাকে প্রায় ৬ থেকে ৬.৫০ গ্রাম। এছাড়াও ডিমে থাকে— ভিটামিন, খনিজ উপাদান, রঞ্জক পদার্থও সামান্য ক্যালরি। ডিমের কুসুমে থাকে চর্বি যার ভেতরে বিদ্যমান কোলেস্টেরল। আগে মনে করা হতো ডিমের কোলেস্টেরল মানবশরীরের জন্য ক্ষতিকর এবং তা হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ। তবে বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ডিমের কোলেস্টেরল পরিপাক ও শোষণের পর রক্ত বা রক্তরস পর্যন্ত পৌঁছায় না।

ডিম এখন আমাদের খাদ্য তালিকায় নিয়মিত। সবদিক থেকে ডিমকে বিবেচনা করা যায় সস্তা ও সহজলভ্য প্রাণীজ প্রোটিনের উৎ্স হিসেবে। আপনি রোজ কয়টি ডিম খেতে পারবেন তা সম্পূর্ণই নির্ভর করে সারা দিন গ্রহণ করা আপনার অন্যান্য খাবারের ওপর। দ্য স্মল চেঞ্জ ডায়েট নামের বইতে পুষ্টিবিদ কেরি গানস বলেছেন- এক সপ্তাহে এক ডজন ডিম একজন ব্যক্তির জন্য যথাযথই মনে করছেন পুষ্টিবিদরা। পুষ্টিবিদদের মতে, যদি একটু অলিভ অয়েলে লবণ, গোলমরিচ দিয়ে ডিম ভেজে খাওয়া হয়, সেক্ষেত্রে দিনে দুটি ডিম খাওয়া যেতেই পারে।

অপরপক্ষে ডিম, পনির, মাংস একই দিনে থাকে, তাহলে কিন্তু দুটি ডিম একদিনে খাওয়া মোটেও ভালো হবে না। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, নারীদের আ্যডোলেশন পিরিয়ডে বা পরবর্তীকালে সপ্তাহে কমপক্ষে ৬টি ডিম খেলে ব্রেস্ট ক্যানসারের সম্ভাবনা প্রায় ৪৪ ভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। ডিমের কুসুমে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘কে’ আছে। এটি হাড় শক্ত ও মজবুত করে এবং প্রজনন অক্ষমতা দূর করতে সহায়তা করে। ডায়াবেটিক তাড়াতে ডিম দারুণ কার্যকরী। সপ্তাহে ৪টি ডিম খেলে টাইপ ২ ডায়াবেটিকসের ঝুঁকি ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। শিশুর হাড় গড়নে ও মেধার বিকাশে ডিম খুবই কার্যকর। ডিমে আছে ভিটামিন এ। যা দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে।

প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ ও স্বাস্থ্যবান এবং মেধাবী জাতি গঠনের লক্ষ্যে ডিমের গুণাগুণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ডিম দিবস। পোল্ট্রি সংশ্লিষ্ট ৭ টি অ্যাসোসিয়েশনের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ড্রস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ও মৎস ও প্রাণী সম্পদ অধিদফতর যৌথভাবে দিবসটি উদযাপন করে।

১৯৯৬ সাল, অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ‘ইন্টারন্যাশনাল এগ্ কমিশন’-এর উদ্দ্যোগে ডিম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো উদযাপিত হয় বিশ্ব ডিম দিবস। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের গবেষকরা বলেছেন, যদি সম্পৃক্ত চর্বি খাওয়া কমিয়ে দিতে পারেন তবে সপ্তাহে ছয়টি ডিম খাওয়া খারাপ কিছু নয়। একটা ডিমে চর্বি বা ফ্যাটের পরিমাণ ৫ গ্রামের মতো। কিন্তু তাতে সম্পৃক্ত চর্বি মোটে দেড় গ্রাম। বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকায় ডিম হতে পারে নতুন সদস্য। ডিমে আছে উপকারী ওমেগা ৩ চর্বি, যা উল্টো রক্তনালি ও হৃদ্যন্ত্রের জন্য ভালো। তাই পুষ্টি উপাদানহীন খাবার বাদ দিয়ে বরং ডিম খাওয়া ভালো। ডিমে প্রায় ১১ ধরনের ভিটামিন ও খনিজ উপাদান আছে, যা শরীরের জন্য দরকারি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভিটামিন ডি, যা বেশিরভাগ খাবারে অনুপস্থিত।

ডিমে বায়োটিন নামের পদার্থও আছে, যা আজকাল অনেকে চুল পড়া কমাতে ক্যাপসুল হিসেবে কিনে খান। ডিম আছে আমিষেরও চমৎকার মিশেল। বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও গর্ভবতী নারীদের আমিষের চাহিদা পূরণে ডিম নিয়মিত খাওয়া উচিত। বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, চর্বি একেবারে খাওয়া ভালো নয়, কথাটা সঠিক নয়। যা ভালো নয়, তা হলো সম্পৃক্ত চর্বি এবং ট্রান্সফ্যাট। গরু খাসির মাংসের জমাট চর্বি, ঘি, মাখন, ক্রিম, পেস্ট্রি ও ডিপ ফ্রাই খাবারে আছে এ ধরনের ক্ষতিকর চর্বি। বাদ দিতে হলে এগুলো বাদ দিন। আর স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মানে কেবল অস্বাস্থ্যকর খাবার বাদ দেওয়া নয়।

আশার খবর হলো ডিম শুধুমাত্র পুষ্টি উপাদেয় খাবার হিসেবে অসুখ অসুস্থতায় অথবা অতিথি আপ্যায়নে নয়- প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ডিমের গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী ডিমের চাহিদা প্রতিবছরই বাড়ছে। গত ৪০ বছর বিশ্বে ডিম খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে তিন গুণ। গবেষণায় বলা হয়, প্রত্যেক নারীর শরীরে রোজ কমপক্ষে ৫০ গ্রাম প্রোটিন দরকার। একটি ডিমে থাকে ৭০-৮৫ ক্যালরি বা ৬.৫ গ্রাম প্রোটিন। শরীরকে চাঙ্গা রাখতে তাই রোজ ডিম খেতেই হবে। দেশে বর্তমানে প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় দুই থেকে সোয়া দুই কোটি।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়- জাপানের মানুষ বছরে ডিম খায় গড়ে প্রায় ৬০০টি। বাংলাদেশের মানুষ খায় মাত্র ৪৫ থেকে ৫০টি ডিম। আমরা জানি উন্নত বিশ্বে ডিম গ্রহণের পরিমাণ বছরে প্রায় ৩৬০টি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর মতে, সুস্থ থাকার জন্য প্রতিটি মানুষকে বছরে অন্তত: ১০৪টি ডিম খাওয়া দরকার। বর্তমান সরকার ২০২১ সাল নাগাদ জনপ্রতি বার্ষিক ডিম খাওয়ার গড় পরিমাণ ১০৪টিতে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বলে জানা গেছে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে সরকারের এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে ২০২১ সাল নাগাদ দৈনিক প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ডিম উৎপাদনের প্রয়োজন হবে। পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব হলে ২০২১ সালের মধ্যে দেশে প্রতি বছর ১২০০ কোটি ডিম উৎপাদন করা সম্ভব। এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে এ সেক্টরে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে।

ডিম নিয়ে ভালো খবরটি হলো- জাপানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এআইএসটি) গবেষকেরা জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে বিশেষভাবে তৈরি মুরগির ডিম দিয়ে ক্যানসারের ওষুধ বানানোর চেষ্টা করছেন। নতুন এই ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হলে তা চিকিৎসার খরচ নাটকীয় হারে কমে যাবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। গবেষকরা জানিয়েছেন, মুরগির ডিমে ‘ইন্টারফেরন বেটা’ নামের একটি আমিষজাতীয় পদার্থ (প্রোটিন) তৈরির চেষ্টা করছেন। সাধারণত এই প্রোটিন স্নায়ুতন্ত্রের রোগ ও হেপাটাইটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

বর্তমানে ইন্টারফেরন বেটার কয়েক মাইক্রোগ্রামের দাম প্রায় ৮৮৮ ডলার। জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে বিশেষভাবে তৈরি মুরগির ডিমে এই প্রোটিন উৎপাদন করা সম্ভব হলে এর দাম অনেকটা কমে যেতে পারে। সবশেষে বলবো- এই শিল্পের সাথে যারা জড়িত তাদের উচিত হবে- সবচেয়ে নিরাপদ ও পুষ্টিমাণ সমৃদ্ধ পোল্ট্রির ডিম ও মাংস যত সুলভে দেশের বাজার সৃষ্টি করা যায় এ শিল্পের বিকাশ ততই ত্বরান্বিত হবে। আমরাও পাবো সুস্থ, সবল ও মেধাবি প্রজস্ম।

লেখক : বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer