
-লেখক
বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংযোগ যে হারে বেড়ে চলেছে তা এক কথায় অসামান্য। বিশেষ করে ব্যবসা-বানিজ্য, স্বাস্থ্য , শিক্ষা ও পর্যটন ক্ষেত্রে যে মাত্রায় কানেক্টিভিটি প্রতিনিয়তই বাড়ছে তা দুদেশের মানুষে-মানুষে যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ করার নতুন নতুন সুযোগ করে দিচ্ছে। তবে এই সংযোগ আরও জোরদার করার জন্য আমাদের অখন্ড সাংস্কৃতিক সম্পদের ওপর ভরসা করতে পারলে চলমান সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পারদ আরও উঁচুতে তোলা মোটেও অসাধ্য মনে হয় না আমার কাছে।
আমাদের রয়েছে অখণ্ড সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস। আছে সমন্বিত অর্থনীতির প্রসারের ঐতিহ্যবাহী অখন্ড রেল, সড়ক ও জলপথ। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর থেকে আমাদের যোগাযোগ অবকাঠামোই শুধু বিঘ্নিত হয়েছে তাই নয়, আমাদের দুই পড়শি দেশের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের হিরন্ময় সময়ে যেভাবে দুই দেশের মানুষে-মানুষে সংযোগ ঘটে তা আসলেই অভাবনীয়। সেই সময়ের ভারতীয় সমাজ, সরকার, সেনাবাহিনী, সংসদ, সাংস্কতিক ব্যক্তি ও সংগঠন যেভাবে মুক্তিকামী বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তা ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়।
কোটি খানিকেরও বেশি মানুষের থাকা খাওয়া ব্যবস্থা করা ছাড়াও মহিয়সী নেত্রী প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর সরকার ও বিরোধী দলযেভাবে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত বাঙালির পাশে এসে দাড়িয়ে ছিলেন তা সত্যি ভাষায় বর্ননা করা মুশকিল। পাশাপাশি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রাণরক্ষা এবং শত্রুর জেল থেকে তাঁর মুক্তির জন্য যেসব উদ্যোগ ভারতের সরকার, বুদ্ধিবৃত্তিক তথা নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম যে ঐকিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে তার জন্য বাংলাদেশের মানুষ গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আর কৃতজ্ঞ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেই সব বীর সেনানীদের প্রতি যারা বাংলাদেশের মাটিতে শহীদ হয়েছেন, যারা তাদের অঙ্গ হারিয়েছেন এবং অন্যান্য সবাই যারা জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছেন। তাদের রক্ত এবং আত্মত্যাগের ঋণ আমরা কোনোদিনই শোধ করতে পারবো না। মুক্তিযুদ্ধের এই মহিমান্বিত অভিজ্ঞতাও আমাদের দুই দেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক সম্পদ।
তাছাড়া বঙ্কিম, তারাশংকর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনান্দ, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সন্যাল, সুচিত্রা, সাবিত্রী, মৃনাল সেন, সত্যজিৎ, অমর্ত্য সেন, শামসুর রাহামান, আল মাহমুদসহ দুই বাংলার অগুনতি শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা আমাদের দুই দেশের অখণ্ড ঐতিহ্যিক সম্পদ। আর রবীন্দ্রনাথ তো দুদেশের জাতীয় সঙ্গিতের রচয়িতা হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সাংস্কৃতিক সম্পদের উজ্জ্বল এক প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যিক সম্পদে পরিণত হয়েছেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশ সহ পুরো ভারতবর্ষের উজ্জ্বলতম বিপ্লবী নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। এছাড়া ঔপনিবেশিক শাষন ও শোষন থেকে মুক্তির পরিপ্রেক্ষিত তৈরির জন্য্য গান্ধীজী, নেহেরু, আবুল কালাম আজাদ, চিত্তরঞ্জন দাশ, শরদ চন্দ্র বসু, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, শেরে বাংলা ফজলুল হক, আবুল হাশিম, মৌলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যান্য রাজনীতিকদের অনন্য অবদানের কথা স্মরনীয়।
তবে ভাষাগত, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক, সংস্কৃতিসহ জীবনাচারের নানা ক্ষেত্রে অভিন্নতা থাকলেও স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি পেরিয়ে চিরবন্ধুপ্রতীম ভারতের সঙ্গে জনগণের সৌভাতৃত্বের জায়গাটি মুক্তিযুদ্ধকালের মতো নিরঙ্কুশ সম্প্রীতির সহাবস্থানে অটুট আছে একথা জোর দিয়ে বলতে পারছি না। এই বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়াই ভালো। কিন্তু ঐতিহ্যিক এসব সম্পদ এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি মানসপটে। সেখান থেকে সম্ভাব্য মণি-মানিক্য সংগ্রহ করে নিশ্চয় আমরা আমাদের নিজ নিজ সমাজের ও দেশের আত্মশক্তির ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে পারি আগামী দিনের সমৃদ্ধ জীবনচলার সন্ধানে।
বাংলাদেশ-ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদ এই প্রেক্ষাপট মনে রেখেই বিষয়টি অনুধাবন করে বন্ধুপ্রতীম দু’দেশের মধুর মৈত্রী ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্কের পরম্পরা এবং সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের পুনর্জাগরণে এক মহতি প্রয়াস নেয়। সংগঠনটি সচেতনভাবে অনুভব করে, দুই দেশের জনগণের সম্পর্কের যে ভিত প্রীতিপূর্ণ সামস্কৃতিক সম্পদের পাটাতনের ওপর বহু কাল আগে থেকেই রচিত হয়েছ, তার গভীরে ছিল মূলতঃ আমাদের মুক্তিসংগ্রামে যুগপৎ লড়াইয়ের পরম্পরা। আগেই উল্লেখ করেছি পরাধীন মাতৃভূমির শৃঙ্খল মুক্তির জন্য দেশপ্রেমিক দামাল ছেলেমেয়েরা সব ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে লড়াই করেছিলেন ঔপনিবেশিক ও নব্য ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে। ভাষা ও সংস্কৃতিগত অভিন্নতার বাইরে এই বিষয়টি দুই দেশকে এক নিবিড় বন্ধনে চিরকালের জন্য এক করেছে। রক্তের আখরে লেখা এই সম্পর্কের দৃঢ় বন্ধন এরই মধ্যে অমরত্ব লাভের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুই দেশের জনগণের মাঝে এই সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করতে হলে অবশ্য আমাদের মুক্তিসংগ্রামে লড়াইয়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ঐতিহ্যকে স্মরণ করতে হবে। সেইসঙ্গে অভিন্ন সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমগুলোকে উদযাপনের বড় উপলক্ষ্যে আড়ম্বরের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে। এই লক্ষ্যে ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের প্রাঙ্গন থেকে যাত্রা করা বাংলাদেশ ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুই পুরোধা পুরুষের নামের ‘নেতাজী-বঙ্গবন্ধু জনচেতনা যাত্রা’ শুরু হয়।
ইতিহাসের এই অভিন্ন আখ্যানে বাঙালির অখণ্ড গৌরবকে তুলে ধরতে এই জনচেতনা যাত্রা বাংলাদেশ ও ভারতের প্রত্যন্ত জনপদে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবন ও কর্মের নানা অকথিত অধ্যায়ের অন্বেষণ করে চলেছে গেল দু’বছর ধরে। তরুণ ইতিহাস গবেষক আশরাফুল ইসলামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই জনচেতনাযাত্রাকে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রী পৃথকভাবে স্বীকৃতিদান করে দুই দেশের জনগণের সেতুবন্ধন রচনার প্রয়াসকে প্রেরণা দান করে। ভারতের রাজধানী দিল্লিতে এই জনচেতনা যাত্রার একটি আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টানতে এই চেতনাযাত্রা বাস্তবায়ন কমিটি বার বার প্রচেষ্টা চালালেও করোনাকালের বিধিনিষিধে তা আটকে যায়। তবে দুই দেশের ইতিহাস পিাপসু উদ্যোমী তরুণদের ঐকান্তিকতায় এই আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির ক্ষণ চূড়ান্ত হয় সম্প্রতি। বাঙালি তথা এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের উৎসব বাংলা বর্ষবরণের সময়টিকে বেছে নেওয়া হয় জনচেতনা যাত্রার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির এক বর্ণাঢ্য আয়োজনের জন্য।
ভারতের রাজধানী দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক এভিনিউ’র বিপিনচন্দ্র পাল ট্রাস্ট মিলনায়তনে গত ১৪-১৬ এপ্রিল ২০২৩ অবশেষে বহুল কাঙ্খিত এই অনুষ্ঠানের বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। উল্লেখ্য এই বিপিনচন্দ্র পাল বাংলাদেশের হবিগঞ্জের সন্তান। অনুষ্ঠিত ‘নেতাজী-বঙ্গবন্ধু জনচেতনা যাত্রা’র তিন দিনব্যাপী সমাপ্তির মহাআয়োজন ও বাংলা নববর্ষবরণে দুই দেশের জনগণের সেতুবন্ধন রচনার যে অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল নিশ্চিতভাবেই তা পূরণ হয়েছে। কেননা এই আয়োজনে দিল্লিবাসী বাঙালি ছাড়াও হিন্দিসহ ভারতের প্রতিনিধিত্বশীল অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষেরাও যোগ দিয়ে এই আয়োজনকে অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহংতি জানিয়েছে। আমার বড়ই সৌভাগ্য যে তিন দিনের আনুষ্ঠানিকতায় আমি সার্বক্ষণিকভাবে যোগদান করতে পেরেছিলাম। সমাপ্তি অধিবেশনের সভাপতিত্ব করা ছাড়াও আমি প্রতিটি সেমিনারে আলোচক হিসেবে যোগদান করেছিলাম। একটিতে ছিলাম প্রধান অতিথি। এসব অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাই-কমিশনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা এবং ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি। প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সাবেক সভাপতি গৌতম লাহিড়িও যোগ দিয়েছিলেন একটি অধিবেশনের বক্তা হিসেবে।
অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ইকোনমিক এডভাইসরি কাউন্সিল ও নীতি আয়োগের চেয়ারম্যান (পদমর্যাদায় ক্যাবিনেট মিনিস্টার) এবং আমাদের হবিগঞ্জের আরেক কৃতিসন্তান ড. বিবেক দেবরায়, ভারতের বিশিষ্ট সমর বিশেষজ্ঞ ও ‘একাত্তরের মিত্রবাহিনী’ বিষয়ক গবেষক মেজর জেনারেল (অবঃ) ড. পি কে চক্রবর্তী, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন মেমোরিয়াল সোসাইটির সভাপতি রিভা গাঙ্গুলী দাশ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য ড. দেলোয়ার হোসেন, দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশনারের চলতি দায়িত্বে থাকা ডেপুটি হাই-কমিশনার মোঃ নুরুল ইসলাম, মিনিস্টার (কনস্যুলার) সেলিম মোঃ জাহাঙ্গীর, মিনিস্টার (প্রেস) শাবান মাহমুদসহ বিশিষ্টজনরা। আয়োজনে অসাধারণ অভিনয় মুগ্ধতা ছড়িয়ে দুই দেশের জনগণকে অতীত ইতিহাসে ফিরিয়ে নিয়ে যায় বাংলাদেশের শীর্ষ নাট্যদল ঢাকা পদাতিক। নাট্যজন নাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে এই নাট্যদল দিল্লির মিলনায়তনে হাজির করে ‘ট্রায়াল অব সূর্যসেন’ নামের এক ঐতিহাসিক নাটক।
জনচেতনা যাত্রা যে চেতনাকে দুই দেশের পথে পথে ফেরি করে ফিরেছে গেল দু’বছর তার সার্থক সমাপ্তির জন্য ‘ট্রায়াল অব সূর্যসেন’ ছিল সার্থক নির্বাচন। নাটকটির দু’দফা প্রদর্শনের মাধ্যমে মুক্তিসংগ্রামের অভিন্ন চেতনাকে সাংস্কৃতিক মাধ্যমে তুলে ধরার এই প্রয়াসকে অসামান্য নজির সৃষ্টিকারী ঘটনা বললেও অত্যুক্তি হবে না। স্বাধীনতার বেদীমূলে দেশমাতার প্রিয় সন্তান বীর সূর্যসেনের আত্মত্যাগের মর্মস্পর্শী আখ্যান দিল্লির ওই মিলনাতয়ন ছাপিয়ে সাধারণের মাঝে অখণ্ড সাংস্কৃতিক সম্পদের অংশবিশেষ আমাদের মর্মান্তিক এবং একই সঙ্গে বৈপ্লবিক ইতিহাসের দৃশ্যপটকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে, তাতে সামান্য সন্দেহ নেই। আয়োজনে ময়মনসিংহ গীতিকার মহুয়ার পালা, দিল্লির স্থানীয় সংগঠন রবি গীতিকার রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ‘বসন্ত’, ‘সপ্তক’র সমবেত সঙ্গীত, বাংলাদেশের বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী শর্মিলা ব্যানার্জী ও তাঁর প্রতিষ্ঠান নৃত্যনন্দনের পরিবেশনা এবং বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী লিলি ইসলামের একক পরিবেশনা আয়োজনকে পূর্ণতা দিয়েছে।
সমাপনী আয়োজনে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করে ড. বিবেক দেবরায় তাঁর আবেগঘন এক অতিভাষণে সমকালকে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রান্তিকাল উল্লেখ করে সেই সংকট উত্তরণে এই ধরণের প্রচেষ্টাকে জাতীয় কর্তব্য পালনের সমান গৌরবদান করেছেন। ড. দেবরায়ের এই মূল্যায়নের মাধ্যমেই এই আয়োজনের সার্থকতাকে খোঁজে পাওয়া যাবে। সভাপতির ভাষণে আমি দুই দেশের ক্রমবর্ধমান বনিজ্যিক সহযোগিতার পাশাপাশি চলমান ভূ-রাজনৈতিক সংকটে দুই দেশের নেতৃত্বকে সমন্বিত কৌশলগত স্মার্ট কূটনৈতিক তৎপরতার আহবান জানাই।
আসন্ন জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানানোর ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। প্রসরমান নৌপথ, সমুদ্রপথ ও রেলওয়ে কানেক্টিভিটির পাশাপাশি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য খাতে উপযুক্ত দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধির জন্য সফট কানেক্টিভিটির ওপর জোর দেই। গ্লোবাল সাউথের সবচেয়ে সক্রিয় প্রতিনিধি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই সম্মেলনে শুধু বাংলাদেশের নয় পুরো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিকাশমান দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নের জন্য সবার সাথে বন্ধুত্বের জন্য নির্বিরোধ শান্তিময় ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য জলবায়ু সহিঞ্চু মানবিক নীতি-আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরার সুযোগ পাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছি।
এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদের ওপর নিঃসন্ধেহে বহু কর্তব্য প্রবর্তিত হয়েছে, একথা দ্ব্যর্থহীন ভাবেই বলা যায়। মূখ্যতঃ দু’দেশের অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির পরম্পরাকে এক নিরঙ্কুশ ঐক্য এবং সংহতির মিনারে পৌছে দিয়ে ইতিহাসঘনিষ্ট এই ধরণের সংগঠনের এ ধরণের চমকপ্রদ আয়োজন অব্যাহত রাখতেই হবে। কেননা এই সব আয়োজনই কেবল পারে, আমাদের অখণ্ড গৌরবের এবং সাংস্কৃতিক সম্পদের পুনর্জাগরণ ঘটাতে। এবং বিষয়টিতে দু’দেশের যত বেশি সংখ্যক জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে, বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের বিদ্যমান চমৎকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বুনিয়াদ এক টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হবে। দিনশেষে, দুই দেশের জনগণের নৈকট্য বাড়লেই সরকারগুলোর নানামুখি প্রচেষ্টা কার্যকর হয়ে উঠবে। তাতে করে আমাদের ঐতিহ্যিক পরম্পরায় প্রাপ্ত, অসাম্প্রদায়িক, বিভেদমুক্ত, সমৃদ্ধ-মানবিক উপমহাদেশ নিশ্চিত হবে। সূচিত হবে প্রগতির সমাজ বিনির্মাণে বহুদিনের কাঙ্খিত জয়যাত্রা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ এখন স্বাস্থ্য সেবা ও পর্যটনের জন্য ভারত ভ্রমণ করছেন। বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাসের কেন্দ্রীয় ও ঢাকার বাইরের ভিসা কেন্দ্রসমূহ প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ভিসার ব্যবস্থা করছে। তাছাড়া সীমান্ত হাটগুলোতেও দু’দেশের মানষ শুধু পণ্যই বিনিময় করছেন না। তারা সম্প্রীতিও বিনিময় করছেন। একজন আরেকজনের সুখ-দুঃখও ভাগ করে নিচ্ছেন। মানুষে মানুষে এই যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক সংযোগ মিলে উভয় দেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের পরিসরে সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে সাহায্য করবে। আর চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটকালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিচারে এই অঞ্চলের তথা বিশ্বের অন্যতম দুটো প্রবল গতিময় দেশ হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির সোপানে- সেই প্রত্যাশাই করছি।
লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক