
এভাবেই সংঘবদ্ধ গাছ চোররা কেটে নিয়ে যাচ্ছে বনের মূল্যবান সব বৃক্ষ। ছবি-বহুমাত্রিক.কম
মৌলভীবাজার : গাছ চোর চক্রের থাবায় বিপন্ন হতে চলছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। উদ্যানের বিভিন্ন টিলা থেকে অবাধে সেগুন, চাপালিশ, আওয়াল, গর্জনসহ মূল্যবান গাছ কেটে পাচার করছে সংঘবদ্ধ গাছ চোর চক্র। গাছ-গাছালি কমে যাওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়ে বন্যপ্রাণি লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে। বন্যপ্রাণির বাসস্থান ও খাদ্য সংকট তীব্র হচ্ছে।
মঙ্গলবার রাতে ট্রাকযোগে উদ্যানের বনবিট অফিসের পাশের উচু টিলা থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে বিশালাকৃতির দু’টি আওয়াল গাছ। উদ্যান দেখভালের দায়িত্বে নামে আছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি। কিন্তু তারাও রক্ষা করতে পারছেন বনের প্রান এসব গাছগুলোকে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, লাউয়াছড়া বনবিট অফিসের পিছনে প্রায় দেড় হাজার গজের মধ্যে উঁচু টিলার গাছ কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে বৃহদাকার গাছের গুড়া কালের সাক্ষী হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। মঙ্গলবার রাতেই ওই টিলা থেকে বিশালাকৃতির দু’টি আওয়াল গাছ কেটে খন্ডাংশ করে ট্রাকযোগে নিয়ে যায় গাছ চোর চক্র।
গাছ চোর চক্রের হামলার আশঙ্কায় নাম প্রকাশ না করে লাউয়াছড়া বনে বসবাসকারী এক আদিবাসী জানান, আগে এখানে হাজার হাজার সেগুন, চাপালিশ, আওয়াল, গর্জনসহ মূল্যবান নানা জাতের গাছ ছিল। এখন এ বনে নামমাত্র কিছু সেগুন গাছ অবশিষ্ট থাকলেও বাকী গাছগুলো কেটে নিয়ে যাচ্ছে গাছ চোররা। গাছচোর চক্র গাছ কেটে ট্রাক যোগে ও রেলপথে নিজস্ব ট্রলি ব্যবহার করেও পাচার করে থাকে।
এক বনকর্মীও এ অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বিশাল আয়তনের এ বনে হাতেগোনা চার পাঁচজন বনকর্মী পুরাতন আমলের বিকল বন্দুক দিয়ে সশস্ত্র শতাধিক গাছ চোরকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। উল্টো গাছ চুরি প্রতিরোধে গেলে সশস্ত্র গাছ চোর চক্রের হামলার শিকার হতে হয়।
স্থানীয়রা জানান, জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে বন ও বনজ সম্পদ রক্ষার জন্য। এ কমিটির অধিকাংশ সদস্য কোন না কোনভাবে গাছ ব্যবসার সাথে জড়িত। এর সাথে বন পাহারাদার দল (সিপিজি) রয়েছে। সিপিজি সদস্যরা রাতে পাহারা দিলেও গাছ ঠিকই চুরি হচ্ছে। তাছাড়া পাহারাদার দলের অনেক সদস্য গাছ চুরির সাথে যুক্ত।
উল্লেখ্য গত বছর গাছ চুরির সাথে যুক্ত থাকার অপরাধে সিপিজি-র সদস্য লঙ্গুর পার গ্রামের বাবুল মিয়ার নেতৃত্বে ৬ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সম্প্রতি বিশেষ সুপারিশে আবার বহিষ্কৃত এই ৬ সদস্যকে পাহারাদার দলে যুক্ত করা হয়েছে।
গাছ ক্রমে কমে যাওয়ায় লাউয়াছড়া বন্যপ্রাণী বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এখানে বন্যপ্রাণীর খাদ্য ঘাটতি রয়েছে প্রচুর। ফলে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে বন্যপ্রাণি। খাদ্য সংকট আর আবাসস্থল নিয়ে হুমকির মুখে ফেলেছে বনের প্রাণিগুলোকে। বর্তমানে লাউয়াছড়া বনকে বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় লন্ডভন্ড করে ফেলা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত পর্যটকরা ভ্রমণে আসছে। অত্যধিক পর্যটক, মাইক আর যানবাহনের উচ্চ শব্দ সবমিলিয়ে পূর্বের মতো জীবজন্তু ও পশু পাখির সচরাচর দেখা পাচ্ছেন না পর্যটকেরা।
লাউয়াছড়া বনবিট কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী) রেজাউল করিম বলেন, স্বল্প জনবল নিয়েই তারা দায়িত্ব পালন করছেন। তবে পর্যাপ্ত লোকবল, অস্ত্রাদি ও যানবাহন সুবিধসহ পর্যটক হ্রাস এবং বন্যপ্রাণির খাবারের ব্যবস্থা করা গেলে এখানে তেমন কোন সমস্যা থাকবে না।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী) মিহির কুমার ধর বলেন , এ বনের একাংশে সামাজিক বনায়নের গাছ নিলামে বিক্রি হয়েছে। এসব গাছ পরিবহনে দেখলে মনে হচ্ছে সংরক্ষিত বনের গাছ পাচার হচ্ছে। তিনি বলেন, আগের চেয়ে গাছ চুরি অনেক কমে গেছে। আর যখনও খবার পান গাছচোরচক্র বনে প্রবেশ করেছে তখনই তাদের প্রতিরোধ করা হচ্ছে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোসাদ্দেক আহমদের সাথে চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে বন্যপ্রাণি বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মিহির কুমার ধর বলেন, তারা নিয়মিত তদারকি করছেন। ইতিমধ্যে বেশকিছু চোরাই গাছ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনাটিও গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখছেন।
বহুমাত্রিক.কম