
নদী নিয়ে দেশে অনেক আলোচনা রয়েছে। বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। নদীর পরিসংখ্যান নিয়ে রয়েছে মতভেদ। কেউ হিসাব দেখান বাংলাদেশে রয়েছে ছোট-বড় মিলে প্রায় সাত শতাধিক নদী। আবার কেউ কেউ দেখান এ সংখ্যা আরো বেশি। তবে সর্বশেষ সরকারি তথ্যমতে এ সংখ্যা কমবেশি ২৩০ টি।
সংখ্যা যাই হোক না কেন এ নদীগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সারা দেশজুড়ে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে রয়েছে প্রায় অর্ধ শতাধিক নদ-নদীর সংযোগ। আবার নাফ নদীটি বিভক্ত করেছে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সীমান্তকে। এভাবে দেখতে গেলে প্রতিজেলায় একাধিক ছোট-বড় নদী রয়েছে। তাছাড়া নদীর সংখ্যা যদি সাত শতাধিক হয় সেখানে প্রতি উপজেলাতেও কমপক্ষে একটি নদীর অস্তিত্ব বিদ্যমান।
নদী সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আগে জানা দরকার নদী আমাদের কী উপকারে আসে। একসময় বাংলাদেশের চলাচলের এবং পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম ছিল নদীপথ। সেজন্য আজো বাংলাদেশের বড়বড় শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি রয়েছে নদীবন্দরে। তেমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নদীবন্দরের নাম এখনো গুরুত্বপূর্ণ। ভৈরব বাজার, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঈশ্বরদী, গোয়ালন্দ, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, ঢাকা, রাজশাহী অন্যতম। ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে নারায়ণগঞ্জকে সেজন্য বাংলাদেশের ডান্ডি বলা হতো। তবে কালের বিবর্তনে এখন সেসব নদীপথ শুধুই ইতিহাস। এমনও নদীপথ রয়েছে যেগুলোর আর কোন চিহ্নই পরিলক্ষিত হয় না।
এখন নদী বন্দর বা নদীপথ যে শুধু বিলীন হয়ে গেছে তাই নয় সেগুলো বিলীন করার পিছনে অনেকাংশে আমরাই দায়ী। দখল, দুষণ নদীর নিত্য নৈমিত্তিক কষাঘাত। নদীর কোন ব্যক্তি মালিকানা থাকেনা। সেগুলো সরকারের প্রাকৃতিক সম্পত্তি। এর রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা সবকিছুর জন্যই সরকারের আলাদা আলাদা কর্তৃপক্ষ রয়েছে। কিন্তু এসব কর্তৃপক্ষকে প্রতিনিয়ত ফাঁকি দিয়ে সেসব প্রাকৃতিক সম্পদ গ্রাস করে চলেছে এক শ্রেণির মুনাফলোভী অবিচারি ও অবিবেচক মানুষ। তারা নদীর জেগে উঠা চর কিংবা নদীর ধার বা পাড় ভরাট করে নিয়ে স্থাপনা তৈরী করে নদী দখল করে নিচ্ছে।
আবার নদীর ধারে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরী হচ্ছে না কলকারখানা। এতে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। একদিকে নদীর চারিপাশে দখল ও মানুষের সৃষ্টি করা বিভিন্ন কার্যকলাপের ফলে নদী ভরাট হয়ে তা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে নদীর আশেপাশে অস্বাস্থ্যকর ও পরিবেশ বিরোধী বিভিন্ন কলাকারখানা তৈরী করে নদীকে নিয়মিত দুষিত করে চলেছে। আগে সেগুলো আমরা দেখতাম বড় বড় শহরে কিংবা বাণিজ্যিক এলাকাতেই নদী দুষণ সীমাবদ্ধ ছিল।
কিন্তু এমন দুষণের মতো পরিস্থিতি এখন গ্রামের সেই আমাদের ছোট্ট নদীটি পর্যন্ত বিস্তৃত। নদী দখল-দুষণে কী পরিমাণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বা হচ্ছে তা আমরা এ করোনাকালে একটু হলেও বুঝতে পেরেছি। কারণ এ করোনাকালের মহামারি বা ক্ষতির ভিতর দিয়েও আমাদেরকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষা দিচ্ছে। অর্থাৎ যখন সারাদেশে লকডাউন অবস্থা চলছিল, দেশের সকল রাস্তাঘাট, গাড়িঘোড়া, শিল্প কলকারখানা বন্ধ ছিল। সেসময়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের অনেক উন্নতি সাধিত হতে দেখেছি। দেখেছি নদী দুষণ বন্ধ থেকে পরিষ্কার ঝলমলে পানির স্রোত।
উদাহরণ হিসেবে বলতে গেলে বর্তমানে আমরা যে এলাকায় বসবাস করি সেখানকার কথাই ধরা যেতে পারে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং ঢাকার আশেপাশের এলাকার বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীর মধ্যে রয়েছে মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষা, নরসুন্দা, কাঞ্চন, তুরাগ, সুতী ইত্যাদি। এরমধ্যে ত্রিশাল, ভালুকা, গফরগাঁও, শ্রীপুর, কাপাসিয়া, পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর- এসব এলাকায় ছোট ছোট কিছু নদী রয়েছে। এগুলো আদিকাল থেকে স্বমহিমায় বহমান ছিল। কিন্তু সম্প্রতি নাগরিক উন্নয়নের ডামাঢোলে এসব নদীও আজ ব্যাপকভাবে দখল ও দুষণের শিকার। কারণ আগেই বলেছি দেশের নতুন নতুন এলাকা এখন শিল্প বাণিজ্যের আওতায় আসায় সেগুলো ব্যাপক প্রভাব ফেলছে সেসব গ্রামীণ ছোট ছোট নদ-নদীর উপর।
কাজেই দখল দুষণ বন্ধে প্রয়োজন আগেভাগেই সেসব নদী সুরক্ষার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা। এটি কোন কঠিন কাজ নয়। দেশের উন্নয়ন হবে সেটি সকল নাগরিকের মতো আমরাও অবশ্যই চাই। কিন্তু সেটি করতে গেলে শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে নদীকে ধংস করে কেন। নদী থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেও তো শিল্প বিপ্লব করা সম্ভব। তাছাড়া যদি করতেই হয় তবে সেটি পরিবেশসম্মতভাবে নদীকে বাঁচিয়েও করা যেতে পারে। অন্যথায় দেখা যাবে গ্রামের মানুষ এর বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। তেমনি একটি উদ্যোগের উদাহরণ সম্প্রতি দেখেছি গণমাধ্যমে।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও, ত্রিশাল, ভালুকা গাজীপুরের শ্রীপুর এবং কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া ও হোসেনপুরের একদল তরুণ পরিবেশকর্মী ‘সুতী নদী সুরক্ষা’ নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তারা কাজ শুরু করেছেন ‘সুতী সুরক্ষা পরিষদ’ নামে।
ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন স্বেচ্ছাশ্রম ভিত্তিক কর্মকাণ্ড করে এলাকার সুতী নদীসহ আশেপাশের অনেক পরিবেশ সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি নিজে একজন পরিবেশ কর্মী হিসেবে অন্যান্য অনেক বিশিষ্ট গণমাধ্যম ও পরিবেশ কর্মীগণের পাশপাশি আমাকেও এ পরিষদের উপদেষ্টাামণ্ডলীতে স্থান দেওয়া হয়েছে। এ মহতি উদ্যোগের সাথে থাকতে পেরে আমি নিজে গর্বিত অনুভব করছি। পাশাপাশি এটি একটি প্রতীকী নদী সুরক্ষা পরিষদ গঠিত হয়েছে। সারাদেশে এমন অনেক ছোটবড় নদ-নদীকে দখল দুষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য এরই আদলে নদী সুরক্ষা আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে।
আগেই বলেছি এ করোনাকালে দখল দুষণ বন্ধ থাকার কারণে যেভাবে নদীর পরিষ্কার পানির স্রোত দেখা যাচ্ছে, এমন অবস্থা সবসময় ধরে রাখতে পারলেই নদীর দুষণ রোধ করা সম্ভব। অর্থাৎ করোনা না হলে কোনদিনও হয়তো এমনভাবে দীর্ঘদিন শিল্প কলকারখানা বন্ধ থাকতো না। তখন নদীর এমন ভালো অবস্থা কখনো দেখা সম্ভব হতো না। তাই করোনাকাল থেকে নদ-নদী সুরক্ষার কৌশল শিক্ষা নিতে হবে। চালিয়ে যেগে হবে দেশব্যাপী এবং সারা বছরজুড়ে।
লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]
বহুমাত্রিক.কম