ছবি: বহুমাত্রিক.কম
মৌলভীবাজার : ২০ মে চা শ্রমিকদের ঐতিহাসিক মুল্লুক চলো (শ্রমিক হত্যা) দিবস। বিট্রিশদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ১৯২১ সালের এই দিনে নিজ মুল্লুকে ফিরে যেতে চাইলে চাঁদপুরের মেঘনা ঘাঁটে পৌঁছালেই চা শ্রমিকদের হত্যা করা হয়।
সস্তায় শ্রম কিনে অধিক মুনাফা লাভে ‘গাছ হিলায়ে গা তো পাইসা মিলেবে-গাছ নাড়লে টাকা মিলবে’ এইসব মিথ্যে প্রলোভনে ব্রিটিশরা ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ১৮৩৪-১৮৩৫ সালে চা শ্রমিকদের এদেশে নিয়ে আসে। কানু, তেলেগু, লোহার, রবিদাস, গোয়ালা সহ প্রায় ১১৬টি জাতিগোষ্ঠী চা শ্রমিকদের সংগ্রহ করে দেশে নিয়ে আসে।
নিরীহ, সহজ, সরল চা শ্রমিকরা গাছ নাড়লে টাকা পাওয়া তো দূরের কথা হিংস্র জীব-জন্তুর প্রতিকূল পাহাড়, জঙ্গলময় পরিবেশে নিজেদের জীবন বাঁচানোই দু:সাধ্য হয়ে উঠে।
অনাহার, অর্ধাহার, অসুখ-বিসুখে এক বীভৎস জীবনের সম্মুখীন হন তাঁরা। ইচ্ছে করলেই কোনো শ্রমিক চাকুরী থেকে ইস্তফা দিতে পারতো না। বাগান থেকে পালিয়ে গেলে তাদের ধরে আনা হতো। দেয়া হতো অমানবিক শাস্তি। চাবুক আর বুটের লাথি ছিল নিরীহ চা শ্রমিকদের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।
এভাবে মালিকদের হাতে শ্রমিকদের মুত্যুকেও সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখা হতো। শ্রমিকদের ইচ্ছা অনিচ্ছা বলতে কোন কিছুই কল্পনা করা যেতো না। বাগানের ভিতরে ছাতা মাথায় হাটাও অপরাধ হিসেবে গন্য করা হতো।
সে সময়ে পুরুষ শ্রমিকদের বেতন চার আনা, মহিলাদের তিন আনা এবং শিশুদের দুই আনা বেতন ছিল। ব্রিট্রিশরা কৃতদাস প্রথা বাদ দিলে চালু করে এমন বিভৎস আইন।
জানা যায়, ওলন্দাজ বণিকরা ১৬১০ সালে প্রথম চীন থেকে চা আমদানি শুরু করে। ইংরেজরা প্রথম চা আমদানি করতো চীন থেকে। চীন জাপান যুদ্ধের কারনে চীনের সাথে সম্পর্ক অবনতি হলে আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজরা বিকল্প চা উৎপাদনের জন্য তাদের ভারতবর্ষের উপর নজর পড়ে।
১৮৩৫ সালে বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করেন। তার নাম ‘রয়েল সোসাইটি’ ভারতবর্ষে চা উৎপাদন করার জন্য অনুসন্ধান করাই এই কমিশনের কাজ। এই কমিটি কাজ শুরু করার আগেই শিলচর এবং করিমগঞ্জে চা গাছের সন্ধান পাওয়া এই বছরই প্রথম চীনের বাইরে বাণিজ্যিকভাবে চা এর উৎপাদন কার্যক্রম গ্রহন করা হয়।
১৮৩৮ সালে সিলেট ও কাছাড়ে পরীক্ষামূলকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়। ভারতবর্সে আসামের লথিমপুরে, সিলেট ও কাছাড় জেলায় চায়ের উৎপাদন ব্যাপকতা পায়।
শ্রমঘন শিল্প হিসাবে চা বাগান গড়ে তুলতে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন দেখা দেয়। পাহাড়ি জঙ্গল পরিস্কার করা, রাস্তাঘাট-গৃহ নির্মাণ করা প্রাথমিক কাজ। এছাড়াও দ্রুত বর্ধনশীল আগাছা নিয়মিত পরিস্কার করতে দরকার হয় অনেক শ্রমিক। ফলে লোক সংগ্রহের জন্য শুরু হয় এই অনৈতিক কর্মকান্ড।
অপরদিকে চা রপ্তানির জন্য ১৮৬৪-৬৫ সালে রেল লাইন স্থাপন করে এবং ১৯০৪ সালে প্রসারিত করে চট্রগ্রামের সাথে যুক্ত করা হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে জাহাজে ভর্তি করে শ্রমিক আনা হয়।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, চা চাষের জন্য ১৮৬৩-১৮৬৬ সালে এ অঞ্চলে ৮৪,৯১৫ জন শ্রমিক আনা হয় যার মধ্যে অনাহারে, অর্ধাহারে, অসুখে-বিসুখে ৩০ হাজার শ্রমিক মারা যান।
চা বাগানে অধিকাংশ মালিক তখন ব্রিটিশ কোম্পানি। চা শ্রমিকরা ক্ষুধা, রুগ-ভোগ, মৃত্যু, নিজ আপনজন থেকে দূরে থাকা এমনকি ফিরে যাবার অনিশ্চয়তা তাদের বিদ্রোহী করে তোলে। ভারত বর্ষে তখন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে।
আন্দোলনের কিছুটা বাতাস পায় চা শ্রমিকরাও। ১৯২০ সালে শ্রমিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বাগান থেকে বাগানে। বিদেশী মালিকদের সব রকমের ব্যবসা বাণিজ্যে ও চা বাগান বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। অদক্ষভাবে আন্দোলন গড়াতে থাকে। রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে চা শ্রমিকরাও বাগান থেকে বের হয়ে আসে। স্ত্রী, পুত্র, পরিজন নিয়ে রেলপথ ধরে হাঁটতে থাকে। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত হাজার হাজার শ্রমিকরা জাহাজ ঘাটে এসে জড়ো হয়। হরদয়াল নাগের নেতৃত্বে শ্রমিকদের জন্য চিড়া ও চাউলের ব্যবস্থা করা হয়। শ্রমিকদের রান্না করার মনোবল হারিয়ে কাঁচা চাউল চিবিয়ে ক্ষুধা নিবারন করেন।
যখন স্টিমার ঘাটে এসে ভীড়ে তখন সবাই ধাক্কাধাক্কি করে স্টিমারে উঠতে ব্যস্ত হয়ে যায়। এসময় টিকেট নিয়ে জাহাজ কর্মীদের সাথে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় এবং সিঁড়ি দিয়ে একসাথে উঠতে গিয়ে ঝপাঝপ পড়ে পানিতে। এ সময়ে পূর্ব থেকে প্রস্তুত থাকা পুলিশ সিঁড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়লে সিঁড়ি থেকে শ্রমিকদের রক্তাক্ত দেহ পরতে থাকে। অল্প সময়ে জাহাজ ঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। এই সময়ে কতজন শ্রমিক নিহত হয়েছিল আর কতজন শ্রমিক আহত হয়েছিল তার কোন হিসেব পাওয়া যায়নি।
লোকজন নদীতে শুধু লাশের সারি ভাসতে দেখে। চাঁদপুর রেলষ্টেশনে হাজার হাজার ক্লান্ত শ্রমিকদের উপর গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় গুর্খা সৈন্যরা ঝাপিয়ে পড়ে। রাতের অন্ধকারে অনেক লাশ গুম করে ফেলা হয়।
চাঁদপুরের এ ঘটনায় হরতাল ডাকা হলে রেল ও জাহাজ কোম্পানির কর্মীরা তাতে সমর্থন জানায় এবং প্রতিবাদ কর্মসূচীতে অংশ নেয়। এই ধর্মঘট চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়ে নেতৃস্থানীয় শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। চা শ্রমিকদের মুল্লুক চলো যাত্রায় হতাহতের ঘটনায় প্রতি বছর ২০ মে শ্রমিক হত্যা দিবস পালন করা হয়। কিন্তু এটি এখন স্বীকৃতি পায়নি।
বহুমাত্রিক.কম