-স্মৃতিসৌধে লেখক। ছবি: বহুমাত্রিক.কম
বধ্যভূমি নাম শুনলেই বুক কেঁপে উঠে। মনে পড়ে মায়ের মুখ থেকে শোনা তাঁর স্বচক্ষে দেখা মহান মুক্তিযুদ্ধের নানা বিভৎস ঘটনাবলী ও পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম নিষ্ঠুর কাহিনীর কথা।মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনে শোনে বেড়ে উঠেছি।ব ড় হয়েছি। আমার বাবাকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। কোন রকম প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। বাবা জীবিত নেই। কিন্তু তাঁকে পাকিস্তানী সৈন্যরা যে পৈশাচিক কায়দায় অমানবিক আঘাত করেছিল তা আমাকে প্রতিটি মুহূর্তে পীড়া দেয়। ছোট চাচা রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা। এখনোও জীবিত আছেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমার চাচা ৫নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধ করেছেন। অনেক গল্প, কাহিনী ও যুদ্ধের ইতিহাস জেনেছি তাঁর কাছ থেকে।
সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলা বাজার ইউনিয়নের হক নগর সীমান্তে অবস্থিত বাঁশতলা বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত স্থান। এখানে ২১জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া গেলেও নাম না জানা অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ সাধারণ মানুষকে ধরে এনে এখানে হত্যা করত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী।বধ্যভূমিতে পা দেয়ার সাথে সাথে গাঁ শিউরে উঠে। আমার সাথে ছোট ভাই সাজু ও জুবায়ের সহ আরো দু'বোন ছিলেন।
সাংবাদিক সোহেলের প্রস্তাব আর বাংলা বাজারের জুবায়ের ভাইয়ের ব্যবস্থাপনায় ২৬ মে শুক্রবার বাঁশতলায় যাই। বাংলা বাজার থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের পাদদেশে বাঁশতলা গ্রাম। অপরূপ সৌন্দর্যের আঁধার এ জনপদ। সবুজ প্রকৃতি,নীল আকাশ, ভূ-পৃষ্ঠের অপূর্ব চাহনি, দৃষ্টি সীমার নাগালের ভিতর ঐ দূরের পাহাড় আর রাস্তার ডানে বামে সারি সারি গাছ আমাদের বিমোহিত করে। তাল গাছ, কাঁঠাল গাছ আর কলা গাছ চোখে পড়ার মতো, সেই সাথে শিম শিম, বেগুনী সহ মৌসুমী সবজির কৃষি ক্ষেত আসলেই ভালো লাগছে আমাদের। প্রকৃতির অপার মহিমা ও লীলা ছড়িয়ে আছে এখানে।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই পেলাম চেলা নদীর উপর দৃষ্টি নন্দন সুইস গেট, এরপর বিজিবি ক্যাম্প পাড়ি দিয়েই পৌঁছে গেলাম বাঁশতলা স্মৃতিসৌধে। স্মৃতি সৌধ পরিদর্শনের সময় জুমার নামাজের সময় হওয়ায় স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করলাম। এলাকার লোকজন আমাদের খুব সম্মান করলো। নির্মাণাধীন মসজিদ। এখনো অনেক কাজ বাকী আছে।অর্থাভাবে এলাকার লোকজন মসজিদ নির্মাণ সমাপ্ত করতে পারছে না। নামাজ শেষে আবার স্মৃতিসৌধে গেলাম। শহীদদের সমাধিস্থল ও কবর ঘুরে ঘুরে দেখলাম। নামাজের পূর্বে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও বধ্যভূমি পরিদর্শন করেছি। অগণিত পর্যটক,দর্শক,আগন্তুক ও দর্শনার্থীরা প্রতিনিয়ত এখানে আসছে। এটা একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে।ফলে যুবক-যুবতী,নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু সবার আনাগোনা পরিলক্ষিত হয়েছে।দৃষ্টিনন্দন গ্রামীণ জনপদে কোলাহল মুক্ত পরিবেশে নির্মল আলো বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলতে সবাই ভালো পায়।
পাহাড় ঘেরা বাঁশতলা এলাকায় এবং তার আশপাশে মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হন তাদের সমাহিত করা হয় বাঁশতলার এই নির্জনে। সেই স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য নির্মিত হয় বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ।শুধু স্মৃতি সৌধ নয়, এখানে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধার সমাধী বা কবর।৬জনের নাম ঠিকানা জানা গেলেও বাকীরা এখনো অজ্ঞাতনামা হিসেবে রয়ে গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বাঁশতলা ছিল একটি সাব সেক্টর। ইহা ৫ নং সেক্টরের অধীনস্থ ছিল।১১টি সেক্টরের মধ্যে এই একটিমাত্র সেক্টর ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। যদিও এর তিনদিকেই ভারতবেষ্টিত।বাঁশতলার এই জায়গাটি সোজা চলে গেছে ভারতের ভিতর। তিন দিকে মেঘালয় পর্বতমালা ঘিরে থাকা বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ এক কথায় অসাধারণ।এখানে সৌন্দর্যের আরো সঙ্গী চেলাই খালের ওপর পানির ব্যারেজ ও টিলার ওপর জুমগাঁও।
তামাবিল ডাউকী সড়ক থেকে সুনামগঞ্জ এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। এই সেক্টরের সাবসেক্টর ছিল বাঁশতলা। এর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিন। বাঁশতলা এবং তার আশপাশে মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন,তাঁদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য নির্মাণ করা হয় বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ।জানা যায়,এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করেন ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিন।
লেখক:সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।