Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৩ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

আগুনে পুড়লো পাথারিয়ার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল: দ্বগ্ধ প্রাণবৈচিত্র্য

নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৪:০৯, ১৫ মার্চ ২০২৩

প্রিন্ট:

আগুনে পুড়লো পাথারিয়ার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল: দ্বগ্ধ প্রাণবৈচিত্র্য

ছবি: বহুমাত্রিক.কম

এক টুকরো বনাঞ্চল অধ্যূষিত মৌলভীবাজারের পাথারিয়া বনের প্রায় ২০ হেক্টর এলাকা আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। সীমান্তবর্তী জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত পাথারিয়া হিল্স রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকায় ১০ দিনেরও বেশি সময় ধরে আগুনে পুড়েছে। বনবিভাগ নিরব থাকলেও সংবাদকর্মীদের তৎপরতায় সরব হয়ে উঠে। আগুনে পুড়ে বনের সরীসৃপ, কীটপতঙ্গ, পাখির বাসাসহ বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের অপুরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০ দিন পর বনবিভাগ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বনে আগুন লাগায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কয়েক হাজার গাছ আগুনে পুঁড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরিবেশগতভাবে মিশ্র চিরসবুজ সমনভাগ বনাঞ্চলের এ অংশটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের একটি অংশ এবং এটি ভারত-বাংলাদেশের আন্ত:সীমান্তব্যাপী ছয়টি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যকার একটি। পাথারিয়া বনের বড়লেখা রেঞ্জ এর মধ্যে থাকা সমনভাগ সংরক্ষিত বনের আয়তন ১৮৫০ হেক্টর। সমনভাগ বিটের দলছড়ি ও মাকাল জোরা এলাকায় রয়েছে ছোট বড় অনেক পাহাড়। এই এলাকার ধলছড়ি ও মাকাল জোরায় প্রায় ৪৫ হেক্টর জায়গার বন আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। বনটি বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল হিসাবে পরিচিত। কতিপয় বন কর্মীদের যোগসাজসে এই বনের টিলাভূমি আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয় বলে স্থানীয়দের ধারণা। খবর জানার পরও বনবিভাগ প্রথমে নির্বিকার ভূমিকা পালন করে এবং আগুন নেভানোর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। গণমাধ্যম কর্মীদের তৎপরতায় ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার পর তারা সরব হয়ে উঠেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।   

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সমনভাগ বনাঞ্চলে প্রায় ৬০৩ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং উভচর সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীর সমন্বয়ে ২০৯ প্রজাতির মেরুদ-ী প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ২০ প্রজাতির উভচর, ৪৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ১১৩ প্রজাতির পাখি ও ৩১ প্রজাতির স্তন্যপায়ীসহ অসংখ্য বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র। সমনভাগ বনাঞ্চলটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চিরসবুজ একটি বনাঞ্চল। উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষায় বাংলাদেশের মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অবস্থান সুদৃঢ়।

সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এমপির নির্বাচনী এলাকায় বনে আগুনে পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় অনেকেই হতবিহ্বল। প্রকাশ্যে বনের ভিতর এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও বনবিভাগের নিরবতা নিয়ে স্থানীয় পরিবেশ কর্মী ও সচেতন মহলের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। বন রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে হবে পরিবেশ মন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি থাকলেও অসাধু বন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজষে তা ভেস্তে যাচ্ছে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন। বনটিকে পরিকল্পিতভাবে পুড়িয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশকে হুমকির মুখে ফেলা হচ্ছে। 

সরজমিনে দেখা যায়, মিশ্র চিরসবুজ সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকাল জোরা এলাকায় এলাকায় প্রায় ৪৫ হেক্টর বন ভূমি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এক পাশে এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। আগুনে পুড়ে অজগর সাপ, চশমাপরা হনুমান, মায়া হরিণ, কচ্চপ, বনরুই, সজারুসহ বিভিন্ন সরীসৃপ প্রজাতির বিরল কীটপতঙ্গ এবং বেশ কিছু প্রজাতির বৃক্ষরাজির অভাবনীয় ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে বনের একপাশে চলছে বাঁশ কাটার মহোৎসব। অর্ধশতাধিক শ্রমিক দিয়ে সরকারি সম্পদকে বিনষ্ট করা হচ্ছে। বনের মধ্যে থাকা বিভিন্ন ধরনের পশুপাখি, পোকা মাকড়, জীবজন্তু মারা যাচ্ছে। দাউ দাউ করে আগুনে পুড়ে বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে ব্যাপক এলাকা।  

সংরক্ষিত বনে সামাজিক বনায়নের নামে স্থানীয় বন বিভাগ ব্যবসা করারও অভিযোগ উঠেছে। সেখানে আকাশমনি, আগর গাছের চারা রোপন করা হয়। বিটের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা সর্দারের মাধ্যমে হেক্টর প্রতি ৩০-৪০ হাজার টাকা করে বন্ঠন করে নেন। এসবের অংশ হিসেবে সমনভাগের এই সংরক্ষিত বনে আগর বাগান করারও আগ্রহ বন বিভাগের। এ কারনে তাদের নির্দেশে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে বাশঁ ও বনের গাছ পরিষ্কার করা হতে পারে বলেও কারো কারো ধারণা। 

স্থানীয় বাসিন্দা ইদ্রিস আলী জানান, জ্বালানি কাঠ ও নিজের কাজের জন্য বাঁশ নিতে মাঝে মধ্যে বনে আসি। তবে এই বনটি এমন ছিল না। এটি প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো একটি পরিপাটি বন ছিল। বনটি এখন আর আগের মতো নেই! আগে হাতিসহ অনেক ধরনের বন্যপ্রাণী ও মায়াহরিণ দেখা যেত। এখন কিছু নেই তারা অনিরাপদ। এখন খাদ্যের অভাবে লুকালয়ে চলে আসে ক্ষতি করে কৃষকের ফসল আদি।

কবির মিয়া, কামাল আহমেদসহ বনে নিয়মিত আসা যাওয়া কয়েক ব্যক্তি বলেন, গত দশদিন আগে আগুন আগুন লাগতে দেখা যায়। আগুনের তীব্রতা বেশি থাকায় বনের অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে বিষয়টি বন বিভাগকে জানালেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে এখানকার বিভিন্ন বিরল প্রজাতির প্রাণীসহ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। 

সমনভাগ বনবিট কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) এফ জি মো. নূরুল ইসলাম বলেন, এটি একটি অনাকাঙ্কিত ঘটনা। হয়তো কেউ বিড়ি খেয়ে ফেলেছে। এটা থেকে আগুন লেগে বনের চার-পাঁচ হেক্টর ভূমি আগুনে পুড়িয়ে গেছে। বড়লেখা রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রঞ্জন দাস জানান, বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গলস্থ বিভাগীয় সহকারী বন সংরক্ষক মো. মারুফ হোসেন বলেন, নিজে সরেজমিন ঘুরেছি। প্রায় ২ একরের মতো বন পুড়েছে। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ অফিস থেকে থানায় জিডি করা হয়েছে এবং তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে প্রাকৃতিক বনের জমি জবরদখলের জন্য আগুন লাগাতে পারে। বোন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. তৌফিকুল ইসলাম জানান, আগুন লাগার খবর শুনে আমরা সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আগুন লাগার অনুসন্ধানে একটি তদন্ত টিম করে দেওয়া হয়েছে। 

বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (সদর দপ্তর মৌলভীবাজার) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বনে আগুন লাগার বিষয়টি জেনেছি। যেহেতু সংরক্ষিত বন এলাকায় আগুন লেগেছে এতে সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণী সহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, পাখির বাসার ব্যাপক ক্ষতি হবে।

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer