Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১৩ ১৪৩১, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ভিন্নধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট গার্লস স্কুল

শেখ হেদায়েতুল্লাহ, খুলনা

প্রকাশিত: ১৭:৪৪, ১৭ মার্চ ২০১৯

আপডেট: ১৭:৪৪, ১৭ মার্চ ২০১৯

প্রিন্ট:

ভিন্নধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট গার্লস স্কুল

ছবি : বহুমাত্রিক.কম

খুলনা : প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মানুষের মাঝে দারিদ্রতা রয়েছে। অনেকেই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারে না। পঞ্চস শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক লেখাপড়া হলেও ৬ষ্ট শ্রেণী হতে ছেলেদের স্কুলে দিতে হয় মাসিক বেতনসহ অন্যান্য খাতে টাকা।

মেয়েদের ক্ষেত্রে বেতন দেয়া লাগে না। তারপরও দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকেরা ছেলেদের দেয় কাজে আর মেয়েদের বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। যদিও এখন বাল্য বিয়ের প্রবণতা অনেকটাই কমেছে। এমন এক সমযে জেলার রুপসা উপজেলার এক শিক্ষানুরাগী মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত হোসেন নামে এক শিক্ষানুরাগী মেয়েদের জন্য অবৈতনিক বিশ্ববিদ্যালযের স্বপ্ন নিয়ে গড়ে তোলেন মেযেদের একটি স্কুল। নাম দেন রূপসা উপজেলার ডোমরা গ্রামের বসবাসকারী প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ কমরেড রতন সেনের নামে।

ঘটনাকাল ২০০৯ সাল। ওই বছরেই মাত্র ৩৩ জন মেয়েকে ৬ষ্ট শ্রেণীতে লেখাপড়া শুরু করানোর মধ্য দিয়ে স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। সেই শিক্ষার্থীরাই ২০১৫ সালের এসএসসিতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবেই অংশ নেয়ার সুযোগ পায়। বর্তমানে কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট গার্লস স্কুলে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৭০ জন। এ বছর এই স্কুল থেকে এইচ এস সিতে অংশ নেবে। এইচএসসি প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী রয়েছে ২১ জন।

চলছে মার্চ মাস। দিনের বেলায় প্রচন্ড রোদ আর রাতে শীতের আবহ। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে সিনিয়র সাংবাদিক কালের কন্ঠের খুলনা ব্যুরো প্রধান গৌরাঙ্গ নন্দীর সাথে । মেয়েদের লেখাপড়ায় স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য নিযে গড়ে ওঠা কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট গার্লস স্কুলের কথা আগেও শুনেছি। কিন্তু খুলনা শহরের খুব কাছে হলেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই নন্দীদার প্রস্তাবে স্কুলটি দেখার আগ্রহ ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলার আগ্রহে রওয়ানা হই।

নগরীর জেলখানা ঘাট পার হয়ে পূবদিকের পীচঢালা পথ বেয়ে প্রায় ৭ কিলোমিটার গেলে ছোট একটি বাজার। সেখানে গিয়ে জনৈক চা বিক্রেতার কাছে জানতে চাওয়া হয় স্কুলটি কোথায়। পূর্বেই জেনেছিলাম একটি বাজারের খুব কাছেই বিদ্যালয়টি অবস্থিত।

চা দোকানীর কথামত বাজার থেকে প্রায় ২০০ মিটার এবড়ো- থেবড়ো ইটের সলিংযের রাস্তা পেরিয়ে বিদ্যালয়ের অফিসের সামনে গিয়ে দুজন দাড়াই। এ সময়ে স্কুলের দপ্তরী- কাম নৈশ প্রহরী এগিয়ে এসে পরিচয় জানতে চান। পরিচয় পেয়ে তিনি অফিসকক্ষে নিযে বসতে দেন। সময়টা বেলা সাড়ে ১০টা হবে। এ সময়ে প্রতিটি ক্লাসে পাঠদান চলছিল।

এবার ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায অংশ নিয়েছে হালিমা আক্তার যুথি ও উর্মি খাতুন্ তারা এসছিলেন প্রিয় স্কুলটিতে বেড়াতে। লাইব্রেরিতে কম্পিউটার নিয়ে কাজ করছিল। তারা দুজন ভাল ক্রীড়াবিদও। স্কুলের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় তাদের কাছে। তারা সমস্বেরে জানান আসলে বাসায় মোটামুটি খেয়েপরে চলার সংগতি তাদের রয়েছে। কিন্তু পাঠ্যবাইয়ের পাশাপাশি জ্ঞানভিত্তিক বই তাদের কেনার ক্ষমতা তাদের নেই।

পরিক্ষার পর হাতে অনেক সময় তাই স্কুলে বই পড়তে ও কম্পিউটারের কাজ শিখতে এসেছে। স্কুলের পড়াশোনা সম্পর্কে তারা জানায় পড়াশোনা তার খুব ভালো । স্কুলের পরিবেশ ভালো।

এখানে একটা একাডেমিক ভবনের কাজ শুরু করেছেন শহীদুল্লাহ এসোসিয়েটসের প্রধান প্রকৌশলী শহিদুল্লাহ। তিন তলার কাঠামো হয়েছে। কিন্তু চারদিকের দেওয়াল হয়নি। সেখানেই এখন তিনটা ক্লাশ শিফট করা হয়েছে। এছাড়া বাকী দু্টি ঘর কো হয়েছে – একটি বেড়ার আর একটি গোলপাতার ছাউনি! ওখানেই ওরা পড়ে।

রতনসেনের মূলবাড়িটাতে স্কুলের অফিস, স্যার/ম্যাডামদের বসায় জায়গা, লাইব্রেরি আর বিজ্ঞানাগার। একটি দোচালা ঘর আছে। রান্নাঘরটি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিদিন দুপুরে টিফিনের সময়ে মেয়েরা লাইন ধরে দাড়িয়ে নিজ নিজ প্লেট সংগ্রহ করে ট্যাপের পানিতে ভিম বার দিয়ে পরিস্কার করে খাবার নিয়ে শ্রেণীকক্ষে চলে যায়। সেখানেই খাওয়া।

শুধুমাত্র ভিন্ন ধারায় লেখাপড়ার চর্চা নয় খেলাধূলাও সমান পারদর্শী এই স্কুলের মেয়েরা। জেলা প্রশাসকের স্কুল শিক্ষার্থী হ্যান্ডবল ও কাবাডি দলের সদস্য উর্মি ও যুথি। ২০১১ সালের পর থেকে স্কুল হ্যান্ড বলে মেয়েদের মধ্যে প্রতিবারই উপজেলা চ্যাম্পিয়ান হয় এখানকার টিম। ২০১৭ সাল থেকে কাবাডিতেও তারা সফলতা দেখিয়েছে।

স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি এস এম লিয়াকত হোসেন ২০১৭ সালে মারা গেছেন। তার সম্পর্কে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান স্কুলের দায়িত্ব তাঁর কাছে ছিল নিজের ব্যবসার চেয়েও বড়। তার চেষ্টায় স্কুলটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। এক সমযের জীর্ণ ঘরটি ঝকঝকে তকতকে হয়েছে। দুটি পৃথক ঘর হয়েছে। এর একটি ৬ষ্ট শ্রেনীতে পাঠদান করা হয়।

শিক্ষকেরা দিনে স্কুলে পড়ান আর রাতে নিজেরা দায়িত্ব ভাগাভাগি করে বিভিন্ন গ্রামে ছাত্রীদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে খোঁজখবর নেন হোমওয়ার্ক করতে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। টর্চলাইট নিয়ে তাঁরা গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়েন। টিফিনের সময় লাইন ধরে সবাই থালায় খাবার নিয়ে ক্লাসে বসে খায়। ডালভাত-শাকসবজি। সপ্তাহে একদিন মাছ। স্কুলের জমি ও পুকুর থেকেই আসে টিফিনের খাবারের শাকসবজি ও মাছ।

ছাত্রীরা বাগানে নিজেদের জন্য কাজ করে।সরকারি উপবৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এর বাইরেও রয়েছে এককালীন বৃত্তি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা শুভানুধ্যায়ীরা এসব বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। তা ছাড়া, ইউনিসেফ, ওয়ার্ল্ডভিশন, রোটারি ক্লাব থেকে ছিটেফোঁটা সহায়তা আসে। প্রবাসী শুভানুধ্যায়ীদের সাড়াও মাঝেমধ্যে পাওয়া যায়।

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মানবদরদী, অকৃতদার ও সর্বস্ব ত্যাগী কমরেড রতন সেন ১৯৯২ সালের ৩১ জুলাই খুলনা শহরে প্রকাশ্য দিবালোকে দুস্কৃতিকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। মানব সেবায় তার অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০০৯ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তাঁর বসত ভিটায় ২.০২ একর জায়গায় কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটিকে একটি বিশেষায়িত বিদ্যালয় হিসাবে প্রতিষ্ঠার লক্ষে এগিয়ে চলছে কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট স্কুলটি।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer