Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১৩ ১৪৩১, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

একজন ইউএনও, বিচার বিভাগ, সার্ভিস রুল ও আমাদের আইন

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

প্রকাশিত: ০০:২৫, ২৫ জুলাই ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

একজন ইউএনও, বিচার বিভাগ, সার্ভিস রুল ও আমাদের আইন

 

বহু বছর আগে মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং লিখেছিলেন, ‘যে কোন জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে। তারিক সালমান বরিশালের আগৈলঝাড়ার ইউএনও থাকাকালে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে ‘বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করে ছাপিয়েছিলেন’ এ অভিযোগে সর্বপ্রথম বরিশালের জেলা প্রশাসক ড. গাজী সাইফুজ্জামান গত ৩ এপ্রিল’২০১৭ তারিখে ওই ইউএনওকে শো’কজ করেন এবং তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য কেন বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করা হবে না তার যথাযথ কারণ সাত কার্যদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে জানাতে বলা হয়।

তারিক সালমান মনের মাধুরী মিশিয়ে শো’কজের জবাবও দেন। কিন্তু বিধিবাম ! জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় ডিসি মহোদয় বিষয়টি বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারকে অবহিত করেন। বরিশাল বিভাগীয় কমিশরার মোঃ গাউস গত ১৮ এপ্রিল বরিশালের আগৈলঝাড়ার ইউএনও তারিক সালমানের শো’কজের জবাব সন্তোষজনক নয় মর্মে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে লিখিতভাবে অবহিত করেন।

এরপর এ বিষয়টি নিয়ে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওবায়েদ উল্লাহ সাজু গত ৭ জুন এ ইউএন’র বিরুদ্ধে একটি মানহানি মামলা করেন। বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক মো. আলী হোসাইন সার্বিক দিক বিবেচনা করে মামলাটি আমলে নিয়ে ইউএনও মহোদয়কে গত ১৯ জুলাই আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। নির্ধারিত দিনে আদালতে হাজির হন তারিক সালমান। ইউএনও’র পূর্ব আচরণে ক্ষুব্ধ আইনজীবীগণ জামিনে আপত্তি দাখিল করেন।

পরিস্থিতি শান্ত করতে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক আদেশ পরে দেওয়া হবে জানিয়ে আসামীকে পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। এতেই সৃষ্টি হয় নানা জটিলতা। পরিস্থিতি শান্ত হলে দু’ঘন্টা পর বিচারক মহোদয় তাঁকে জামিনে মুক্তি দেন। এরই মধ্যে শুরু হয় ভুল বুঝাবুঝি। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ঘটনার জোর প্রতিবাদ জানানো হয়। এ নিয়ে আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়, এখনো চলছে, চায়ের দোকান থেকে পত্রিকার কলাম, টেলিভিশন টক শ’ পর্যন্ত। সন্দেহ নেই আরো কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক। তারিক সালমানকে গ্রেপ্তারের ওই ঘটনায় ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত বিস্মিত হয়েছেন’ বলে তার উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন। এ ঘটনায় মামলার বাদী বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ওবায়েদ উল্লাহ সাজুকে কেন স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না তা জানতে চেয়ে নোটিস দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। অবশেষে তারিক সালমনের বিরুদ্ধে মামলাটি গত ২৩ জুলাই আদালতের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে নেন মামলার বাদী ওবায়েদুল্লাহ।

বাংলাদেশ সার্ভিস রুল পার্ট-১ রুল ৭৩ মতে সরকারী কোনো কর্মচারী ফৌজদারী অপরাধে হাজতে গেলে তিনি সাথে সাথে সাময়িক বরখাস্ত বলে গণ্য হবেন। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পেলেও উক্ত সাময়িক বরখাস্ত চলমান থাকবে যতক্ষণ না মামলা নিষ্পত্তি হয়। তবে আত্মসমর্পনের দিনই জামিন পেলে কোনো সমস্যা নেই। এই বিধিতে ব্যবহৃত ‘জেলে আটক’ শব্দ দ্বারা আদালতের হেফাজতে নেওয়া শব্দসমূহুকে অন্তর্ভূক্ত করেছে বলে গণ্য করতে হবে। জেলে আটক হওয়ার দিন থেকে সাময়িক বরখাস্ত বলে বিবেচিত হবেন এবং বিচার কার্যক্রম শেষ না হওয়া অবধি পর্যন্ত বিধি ৭১ এর বিধান মোতাবেক খোরপোষ ভাতা পাবেন।

বাংলাদেশ সার্ভিস রুল পার্ট-১ রুল ৭৩ এর যদি কোন ব্যতিক্রম না থাকে কিংবা আমার জানা যদি ভুল না থাকে তাহলে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে যেহেতু বলছে যে ইউএনও মহোদয়কে হাজতে নেয়া হয়েছিল, এবং ঘটনা যদি সত্যি হয়, তবে সংশ্লিষ্ট বিধি অনুযায়ী তিনি বর্তমানে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত হবেন-এটাই আইনের ব্যাখ্যা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন, ইউএনও মহোদয় হাজতে যাবার পর জামিনে মুক্ত হয়ে কীভাবে সরকারি দায়িত্বে আছেন?

এবার প্রশ্ন উঠতে পারে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১৯৭ এর প্রয়োগ নিয়ে। এই আইনের অধীন জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১৯৭ এর বিধান আবশ্যিকভাবে প্রতিপালন করতে হবে। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় বলা হয়েছে যে, সরকারের পূর্ব অনুমতি ছাড়া যে কোন অপরাধের জন্য কোন সরকারী কর্মচারীর বিরুদ্ধে আদালত কর্তৃক মামলা গ্রহণ অননুমোদিত ও এখতিয়ার বহির্ভূত বলে গণ্য হবে।

কিন্তু ফৌজদারী কার্যবিধির ৫২৯ এর (ঙ) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে যে, যদি কোন ম্যাজিস্ট্রেট, আইনে ক্ষমতাবান না হওয়া সত্ত্বেও ভুলক্রমে সরল বিশ্বাসে ১৯০ ধারার (১) উপ-ধারার (ক) অনুচ্ছেদ বা (খ) অনুচ্ছেদ অনুসারে অপরাধ আমলে গ্রহণ করে, তবে এ নিয়মের দরুন কার্যধারা বাতিল হবে না। এ থেকে ষ্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, আদালতের ভূল আদেশ বলতে কিছু নেই।

এদিকে সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।

সব বিতর্কের অবসান ঘটাতে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগে বরগুনার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজী তারিক সালমনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার নথি তলব করেছেন প্রধান বিচারপতি। যার কাছে নথি চাওয়া হয়েছে সেই বিচারক বরিশালের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলী হোসেন এরই মধ্যে ইন্টারনেটে সংশ্লিষ্ট নথি পাঠিয়েও দিয়েছেন। তবে ২৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর পাঠানো নথির সঙ্গে একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি।

ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘আদালতের কার্যপ্রণালী শেষে এজলাস ত্যাগ করে খাসকামরায় এসে শুনি ইউএনও সাহেবের জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে মর্মে অনলাইন মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ইউএনও সাহেবের জামিনের আবেদন একটি বারের জন্যও নামঞ্জুর করা হয়নি। ফলে জেলহাজতে প্রেরণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

বরিশালের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলী হোসেন এর ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়, ‘এ মামলার শুনানিকালে ফরিয়াদি ওবায়দুল্লাহ সাজু এবং তার পক্ষে উপস্থিত থাকেন বর্তমান সংসদ সদস্য এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো.ইউনুস (আদেশ প্রদানের পূর্বে এজলাস ত্যাগ করেন), সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুর রশিদ, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও সম্পাদক অ্যাডভোকেট শেখ আবদুল কাদের, অ্যাডভোকেট আনিছ উদ্দিন আহম্মদ শহীদসহ ৫০-৭০ জন আইনজীবী। আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোখলেছুর রহমান। ’

‘শুনানি চলাকালে আদালত কক্ষ যেমন আইনজীবীদের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ ছিলো, তেমনিভাবে আদালতের বারান্দা এবং সংলগ্ন রাস্তায় উৎসুক জনসাধারণসহ মিডিয়া কর্মীবৃন্দের উপস্থিতিতে কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ বিরাজমান ছিলো।’

‘শুনানি চলাকালে উৎসুক জনসাধারণের রোষানল হতে ইউএনও সাহেবের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য শুনানি মুলতবি করি এবং ইউএনও সাহেবের আইনজীবীর নিবেদন মোতাবেক কাগজাত (প্রয়োজনীয় নথি) দাখিল করতে বলি এবং আরও মৌখিক আদেশ দেই যে, কাগজাত দাখিলের পরে পুনরায় শুনানি হবে। আমি তখন ইউএনওকে আদালত কক্ষে বসাতে বলি।’

‘আদালতে কর্তব্য পালনরত পুলিশ সদস্যগণ ইউএনওর সার্বিক ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সাধ্যমত চেষ্টা করেন। ইউএনও সাহেবকে আদালতের ডক হতে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে আদালতের কক্ষে বসানোর জন্য আদালত কক্ষের এক দরজা দিয়ে বাহির হয়ে বারান্দা ব্যবহার করে অন্য দরজা দিয়ে আদালত কক্ষে আনতে হয়েছে। এই সময়ে মিডিয়ার কর্মীবৃন্দ বা অন্য কেহ কোন ছবি তুলেছেন কিনা তা অবলোকন করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই সময়ে কি সংবাদ প্রচার করা হয়েছে তাও আমি বিচারকার্য পরিচালনাধীন থাকায় জানতে পারিনি।’

‘অতপর ইউএনও সাহেবের পক্ষে কাগজাত দাখিল হলে এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অবসান হলে জামিনের দরখাস্ত এবং দ্যা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৮৯৮, এর ২০৫ ধারার দরখাস্ত আইনানুগ প্রক্রিয়া পালনপূর্বক মঞ্জুরক্রমে স্ব-সম্মানে জামিন প্রদান করা হয়। আমি ইউএনও সাহেবের আদালত কক্ষ ত্যাগের পরে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয় এবং অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি পরিহারের জন্যই তৎক্ষণাৎ জামিনের দরখাস্তের আদেশ না দিয়ে কাগজাত দাখিল হলে শুনানি অন্তে আদেশ দিব বলে উদ্ভূত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছি।’


এবার আসল কথায় আসি। পাঠক নিশ্চয়ই টাঙ্গাইলের কলেজ শিক্ষার্থী সাব্বির শিকদারের কথা মনে আছে। টাঙ্গাইল-৮ আসনের সাংসদ অনুপম শাহজাহানকে নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি সাব্বির শিকদার নামক এক কলেজ শিক্ষার্থীকে সন্দেহ করে থানায় ডেকে আনে। এরপর একটি কুচক্রী মহলের যোগসাজশে ওই শিক্ষার্থীকে সখিপুর ইউএন’র কার্যালয়ে হাজির করা হয়। এ অবস্থায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওই শিক্ষার্থীকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই বছরের কারাদ- দেন। অথচ ভ্রাম্যমাণ আদালত তথ্যপ্রযুক্তি আইনে কোনভাবেই সাজা দিতে পারেন না। আইনানুযায়ী জিডি হলে তদন্ত হবে। তদন্ত ছাড়া এভাবে দ- দেওয়া যায় না। এটা কেন হলো, তার ব্যাখ্যা জানতে ইউএনও ও ওসিকে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর তলব করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ এই আদেশ দেন। একই সঙ্গে কারাদ- পাওয়া শিক্ষার্থী সাব্বির শিকদারকে জামিন দেন আদালত।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ২০১০ সালের ১ লা জুলাই এক শিক্ষককে এক বছর সাজা দেন কুমারখালীর ইউএনও। কিন্তু প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট হওয়া যায়, এটি ষড়যন্ত্রমূলক ফাঁসানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তৎকালীন ভ্রাম্যমান আদালতের বিচারক ইউএনও মানিকহার রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, এখানে ঘটনা ৮০ ভাগ সত্য মনে হয়েছে।


‘ইউএনওর নির্দেশে মৎস্য কর্মকর্তাকে হাতকড়া, মুচলেকায় মুক্তি’ শিরোনামে ২০১২ সালের ২৭ জুলাই দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। পুলিশের ভাষ্য, সরকারি আদেশ অমান্য করায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। সমঝোতার ভিত্তিতে থানা পুলিশ একটি মুচলেকা রেখে আটক মৎস্য কর্মকর্তাকে ছেড়ে দেয়। নিজ হাতে লেখা ওই মুচলেকায় মৎস্য কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আগামী ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে প্রকল্পের সব কাগজপত্র ইউএনওর কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল হাসেম জানিয়েছিলেন, সরকারি আদেশ অমান্য করায় জিয়াউদ্দিনকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে এক মুচলেকায় ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ডিসি’রা সামারি ট্রায়াল বা সংক্ষিপ্ত বিচারের দাবি জানিয়ে ছিলেন। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর আমরা কাংখিত ফল পাইনি। কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে আসবে। আর যদি ডিসিদের চাপে সমান্তরাল বিচারব্যবস্থার জন্ম দেওয়া হয়, তাহলে আম ও ছালা দুটোই যাবে।

মানবাধিকার আইনের নীতিমালা মতে, একজন অভিযুক্তকে অবশ্যই নিম্নলিখিত সুযোগ দিতে হবে।
ক) সুস্পষ্ট অভিযোগ লিখিতভাবে আনতে হবে।
খ) অভিযোগ সমর্থনে প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে।
গ) অভিযোগ প্রমাণে সাক্ষীদের জবানবন্দি নিতে হবে।
ঘ) অভিযুক্তকে অভিযোগকারী ও তাঁর সাক্ষীদের জেরার সুযোগ দিতে হবে।
ঙ) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য প্রস্তুুতির পর্যাপ্ত সুযোগ ও সময় দিতে হবে।
চ) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজ পছন্দ মোতাবেক বিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের এবং পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
ছ) আত্মপক্ষ সমর্থনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাক্ষ্য ও সাক্ষী উপস্থাপনের সুযোগ দিতে হবে।

কিন্তু ভ্রাম্যমান আদালত আইনটি পুরোপুরি বিচার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ওই আইন ওপরে বর্ণিত সব নীতিমালা উপেক্ষা করে সরকারের একটি বিশেষ শ্রেণীর কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য ঝটপট আলোচ্য আইনটি প্রণয়ন করে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে ইতিহাসের কোনো আইন মানবতা বিমুখ হয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারি।

কগনিজেন্স পাওয়ার মানে অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে বলা আছে, কগনিজেন্স পাওয়ার একটি বিচারিক ক্ষমতা। এটা সর্বতোভাবেই বিচার-প্রক্রিয়ার অংশ। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল ও বিচারপতি লতিফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে ওই অভিমত দেন। তাহলেই প্রশ্ন, ডিসিরা ও তাঁদের অধীন নির্বাহী হাকিমরা কি বিচারক? ওঁরা বিচারক না হলে ওঁদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় ঢুকতে দেওয়া হবে কেন?

নির্বাহী বিভাগ প্রশাসন চালাবে। বিচার বিভাগ বিচার করবে। কিন্তু বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র ও শাসনগোষ্ঠী এই মন্ত্র মানতে নারাজ। সে কারণে বিচার বিভাগ পৃথক্করণবিরোধী শক্তি বিয়াম মিলনায়তনে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। বিচারিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে ডিসিদের তর্জনগর্জন সেই বিদ্রোহের সুতোয় বাঁধা। সেই থেকে তাঁরা ওত পেতে আছেন। যখনই সুযোগ পাচ্ছেন, খাবলা মেরে বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছেন।

নির্বাচনী অপরাধের বিচার বিচারিক হাকিমদেরই করার কথা। কিন্তু গোপনে কোনো আলোচনা ছাড়াই জরুরি অবস্থায় নির্বাচনী আইনে ঠিকই ঢুকে পড়ে প্রশাসন ক্যাডার। বিচারকার্যের মাতব্বরিটা আমলাদের হাতেও থাকা চাই।

সম্প্রতি ডিসিরা ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬০ ও ২৬২ ধারা ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশের তফসিলের পেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার আবদার করেছেন। কিন্তু সিআরপিসির সংশোধন ছাড়া এটা করা যাবে না। অবশ্য তাতে কী। কী করে সংসদে হাঁ জয়যুক্ত করাতে হয়, সেটা তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। ওটা আমলাতন্ত্রের নখদর্পণে। সরকারি দলকে টোপ দেওয়া সহজ। সামনে নির্বাচন। ডিসিরা হবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। তাঁরা বলতেই পারেন, ওটা আমাদের দিন। দেখুন আমরা কী করি। কারণ, তখন নির্বাহী হাকিমরা ‘নির্বাচনে ঘুষ’, ‘এক ব্যক্তির পরিবর্তে অন্য ব্যক্তির ভোট দেওয়ার’ মতো নির্বাচনী অপরাধের সংক্ষিপ্ত বিচার করতে পারবেন।

সত্যি বলতে কি, আমলাচালিত কোর্টকে ক্যাঙারু কোর্টের সঙ্গে তুলনা করলে অত্যুক্তি হয় না। ক্যাঙারু কোর্টে যিনি প্রসিকিউটর, তিনিই বিচারক। মোবাইল কোর্টেও তা-ই; বরং ক্যাঙারু কোর্টে আসামি আইনজীবীর সুবিধা পান। মোবাইল কোর্টে তা-ও লাগে না। ডিসিদের কগনিজেন্স পাওয়ার দেওয়া হলে ক্যাঙারু কোর্টগুলো আরও বুনো হয়ে উঠতে পারে। সিআরপিসিতে ১৯০ ধারার ৪ উপধারাটির সংযোজন তাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি ছুরিকাঘাত। এটা এক অব্যাহত হুমকি। ডিসিদের কগনিজেন্স পাওয়ার দেওয়া হলে দেশে রাতারাতি একটি ব্যাপকভিত্তিক সমান্তরাল বিচার বিভাগের জন্ম নেবে। মুহূর্তেই দেশের আদালতপাড়ার চিত্র বদলে যাবে। খুনখারাবি, রাহাজানি, ছিনতাই, টেন্ডার-সন্ত্রাস কিংবা বাড়ি দখল অপরাধ যতই জঘন্য হোক, ডিসিরা এ-সংক্রান্ত অভিযোগ, মামলা ইত্যাদি আমলে নিতে শুরু করবেন। এর সবচেয়ে বড় মজা ও মওকা হবে জামিন দেওয়া। মন্ত্রীদের টেলিফোনে কত দিন তাঁর জামিন প্রদানের সুখবঞ্চিত!

বিচারের জন্য প্রস্তুত বা রেডি ফর ট্রায়াল বলে একটা কথা আছে। ওই ৪ উপধারা বলেছে, নির্বাহী হাকিমরা শুধু বিচারের জন্য কোনো মামলা বিচারিক হাকিমদের কাছে পাঠাবেন। এর আগেই অনেকগুলো পর্যায় পেরোতে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তদন্ত ও জামিন। একই সঙ্গে একই ক্ষমতা দেশের বিচারিক আদালতগুলোরও থাকবে। সুতরাং, পুলিশ ও টাউটরা মিলে একই মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ডিসি অফিস ও আদালত চত্বর দুই স্থানে লাইন লাগাবে। যেখানে সুবিধা পাবে, সেখানে তারা মামলা ঠুকতে পারবে। মামলার সংশ্লিষ্ট পক্ষরা এখন সাত ঘাটের পানি খেলে তখন খাবে চৌদ্দ ঘাটে।
আমরা অবশ্যই মনে রাখব, বিচার বিভাগ পৃথক্করণ হওয়া সত্ত্বেও আদালত থেকে দেশের মানুষ ন্যায়বিচার পাচ্ছে এমন আস্থা জনমনে সৃষ্টি হয়নি। সে জন্য যথা ওষুধ লাগবে। বিচার-বস্ত্র ডিসিদের হরণ করতে দেওয়া যাবে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের আগ্রহ কিংবা সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, তাঁদের আগ্রহের মামলাগুলো থেকে তাঁদের সন্তুষ্টি অনুযায়ী তাঁরা আদালতে বেশ প্রতিকার পান। একইভাবে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা তাঁদের সন্তুষ্টি অনুযায়ী অনেক কম প্রতিকার পান। এ অবস্থায় যখন আমরা বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার দাবি তুলছি, তখন আমলাতন্ত্রের নেতৃত্বে আরেকটি সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা সৃষ্টি করার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে।

আমরা সংবিধান ও মানবাধিকারের প্রতি হুমকি বিবেচনায় মোবাইল কোর্ট নামের দ্বৈত বিচারব্যবস্থার অবসান চাই। ১৯০ ধারার ৪ উপধারার অবিলম্বে বাতিল চাই। সামারি ট্রায়ালের ক্ষমতা দাবি করাকে ডিসিদের পক্ষে গুরুতর পেশাগত অসদাচরণ বলে দেখা উচিত। বিচার বিভাগকে সজাগ থাকতে হবে। মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম অচিরেই উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে বাতিল হবে বলে আমা করি। ভারত ডিসিদের দ্বারা জজিয়তি না করিয়ে যদি সুশাসন ও প্রবৃদ্ধি দুটোই দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ অক্ষম হবে কেন।


পৃথিবীতে এমন কোন সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে আইনের বিকাশ হয়নি। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে `আইন` ধারনাটিরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আইন তার কার্যকারীতা হারায়। প্রয়োজন হয় সে আইনকে সময় উপযোগী করে তোলা। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যেই আইন তার অস্তিত্বের সন্ধান পায়। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, আমাদের পুরো আইনব্যবস্থায় রয়েছে বৃটিশদের শঠতার ছোঁয়া। কারণ বৃটিশ তাদের দুষ্কর্ম ঢাকতে আইন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল ১৭৭২ সালে আইন ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে তিনিই সর্বপ্রথম আইন ভঙ্গ করেন। তার অধস্থন কর্মচারী জার্মান চিত্রশিল্পীর পরমা সুন্দরী স্ত্রীকে দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে স্বর্ণের দামে খরিদ করেছিলেন। আজকের আদালতে ব্যবহৃত ন্যায় বিচারের প্রতীক দাঁড়িপাল্লাকে তিনিই প্রথম অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেন। মূলত বৃটিশ আইন তৈরী করেছিল শাসন শোষনের জন্য, দরিদ্র কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের জন্য কিংবা প্রজাকে কাচারীতে ধরে নিয়ে মারধর, হাত-পা বেঁধে আঁধার কুঠুরিতে ফেলে রাখা, প্রজার স্ত্রী-কন্যাকে বন্ধক হিসেবে আটক রাখা, বিষয় সম্পত্তি ক্রোক করা এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা। বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা এখনও তার উত্তরাধিকার বহন করছে মাত্র।

যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।

একথা সত্য, মোবাইল কোর্ট আইন বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, মাদক, বালু উত্তোলন বা খাস জমি দখলের একাধিক ঘটনা এবং সফল ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের প্রাণঘাতী কর্মতৎপরতা অনেকাংশে ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রতিরোধ কর্মে অনুসৃত আইনটিতে আইনের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ ও পর্যুদস্ত করবে।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষক।

[email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer