রাশিয়া চেক প্রজাতন্ত্রের বিশ জন কূটনীতিককে বহিষ্কার করার কথা ঘোষণা করেছে। চেক প্রজাতন্ত্র ১৮জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারের পর রাশিয়াও এই পাল্টা ঘোষণা দিল। রুশ কূটনীতিকরা ২০১৪ সালে চেক অস্ত্র গুদামে বিস্ফোরণের ঘটনায় গুপ্তচর হিসাবে জড়িত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় দু`জন মারা যান। খবর বিবিসি বাংলা’র
যুক্তরাজ্যে ২০১৮ সালে বিষাক্ত রাসায়নিক নভিচক দিয়ে হামলা যে দুজন রাশিয়ানকে সন্দেহ করা হয় তারা চেক প্রজাতন্ত্রের ওই বিস্ফোরণের ঘটনার সাথেও জড়িত ছিল বলে এখন বলা হচ্ছে। এই অভিযোগ নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়িনের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন।
স্কো চেক কূটনীতিকদের এক দিনের মধ্যে দেশ ছেড়ে যেতে বলেছে। চেক প্রজাতন্ত্র রুশ কূটনীতিকদের দেশ ছাড়ার জন্য ৭২ ঘন্টা সময় দিয়েছে।
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চেক সিদ্ধান্তকে "নজিরবিহীন" এবং "বৈরি পদক্ষেপ" বলে বর্ণনা করেছে। "রাশিয়ার ওপর সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করা যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে চেক কর্তৃপক্ষ তাদের প্রভুদের পদক্ষেপকেও ছাড়িয়ে গেছে," বলা হয়েছে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে।
দাবিগুলো কী?
চেক প্রজাতন্ত্র দাবি করছে এই কূটনীতিকরা গুপ্তচর হিসাবে কাজ করছে। রাশিয়া এই অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং অবাস্তব বলে নাকচ করে দিয়েছে। চেক প্রজাতন্ত্রে ভ্রেবেটিস নামে একটি জঙ্গলের ভেতর অস্ত্রের একটি গুদাম ২০১৪-র ১৬ই অক্টোবর এক বড় বিস্ফোরণে উড়ে যায়।
বিস্ফোরণের ধাক্কায় আশে-পাশের এলাকার বাড়িঘরও উড়ে যায় এবং স্থানীয় স্কুলগুলো খালি করে সবাইকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়। ঘটনাস্থলে আপদকালীন যানবাহন পাঠানো হয়। প্রায় এক মাস পর সেখানে ৫৬ এবং ৬৯ বছর বয়সী দুই ব্যক্তির মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়, যারা ঐ গুদামে কাজ করতেন।
বিস্ফোরণটিকে তখন একটি দুর্ঘটনা বলে ধরে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু চেক কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ দিন ধরে গোয়েন্দা তদন্ত চালিয়ে সন্দেহের আঙুল তোলে রুশ গুপ্তচর সংস্থার ২৯১৫৫ ইউনিটের দিকে।
যুক্তরাজ্যের নার্ভ এজেন্ট সন্দেহভাজনরা কীভাবে জড়িত?
চেক পুলিশ এই বিস্ফোরণের জন্য যে দুই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে - আলেকজান্ডার মিশকিন এবং আনাতোলি চেপিগভ - তাদের বিরুদ্ধে তিন বছর আগে ব্রিটেনের সলসবেরিতে নার্ভ এজেন্ট নভিচক ব্যবহার করে হামলা চালানোর ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
সের্গেই স্ক্রিপাল - যিনি রুশ ডবল এজেন্ট বা দুই পক্ষেরই সাবেক গুপ্তচর - তাকে এবং তার মেয়ে ইউলিয়াকে বিষপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেছিল ২০১৮ সালে। কয়েক মাস পর ডন স্টারজেস নামে স্থানীয় একজন মহিলা একটি পরিত্যক্ত পারফিউমের শিশি ধরার কারণে মারা গিয়েছিলেন - যাতে কিছু নভিচক লেগে ছিল।
অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট বেলিংক্যাট ঘটনার পরপরই জানায় সলসবেরি হামলার সন্দেহভাজন রাসলান বশিরভের আসল পরিচয় আনাতোলি চেপিগফ এবং আলেকজান্ডার পেট্রভের আসল পরিচয় আলেকজান্ডার মিশকিন এবং এরা দুজনেই আসলে রুশ গুপ্ত সংস্থা জিআরইউ`র অফিসার।
ব্রিটেনের সলসবেরি বিষপ্রয়োগের ঘটনার সাথে জড়িত দুই অভিযুক্তের ছবির সাথে চেক বিস্ফোরণে সন্দেহভাজনদের ছবি মিলিয়ে দেখে চেক পুলিশ। ওই গুদাম পরিচালনা করত আইমেক্স নামে যে সংস্থা তাদের কাছে ইমেলে পাঠানো পাসপোর্টের ছবি থেকে পুলিশ সূত্র খুঁজে পায়।
দাবি করা হয় ইমেলটি এসেছে `ন্যাশানাল গার্ড অফ তাজিকিস্তান`এর কাছ থেকে। এতে ওই দুই ব্যক্তিকে পর্যবেক্ষণের জন্য গুদামের সাইটে ঢোকার অনুমতি দেবার কথা বলা হয়। তাদের পাসপোর্টের স্ক্যান ইমেলের সাথে পাঠানো হয় অ্যাটাচমেন্ট হিসাবে। বলা হয় এদের একজন রাসলান টাবারফ যিনি তাজিকিস্তানের এবং অন্যজন মলডোভার নাগরিক নিকোলাজ পপা।
ওই দুই ব্যক্তির পাসপোর্ট ছবির সাথে ব্রিটেনের সলসবেরি হামলায় অভিযুক্ত দুই ব্যক্তির ছবির মিল দেখা যায়। এই দুই ব্যক্তি ১৩ই অক্টোবর ২০১৪য় চেক অস্ত্র গুদামের কাছে অসট্রাভায় একটি বাসায় থাকার জন্য জায়গা বুক করেন। সেখানে তাদের ১৭ই অক্টোবর পর্যন্ত থাকার বুকিং ছিল।
বিস্ফোরণ ঘটে ১৬ই অক্টোবর। এবং ঐদিন ওই দুজন ব্যক্তি অস্ট্রিয়া চলে যান। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিমানবন্দর থেকে তারা বিমানে মস্কো যান। কর্তৃপক্ষ জানতে পারেনি ঠিক কীভাবে ওই অস্ত্রের গুদাম উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।
ওই অস্ত্রের গুদামকে কেন টার্গেট করা হয়ে থাকতে পারে?
চেক মিডিয়া অজ্ঞাতনামা তদন্তকারীদের বরাত দিয়ে খবরে বলেছে, ওই গুদামে মজুত রাখা অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ পাঠানোর লক্ষ্য ছিল হয় রুশ-পন্থী বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধরত ইউক্রেনিয়ান বাহিনী, নয়ত সিরিয়ার যেসব বিদ্রোহী রুশ সমর্থনপুষ্ট সরকারি সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে - তাদের কাছে।
অস্ত্রের ওই গুদামে দুটি বিস্ফোরণ হয়। প্রথমটি হয় ১৬ই অক্টোবর যখন গোলাবারুদের মজুতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং দ্বিতীয়টি হয় ৩রা ডিসেম্বর। সেটি হয় দেড়শ মিটার (৫০০ফুট) দূরে একটি ভবনে যেখানে কামানের গোলাবারুদ এবং সাবমেশিনগান মজুত ছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে বিবিসি জেনেছে, ওই গুদামে যারা অস্ত্র মজুত করেছিল তাদের একজন বুলগেরিয়ার অস্ত্র ব্যবসায়ী এমিলিয়ান গেবেরেভ।
চেক বিস্ফোরণের ছয় মাস পর, ২০১৫র এপ্রিল মাসে মি. গেবেরেভ বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়াতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে এক মাস থাকার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু তিনি আবার অসুস্থ হন। তার অসুস্থতা নিয়ে নানাধরনের সন্দেহ প্রকাশ করা হলেও বুলগেরিয়ান কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে বেশি দূর এগোয়নি। বলা হয়েছিল এটা মামুলি ফুড পয়জনিং-এর ঘটনা।
সলসবেরিতে ২০১৮-র ঘটনার পর তার অসুস্থতা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়। জিআরইউ-র দুজন কর্মকর্তা ছাড়াও সের্গেই ফেডোটভ নামে তৃতীয় আরেক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যিনি সলসবেরি নভিচক হামলার ওপর নজরদারির জন্য ব্রিটেনে আসেন। মি. গেবেরেভ যখন বুলগেরিয়াতে অসুস্থ হন, তখন এই মি. ফেডোটভ বুলগেরিয়াতে ছিলেন।
এর পরে কী হবে?
চেক প্রজাতন্ত্র নেটো এবং ইইউ জোটকে তাদের সন্দেহের কথা জানাবে। সোমবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন চেক প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইয়ান হামাচেক। আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে "চেক প্রজাতন্ত্রের মাটিতে রাশিয়ার অন্তর্ঘাতমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠোর জবাব দেবার ব্যাপারে" তারা চেকদের পাশে রয়েছে।
এ সপ্তাহের গোড়ার দিকে আমেরিকা ১০জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে - গত বছর "সোলার বিদ্যুত" ব্যবস্থা হ্যাক করার, ইউক্রেনকে হুমকি দেবার এবং ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনে।