Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১৬ ১৪৩১, মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪

কৃষিতে নতুন বিপ্লব আনবে ‘ই-ভিলেজ’

রশীদুল হাসান

প্রকাশিত: ০২:০০, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

আপডেট: ০২:৪৩, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

প্রিন্ট:

কৃষিতে নতুন বিপ্লব আনবে ‘ই-ভিলেজ’

ঢাকা : অত্যাধুনিক তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে ‘ই-ভিলেজ’ নামে একটি বিশেষ প্রকল্প চালু হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সামগ্রিকভাবে দেশকে ডিজিটাল করে ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’য় রূপান্তরে বর্তমান সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টায় এ প্রকল্প বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় (১৯ জানুয়ারি ২০১৭) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এ প্রকল্পের প্রথম ধাপের আনুষ্ঠানিক যাত্রা উপলক্ষ্যে খ্যাতনামা চীনা প্রতিষ্ঠান আইসফটস্টোন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে এক যৌথ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে।

প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশে কৃষি ব্যবস্থাকে সম্বৃদ্ধির সোপানে নিয়ে যেতে এ প্রকল্পে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে চীন দূতাবাস। প্রধান অতিথি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এমপি। মান্যবর চীনের রাষ্ট্রদূত অনুষ্ঠানে ‘গেস্ট অন অনার’ হিসাবে উপস্থিত থাকবেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, জ্যেষ্ঠ কৃষিবিদ, গবেষকসহ অনেকে এতে উপস্থিত থাকবেন।

প্রকল্পের প্রেক্ষাপট

ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা প্রধানতম চ্যালেঞ্জ। কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও খাদ্য উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতসমূহ, শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মত অবধারিত চ্যালেঞ্জও রয়েছে আমাদের। এমন বাস্তবতায় গবেষকরা অবিরতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে স্বল্পতম ব্যয়ে সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিত করা যায়।

কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকার নীতিগতভাবে এই বিষয়টির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তির সর্বশেষ অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে ‘ই-ভিলেজ’ নামে এ বিশেষ প্রকল্প শুরু হতে যাচ্ছে। মাটির স্বাস্থ্য, ফসলের প্রকৃত রোগ যথাযথভাবে নিরূপণ করে বিদ্যমান উপাদন ব্যয় কমিয়ে সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিত করাই হবে এই প্রকল্পের প্রধানতম লক্ষ্য।

যেভাবে বাস্তবায়িত হবে প্রকল্পটি

সাম্প্রতিক বিশ্বে স্মার্ট এগ্রিকালচার মডেল অনুসরণে ‘ই-ভিলেজ’ নামের এই প্রকল্পটি পরীক্ষামূলকভাবে একটি গ্রামে বাস্তবায়িত হবে। এর মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তীতে এটিকে বৃহত্তর পরিসরে কৃষক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রকল্পের শুরুতে একটি আদর্শ কৃষি প্রধান গ্রাম বেছে নেওয়া হবে। বলে রাখা দরকার, কৃষক পর্যায়ে প্রযুক্তির নানামূখি ব্যবহার বাংলাদেশে এক দশকেরও আগে শুরু হয়। তখন থেকে বিভিন্ন কৃষক সহায়ক অ্যাপসের মাধ্যমে টেলিসেন্টার বা ডিজিটাল সেন্টার থেকে কৃষকদের পরিসেবা দেওয়া হচ্ছে। জোর দিয়েই বলা যায়, দেশজুড়ে ডিজিটাল সেন্টারগুলো কৃষক পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারকে অনেকগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও এসব অ্যাপস এর পরিসেবার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে-অনেক সময় এগুলো রিয়েলটাইম হয় না।

‘ই-ভিলেজ’ প্রকল্পটি অতীতের সেসব সীমাবদ্ধতাকে জয় করে বেশকিছু নতুন প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটাতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে একটি স্মার্ট অ্যাপস তৈরী করা হবে। যা বাংলায় সহজে কৃষকের ব্যবহার উপযোগী, ছবি ও অডিও ভয়েসযুক্ত করা হবে। যার মাধ্যমে কৃষকরা তার জমির ও ফসলের কী অবস্থা তা জানতে পারবে। প্রকল্পের শুরুতে এটি সবজি ক্ষেতে সমীক্ষা চালানো হবে। ধীরে ধীরে তা অন্য ফসলে নিয়ে যাওয় হবে।

কৃষকরা সকালে ফোন সেটটি ওপেন করলেই তাতে একটি বার্তা যাবে, যাতে নির্দেশনা থাকবে-তাঁর ক্ষেতের সবশেষ কী অবস্থা। একই সাথে করণীয়গুলোও জানিয়ে দেবে-কী ধরণের ওষুধ, সার পানি বা অন্যান্য উপকরণ দিতে হবে। যদি তারা বাড়ির বাইরেও থাকে যাতে তার কাছে বার্তা যায় সে ব্যবস্থা থাকবে। কৃষকরা তাদের ক্ষেতের জটিল কোনো অবস্থাতে কারও কাছে দারস্থ না হয়ে নিজেই সমাধান করতে পারবেন।

স্থানীয় আবহাওয়া ও অন্যান্য উপযোগীতা বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু ডিভাইস উদ্ভাবন করা হবে। বিশ্বজুড়েই কিছু ডিভাইস সচারাচর পাওয়া যায়, কিন্তু তা খুবই ব্যয়বহুল। তারপরও আবার এটা দিয়ে কেবল একধরণের ডাটা পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের কৃষকদের পক্ষে তো এতদাম দিয়ে তা কেনা সম্ভব নয়। এই পাইলট প্রকল্পে মাধ্যমে একটি সাশ্রয়ী ডিভাইস নিয়ে আসব, যা কৃষকরা সামর্থ্যরে নাগালে থাকবে। যাতে একজন বা একাধিক কৃষক মিলে ওই ডিভাইসটি কিনতে পারবে।

এই ডিভাইসটি নিজ থেকে পিএইচ লেভেল বলে দেবে, ক্ষতিকারক পোকামাকড় আছে কিনা তা বলে দেবে। এই ডাটাগুলো চলে আসবে সার্ভারে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এসব ডাটা বিশ্লেষণ-সুবিন্যাস করে সফটওয়ার উন্নয়ন করে তা অ্যাপসে যাবে। কৃষিবিদরা ডাটা বিশ্লেষণগুলো করে যথাযথ পরামর্শটা অ্যাপসে যুক্ত করবেন। কৃষকদের কাছে অ্যাপসের মাধ্যমে সরাসরি পরামর্শটা চলে যাবে।

ধারণা করা হচ্ছে, যদি পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রকল্প সফল হয় তাহলে ফসলের ফলন ২০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। কারণ হচ্ছে রোগবালাইসহ অন্যান্য সমস্যাগুলো যথাসময়ে চিহ্নিত করা যাবে ও যথাসময়ে তার প্রতিকার করা যাবে। অপরদিকে, উপাদান ব্যয়ও ২০ ভাগ কমবে। যার ফলে এটি আশা করা যায়, কৃষকরা ‘ই-ভিলেজ’ প্রকল্পের মাধ্যমে ৪০ ভাগ লাভবান হবে।

প্রকল্পটির এই প্রত্যাশ্যা বাস্তবে কতটা প্রতিফলিত হয়, সেজন্য টানা ৬ মাস এনিয়ে ধারাবাহিক গবেষণা চলবে। বাকী সময়ে অন্যান্য বিষয়মূহ সম্পন্ন হবে। সামগ্রিভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে তা আরও একধাপ অগ্রগতি হবে।

‘ক্রিয়েটিং ই-ভিলেজ ইউজিং স্মার্ট টেকনোলজি’ নামের এই প্রকল্পের পাইলট পর্বে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায়িত করতে তাদের প্রশিক্ষতও করা হবে। যাতে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য দিয়ে খাদ্যপণ্য ই-ভিলেজ প্রকল্পের এসে বিক্রি করতে পারবে।

অর্থায়ন ও বাস্তবায়নে

চায়না দূতাবাসের আর্থিক সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পের অগ্রগতি মূল্যায়ন ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। এতে প্রযুক্তি ও উপকরণগত সহায়তা দেবে চায়না প্রতিষ্ঠান আইসফস্টোন ।

প্রকল্প নিয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা

প্রকল্প বাস্তবায়নে মূখ্য ভূমিকায় থাকবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণায় শীর্ষে থাকা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কৃষিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুবর রহমান ‘ই-ভিলেজ’ প্রকল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আজকের দিনটি বাংলাদেশের আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ই-ভিলেজ প্রকল্পের মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সঠিকভাবে এবং সহজলভ্য করে কৃষকদের কাছে পৌছানো সম্ভব হবে। কৃষিতে নতুন উদ্দীপনা এবং বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হবে।’

তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকার কৃষিবান্ধব সরকার। সরকার ঘোষিত ভিশন-২০২১ ও ভিশন-২০৪১ এর রুপরেখার আওতায় ডিজিটাল এবং স্বনির্ভর দেশ গড়ার পথে কৃষিকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ন খাত হিসেবে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।’

কৃষি বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণায় কৃষিবান্ধব সরকারের সদিচ্ছা এবং সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ এই কৃষিবিদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত চার বছরে কৃষিতে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এ সময়ে বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনসহ উল্লেখযোগ্য সফল গবেষণা উপহার দিয়েছি আমরা। যার মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে দেশের কৃষির উন্নয়ন ও অগ্রগতি সূচিত হয়েছে।’

‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা জোরদারে সরকারের অভিপ্রায়ের দৃশ্যমান প্রতিফলন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে’-যোগ করেন অধ্যাপক রহমান।
তিনি ‘ই-ভিলেজ’ প্রকল্পের সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে কৃষি সেক্টরে প্রযুক্তির বিকাশে এ প্রয়াসের ভূয়শী প্রশংসা করেন। উপাচার্য উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র চীনের প্রতিষ্ঠান আইসফটস্টোন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের তরুণদের স্বপ্নদ্রষ্টা সিআরআই’কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।

ই-ভিলেজ প্রকল্পের সফলতার উচ্চ আশাবাদ জানিয়ে আইসফস্টোন-এর মহাব্যবস্থাপক ফেরহক ওয়াল্টার বলেন, ‘চীন দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। ই-ভিলেজ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষক এবং কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এবং আধুনিক রুপান্তর সম্ভব। কৃষি অর্থনীতির গতানুগতিক হিসাব নিকাশ পাল্টে দিতে পারে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক চাষাবাদ এবং বিপণন প্রক্রিয়া।’

ই-ভিলেজ প্রকল্পে সংযুক্ত থেকে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় অংশিদারিত্বের এই সুযোগ দানের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ তিনি।

ফেরহক ওয়াল্টার বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী এবং চৌকস প্রযুক্তিবিদ ও কৃষিবিদদের কর্মকাণ্ডে আমরা উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছি। তাঁদের গবেষণা এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে প্রান্তিক কৃষকরা বিভিন্ন উদ্ভিদের রোগ ও রোগের সঠিক সমাধানের লক্ষ্যে বানানো অ্যাপস ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অন্য সকলের অব্যাহত সফলতা কামনা করছি।’

রশীদুল হাসান : প্রজেক্ট ইনভেস্টিগেটর, ই-ভিলেজ; সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।[email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer