Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

চৌরাসিয়ার বাঁশিতে পর্দা নামলো উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১১:৪৫, ২৯ নভেম্বর ২০১৬

আপডেট: ২১:৫২, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭

প্রিন্ট:

চৌরাসিয়ার বাঁশিতে পর্দা নামলো উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের

ছবি: বেঙ্গল ফাউন্ডেশন

ঢাকা :  রাতের গভীরতার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল মানুষ। অন্যান্য পরিবেশনা উপভোগের পাশাপাশি পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে মুগ্ধ হওয়ার ব্যাকুলতা যখন তুঙ্গে, তখন রাতের শেষ প্রহর।

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৬- এর সমাপনী রাতে বনানীর আর্মি স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় সংগীতপ্রেমী দর্শক-শ্রোতার ভিড়ে। রাতভর বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশনা শেষে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া।

অপেক্ষমান হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতার করতালির মধ্য দিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দেন কিংবদন্তী এই শিল্পী। উপস্থিত হাজারও দর্শক যেন মুহূর্তেই বুঁদ হয়ে যান সুরের মায়ায়। এভাবেই সুরের মাধুর্যে এ বছরের মতো পর্দা নামে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের।

পাঁচ দিনব্যাপী বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের পঞ্চম ও শেষ দিনের এ আয়োজন শুরু হয় ২৮ নভেম্বর সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই দলীয় কণ্ঠসংগীত পরিবেশন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ। সমবেত কণ্ঠে রাগ ভূপালী পরিবেশন করেন তারা। এ সময় তবলায় তাল দেন স্বরূপ হোসেন ও জাকির হোসেন।

সংগীত পরিবেশনা শেষ হলে শিল্পীবৃন্দের হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জী। শিল্পীদের পক্ষে স্মারক গ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান ড. লিনা তাপসী।

এরপর বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ দলীয় সেতার পরিবেশন করেন। শিল্পীরা হলেন নিশিত দে, সম্য দে, আশিস নারায়ণ সরকার, প্রসেনজিৎ মণ্ডল, আহম্মেদ ইমতিয়াজ হুমায়ুন, টি.এম. সেলিম রেজা, খন্দকার নাজমুস সাকিব, রিংকু চন্দ্র দাস, মেহরিন আলম, জ্যোতি ব্যানার্জী, জাহাঙ্গীর আলম শ্রাবণ ও মোহাম্মদ কাওছার। সেতার, তবলা ও গিটারের সম্মিলিত সুরে তারা রাগ চারুকেশী পরিবেশন করেন। তবলায় ছিলেন প্রশান্ত ভৌমিক ও সুপান্থ মজুমদার।

বাদ্য শেষে তাদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সহ-সভাপতি রুবি গজনবী।

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৬-এর আনুষ্ঠানিক সমাপনী ঘোষণা করা হয় এরপরই। অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। মঞ্চে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।

শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান উৎসবে আগত শিল্পীদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন,‘আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা যখন স্তিমিত হতে যাচ্ছিল তখন এই উৎসব সে চর্চাকে আবার উজ্জীবিত করেছে। যা আমাদের জাতীয় চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।’

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ তাঁর বক্তব্যের শুরুতে সদ্যপ্রয়াত লেখক সৈয়দ শামসুল হককে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের রক্তে শুদ্ধ সংগীতের ধারা বইছে। এই ভূখণ্ড থেকে এক সময় ওস্তাদ আলী আকবর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, পণ্ডিত রবিশংকরের মতো শিল্পীর জন্ম হয়েছে। এই উৎসব চলমান থাকলে পুনরায় আমরা বিশ্বমানের শিল্পী পাবো।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। দেশের সংগীতশিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে তিনি সংগীত প্রযোজকদের অনুরোধ করেন শিল্পীদের ন্যায্য পাওনা দেওয়ার জন্য। তিনি বলেন,‘শিল্পীরা পারেন একটি দেশের মননে পরিবর্তন আনতে। তাই তাঁদের যথাযোগ্য সম্মান যেন আমরা দিতে পারি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে পুরান ঢাকার ১২টি সংগীত বিদ্যালয় পরিচালনার ভার নিতে তাকে অনুরোধ করেন এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য করারও আশ্বাস দেন। মৌলবাদি অপশক্তি প্রতিরোধে এই উৎসবকে একটি শক্তিশালী উদ্যোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন,‘আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। কোন অপশক্তি এই অগ্রযাত্রা রুখতে পারবে না।’

স্কয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী বক্তব্যের শুরুতেই সবাইকে ধন্যবাদ জানান। উৎসবের সঙ্গে থাকতে পেরে গর্ব প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে অন্যান্য আরও বড় উৎসব আমরা আপনাদের উপহার দেব।’

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের বক্তব্যের শুরুতে তিনি সদ্যপ্রয়াত লেখক সৈয়দ শামসুল হক, হোলি আর্টিজানে নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মৌলবাদি আক্রমণে নিহতদের স্মরণ করে আগত সবাইকে এক মিনিট নিরবতা পালন করতে অনুরোধ করেন।

অতঃপর তিনি উৎসবের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ও মাছরাঙ্গা টেলিভিশনসহ উৎসব সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি এই উৎসবকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নের একটি মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেন। সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান আয়োজনে সহায়তা করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও সংস্কৃতিমন্ত্রীসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন জনাব আবুল খায়ের।

তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন যেন দেশে কমপক্ষে তিন হাজার সিনেমা হল তৈরি করে দেওয়া হয়। এছাড়াও দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক ক্লাব গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটা বড় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাই আমরা। যেখানে শুধু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হবে।’ বক্তব্যের শেষে তিনি আসছে জানুয়ারি মাসে তিন রাত ধরে সুফি গানের উৎসব করার ঘোষণা দেন।

সমাপনী অনুষ্ঠান শেষে অতিথিদের হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন তিনি।

দিনের তৃতীয় পরিবেশনা ছিল পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার। তিনি সন্তুরে রাগ যোগ বাজিয়ে শোনান।
পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।

পরবর্তী পরিবেশনায় খেয়াল শুনিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন কুমার মারদুর। তিনি পুরিয়া কল্যাণ ও কিরওয়ানিতে ভজন পরিবেশন করেন। পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন লেখক আনিসুল হক।

খেয়ালের পর সেতার পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত কুশল দাস। সেতারের তারে কৌশি কানাড়া রাগ তোলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে তবলায় ছিলেন শুভঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। পরিবেশনা শেষে পণ্ডিত কুশল দাসের হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার।

রাতের সপ্তম পরিবেশনায় দর্শকদের খেয়ালে মুগ্ধ করেন আরতী আঙ্কালিকর। তাকে তবলায় সঙ্গ দেন রোহিত মজুমদার। প্রথমে তিনি রাগ যোগ কোষ পরিবেশন করেন। পরবর্তীতে ‘সাজনা ক্যায়সে মে আয়ু তেরে পাস’ গানে মিশ্র খাম্বাজে ঠুমরী পরিবেশন করেন।

পরিবেশনা শেষে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম শিল্পীর হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন।

পঞ্চম ও সমাপনী দিনের সর্বশেষ পরিবেশনা ছিল পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার। তিনি বাঁশিতে রাগ প্রভাতী ও রাগ জৈৎ বাজিয়ে শোনান। তারপর ফোক ধুন বাজিয়ে তিনি শেষ করেন তাঁর পরিবেশনা। সঙ্গে তবলায় তাল দেন শুভঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। পাখাওয়াজে ছিলেন পণ্ডিত ভবানী শঙ্কর। বাঁশি বাজিয়ে শিল্পীকে সহযোগিতা করেছেন দেবপ্রিয় রনদ্বীপ ও বিবেক সোনার এবং তানপুরায় ছিলেন অভিজিৎ কুণ্ডু।

পরিবেশনা শেষে শিল্পীর হাতে উৎসবের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৬-এর নিবেদক স্কয়ার গ্রুপ। আয়োজন সর্মথনে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড। অনুষ্ঠানে সম্প্রচার সহযোগী ছিল মাছরাঙা টেলিভিশিন। মিডিয়া পার্টনার আইস বিজনেস টাইমস। আতিথেয়তা সহযোগী হিসেবে ছিল র্যা ডিসন হোটেল। সার্বিক সহযোগিতায় বেঙ্গল গ্রুপ। অনুষ্ঠান আয়োজন হয়েছে বেঙ্গল ডিজিটাল, ম্যাংগো, বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয় ও পারফেক্ট হারমনি প্রোডাকশনস্ সিঙ্গাপুরের সহযোগিতায়। ইভেন্ট ব্যবস্থাপনায় ছিল ব্লুজ কমিউনিকেশনস।

উপমহাদেশ তথা বিশ্বে র্সবাধিক বড় পরিসরে আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীতের এ আসরটি এ বছর উৎর্সগ করা হয় সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) স্মৃতির উদ্দেশ্যে।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer