Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

আষাঢ় ২৭ ১৪৩২, শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫

কিউ কে আহমদ: অভিবাদন, হে প্রান্তজনের সখা!

ম. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ১৬:৫৩, ৭ মে ২০১৯

আপডেট: ১৭:০৩, ৭ মে ২০১৯

প্রিন্ট:

কিউ কে আহমদ: অভিবাদন, হে প্রান্তজনের সখা!

-ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। ছবি- সংগৃহীত

ঘুরে ফিরে লুঙ্গিনেসের সেই কথাটিই মনে পড়ে ‘শিল্প’ ভিতর থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখে’। এই লুকিয়ে থাকা শিল্প সত্ত্বা শিল্পী যা তার চেয়েও অনেক বড়। এ এক মস্ত বড় চেতনা, এক নতুন আবিস্কার-এক নতুন উদ্বোধন। এ সত্য ব্যক্তি-মনের আবিস্কার-মন চর্চারই ফসল। এই ফসলের মূল উৎস ব্যক্তির স্বাতন্ত্র মানবতাবোধ, মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনা। এই ভাবনার মূল সত্ত্বা পিছিয়ে থাকা, পিছিয়ে পড়া কিংবা পিছিয়ে রাখা সমাজ ব্যবস্থার নাভিমূলে কৃমির মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে লুকিয়ে থাকে।

এই লুকিয়ে থাকা সত্ত্বার এক অনন্য ধারক দেশের উন্নয়ন অর্থনীতির এক ঋদ্বিমান পুরুষ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। যিনি কিউ কে আহমদ নামে দেশে সুপরিচিত। যার নামের উচ্চারণ আমাদের বক্ষ স্ফীত করে, শির উন্নত করে। তিনি, তাঁর কর্ম ও রচনা ত্রিমাত্রিক ধারায় বিচিত্র, বর্ণিল এবং ব্যতিক্রমধর্মী। কিউ কে আহমদ এর বহমান সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের দৃষ্টি ও সৃষ্টি অনুপম এবং তাঁর মানবকেন্দ্রিকতা মুক্তিযোদ্ধ, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক এবং দেশের প্রান্তজনের চেতনার সাথে বরাবরই আপোষহীন।

এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ এবার সমাজসেবায় ভূষিত হলেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ এ। তোমাকে অভিবাদন, হে প্রান্তজনের সখা!
কিউ কে আহমদ ১৯৪৩ সালের ১২ মার্চ তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির আসামের (বর্তমান বাংলাদেশ) সিলেট জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুমতাজুল মুহাদ্দিসিন মাওলানা মোঃ মুফাজ্জল হুসাইন ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আসামের এমএলএ এবং পরবর্তীতে কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।

আহমদ এর শিক্ষার হাতে-খড়ি তাঁর পিতার কাছে এবং অস্টম শ্রেণি পর্যন্ত তাঁর পিতার কাছেই তিনি পাঠ গ্রহণ করেন। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৬১ সালে স্নাতক ও ১৯৬২ সালে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকস থেকে জাতীয় মেধা ফেলোশিপ লাভ করেন এবং সেখান থেকে অর্থনীতি বিষয়ে এমফিল এবং একই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। আহমদ ১৯৬০ এর দশকে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রচারণায় সক্রিয় ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বিজয় অর্জন পর্যন্ত মুজিবনগর সরকারের অধীনে পরিকল্পনা সেলে কর্মরত ছিলেন। তাঁর দাম্পত্য সঙ্গী ড. জাহেদা আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।

কিউ কে আহমদ এর কর্মময় জীবনের ২৩ বছর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এবং এর পূর্বতন পাকিস্থান ইনস্টিটিউট অফ ডেভলপমেন্ট ইকোনোমিক্সে (পিআইডিই) গবেষণা পেশায় এবং কয়েক বছর উক্ত প্রতিষ্ঠানে গবেষণা পরিচালক হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ১৯৮৭ সালে বিআইডিএসের গবেষণা থেকে ইস্তফা দেন এবং ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন এবং সেখানে তিনি নির্বাহী প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।

তিনি ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে ‘পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউ-েশন’ (পিকেএসএফ) এর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদ লাভ করেন এবং অদ্যাবধি এ পদে তিনি নিষ্ঠতার সাথে দ্বায়িত্ব করছেন। তিনি ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকস প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং বর্তমানে এর গভার্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। তিনি ২০০২ থেকে এপ্রিল ২০১০ সময়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির পরপর তিনবার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে কিউ কে আহমদ স্বাধীন দেশের প্রথম সর্বজননন্দিত শিক্ষানীতির অন্যতম প্রধান রূপকার।

জলবায়ু বিপর্যয়ের দরিদ্র দেশসমূহের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর, উন্নয়নশীল দেশে সহস্রাব্ধ উন্নয়ন লক্ষ বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন সামনের সারির একজন চিন্তক। তিনি ইতোমধ্যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দৃঢ় প্রবক্তা হিসেবে দেশ-বিদেশে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য’ অর্জনে দেশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। এই গণদরদী ও প্রগতি চিন্তায় বিশ্বাসী কিউ কে আহমদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দারিদ্রবিমোচন ক্ষেত্রে গবেষণা এবং অন্যন্য ক্ষেত্রে অসামন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৯ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন।

তিনি ২০০৭ সালে শান্তিতে নবেল পুরস্কার বিজয়ী জাতিসংঘ আন্ত:রাষ্ট্রীয় জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল (ওচঈঈ) এর সদস্য হিসেবে ঐ পুরস্কারের অংশীদার। তিনি বর্তমানে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের গঠনতন্ত্রের বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তি দলের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ২০১৫ পূর্ব টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার জাতিসংঘের ওপেন ওয়ার্কিং গ্রুপে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। এছাড়া তিনি কিয়োটা প্রোটোকল-এর এক্সিকিউটিব বোর্ড অফ ক্লিন ডেভলপমেন্টের সদস্য হিসেবে নন-অ্যানেক্স-১ দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন।

কিউ কে আহমদ শুধু বৃত্তাবদ্ধ সমাজ-অর্থনীতি কিংবা উন্নয়ন-অর্থনীতির একজন ভাবুক নন, তিনি একীভূত সমাজ বির্নিমাণের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক মানুষের মানবমর্যাদা সুপ্রতিষ্টিতকরণের এদেশের একজন মূল প্রবর্তক। প্রথাগত চিন্তনের সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে তিনি গ্রামবাংলার কৃষি, কৃষক, কৃষিশ্রমিক সাধারণত মানুষ তথা প্রান্তজনের অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নের সাথে মানবিক উন্নয়নের যোগসূত্র স্থাপন করেছেন; যাতে সমাজে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর মানবমর্যাদা প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা যায়। এ লক্ষ্যে বিগত পাঁচ বছরেরও অধিককাল ধরে তিনি পিকেএসএফ-এর মূল কার্যক্রমের আওতায় ‘সমৃদ্ধি’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। যার মূল প্রতিপাদ্য মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন।

সব ধরণের উন্নয়নের মূলে থাকবে মানুষ। যেহেতু উন্নয়ন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া; এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে উন্নয়নকে সম্পৃক্ত না করলে উন্নয়ন টেকসই হয় না, সেজন্য স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদকে এ কার্যক্রমে সরাসরি সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলা চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্যকে অবহিত রাখা হয়েছে। মানুষকে কেন্দ্র করে এ উন্নয়ন প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে অগ্রগামী হবে আজ এবং আগামীর। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ৭৫ বছরের এই তরুণ বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের উন্নয়নে বহুমুখী উদ্যোগ ও ভাবনার খোরাক ছড়িয়ে দিয়েছেন। কী উন্নয়ন বিষয়বস্তু, কী নতুন ভাবনায়, কী কৌশলিক বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া-সবদিক থেকেই তিনি আজ অনেকটাই আন্তর্জাতিকভাবে একজন নতুন ঘরনার উন্নয়ন চিন্তকের প্রতিস্পর্ধী।

কিউ কে আহমদ- এর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দেশে বিদেশে প্রকাশিত এ পর্যন্ত তাঁর (একক বা অন্যদের সঙ্গে যৌথভাবে) উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে লেখা ও সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা ৩৫টিরও অধিক এবং গবেষণা প্রতিবেদনসহ তাঁর প্রবন্ধের সংখ্যা আড়াই শতাধিক। তিনি এশিয়া প্যাসিফিক জার্নাল অন ইনভায়রনমেন্টাল এ- ডেভলাপমেন্ট এর সম্পাদক।

তাঁর খ্যাতনামা প্রকাশনাগুলোর মধ্যে ট্যাকলিং সোশ্যাল এক্সক্লুশন: সাউথ এশিয়া, ইন্টারলিংকিং অফ রিভারস ইন ইন্ডিয়া: ইস্যুজ অ্যান্ড কনসান্র্স, সোশিও-ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডেটনেস-রিলেটেড ইমপ্যাক্ট অফ মাইক্রো-ক্রেডিট ইন বাংলাদেশ, ইমার্জিং ইকোনমিক অর্ডার অ্যান্ড দ্য ডেভলপিং কান্ট্রিজ, ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ওয়াটার রিসোর্সেস ইন সাউথ এশিয়া, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা রিজিয়ন: অ্যা ফ্রেমওয়াার্ক ফর সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট, দ্য ইমপ্লিকেশন্স অফ ক্লাইমেট অ্যান্ড সী-লেভেল চেঞ্জ ফর বাংলাদেশ এবং রুরাল পোভার্টি অ্যালিভেশন ইন বাংলাদেশ এক্সপেরিয়েন্সেস অ্যান্ড পলিসিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র-এই ত্রিমাত্রিক বিষয় একই অর্থনৈতিক যোগসূত্র গ্রোথিত। দেশের বিস্তৃত পরিপ্রেক্ষিত থেকে এর একটাকে অন্যটার থেকে পৃথক করে দেখলে এবং সে খণ্ডিত দেখার ওপর নির্ভর করে উন্নয়ন পরিকল্পনা রচিত হলে তা কখনো দেশের সামগ্রিক উন্নতি ও অগ্রগতির সহায়ক অনুসঙ্গ হতে পারে না। কিউ কে আহমদ এই ত্রিমাত্রিক অনুঘটনক একসূত্রে গেঁথে অবিরাম স্বপ্ন দেখেন এ দেশ হবে একদিন প্রত্যেক মানুষের মানবমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধ চেতনায় সম্বৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

লেখক: উপ-প্রকল্প সমন্বয়কারী (প্রশিক্ষণ), পিকেএসএফ।

বহুমাত্রিক.কম