ছবি: ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশন
কৃষিতে সবুজ বিপ্লব শুরুর আগের কথা। এই অঞ্চলে চাষাবাদ হতো একধরণের খাদ্যশস্য। অঞ্চলভেদে নানা নামে পরিচিত হলেও কৃষি বিজ্ঞানে এটি মিলেট নামে অন্তর্ভূক্ত। ১৫ প্রজাতির এই খাদ্যশস্য সবুজ বিপ্লবের ধাক্কায় ধান, গম কিংবা ভুট্টার মতো এই সময়ের প্রধান শস্যের আধিক্যে হারিয়ে যেতে থাকে। যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এটি এখনো চাষাবাদ হচ্ছে এবং দেশটির খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় বিরাট অবদান রাখছে। এখানকার প্রকৃতিতে বহু পুরনো এই শস্যের অসংখ্য ইতিবাচক দিকের মধ্যে এর পুষ্টিগুণ এবং বৈরী পরিবেশে উৎপাদন সক্ষমতাকে সর্বাগ্রে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিশেষ করে অতি খরার মতো পরিবর্তিত জলবায়ুর অভিঘাতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকা এবং ফলনে প্রভাব না পড়ার সক্ষমতা একে ধান, গম, ভুট্টা বা অন্য শস্য থেকে আলাদা করে পরিচয় দিয়েছে। বিশেষ করে মিলেটের অতি পুষ্টিগুণ একে রীতিমতো সুপারফুডের মর্যাদা এনে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের সঙ্গে লড়াই করা বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের মধ্যে সম্ভাবনাময় এই খাদ্যশস্যের চাষ সম্প্রসারণের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোববার আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ উদ্যাপনে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশন আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে বিশেষজ্ঞরা এই তাগিদ দেন। আয়োজনে যোগ দিয়ে বহু পুরনো এই শস্যটির চাষ সম্প্রসারণে সম্ভাবনার কথাও শোনান খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) প্রতিনিধি রবার্ট ডি. সিম্পসন। অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তা ছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মির্জা হাসানুজ্জামান।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা তাঁর বক্তব্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পুষ্টিকর খাদ্য জনপ্রিয়করণ, টেকসই কৃষির প্রচার ও কৃষকদের আর্থিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে মিলেট-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিলেট-সংক্রান্ত বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবহারিক জ্ঞান বিনিময়, সর্বোত্তম অনুশীলনের আদান-প্রদান এবং গবেষণা ও উন্নয়ন উদ্যোগে সহযোগিতা করার প্রচুর সুযোগ রয়েছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো কৃষি সহযোগিতা। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই এই দুই দেশের জন্য একটি উজ্জ্বল ও আরও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে মিলেট-এর শক্তিকে কাজে লাগানোর পথে নেতৃত্ব দিতে পারে।
প্রদর্শনীর প্রধান অতিথি খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার বাংলাদেশের কৃষি খাতে রূপান্তর এবং মিলেট উৎপাদন ও এর ব্যবহার বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘ভাতের নামে আমরা যে কার্বহাইড্রেড খাচ্ছি তাতে কোনো পুষ্টিগুণ নেই। কেননা চাল চিকন করতে গিয়ে এর সব গুণাগুণই আমরা ফেলে দিচ্ছি। তাছাড়া ধান উৎপাদনে যে পরিমাণ সেচ দিতে হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তা কত দিন সম্ভব হবে তা বলা কঠিন। তিনি আরও বলেন, পরিবর্তিত জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মিলেটের মতো শস্য উৎপাদনের সম্ভাবনা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা-দুইই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বহু শতক ধরে মিলেট আমাদের খাদ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাস্থ্যগত উপকারিতার দিকটি ছাড়াও, কম জল ও স্বল্প প্রয়াসের কারণে পরিবেশের জন্যও মিলেট শ্রেয়। সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে, এবং সারা বিশ্বে মিলেট উৎপাদন ও এর ব্যবহার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে, ভারত সরকারের অনুরোধে জাতিসংঘ ২০২৩ সালকে আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মির্জা হাসানুজ্জামান অনুষ্ঠানে গবেষণা উপাত্ত তুলে ধরে বলেন, ‘খরাসহিষ্ণু হওয়ায় বাংলাদেশে মিলেট চাষ নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে। বিশেষ করে অতি পুষ্টিকর এই শস্য আমাদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে পুষ্টি নিরাপত্তাতেও বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’
‘সবুজ বিপ্লবের পূর্বে এ অঞ্চলে মিলেটের বিভিন্ন প্রজাতি চাষাবাদ হওয়ায় এই শস্যের চাষ সম্প্রসারণ সহায়ক হবে। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এনিয়ে একটি গবেষণাও করেছে। ভারতের সহযোগীতা নিয়ে এটি সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিতে পারলে খাদ্য নিরাপত্তায় আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা এগিয়ে থাকব’-যোগ করেন ড. হাসানুজ্জামান।