
-তারেক মিয়াজী
চলে যাওয়ার আগে অথবা আত্মহত্যা করার আগে মানুষ কয়েকটা সংকেত দিয়ে যায়!সংকতগুলো কাছের মানুষরাই খুব বেশি বুঝতে পারে আর কেউ না! এই বিষয়টি হঠাৎ করেই আসেনা। কয়েকটা কারণ অনেকগুলো ঘটনার প্রবাহকাল সংযুক্ত হয়েই মানুষ ডিপ্রেশনে চলে যায়। কিন্তু তখন কেউ আত্মহত্যা করেনা!
তখন নিজেকে নিজে বন্দি করে রাখে। খুব একাকিত্ব অনুভব করে। সবাইকে তাঁর শক্রু মনে হয়। ডিপ্রেশনের ও একটা বয়স আছে! সময় নির্ধারিত আছে।মানষিক ভাবে দূর্বল না করা পর্যন্ত ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকা মানুষ আত্নহত্যা করেনা। যখন দূর্বল হয়ে যায়..তখন মানুষের ইন্দ্রিয় গুলো কাজ খুব কম করে।
ভয়ানক একটা একাকিত্ব লাগে তখন..চারপাশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন তা নিয়ন্ত্রণহীনে চলে যায়। ডিপ্রেশন আপনার বন্ধুর মতো হয়ে আপনার পাশে সর্বক্ষণ থাকে।যখন বুঝতে পারে আপনি তাঁকে ছাড়তে অক্ষম তখন সে আপনাকে আরো গ্রাস করে নেয়।প্রায় তখন সবাই একাকী থাকতে পচন্দ করে। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়।
আত্নহত্যা কেন করে মানুষ
আত্মহত্যা করার অনেকগুলো কারন থাকতে পারে। আশির দশকের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মনে করতেন। গভীর বিষণ্নতা এবং অন্যান্য মানষিক রোগের কারনে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে।
যেমন সিজোফ্রেনিয়া বাই-পোলার ইত্যাদি। আবার দেখা যায় কোন কারণ ছাড়াই প্রায় মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে।বর্তমান সময়ে তা কিছুটা ভিন্নতা পেয়েছে।খুব সামান্য কারনেই মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে।পরিক্ষায় ভালো ফলাফল না হওয়ার কারনে।
সেক্ষেত্রে এসএসসি পরিক্ষার্থীদের বিষয়টি ভিন্ন..কেননা তাঁদের অনেকের তখন বয়ঃসন্ধিকাল সময় চলে, বয়ঃসন্ধিকালে এমনিতেই তাঁদের মনের ভিতর অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে থাকে।শরীরের গ্রোথ তখন বৃদ্ধি পায়। তাঁদের লজ্জার কারণে অনেক প্রশ্ন তাঁরা করতে পারেনা বাবা মাকে।আর বাবা মা সবসময় এই বিষয়গুলোও লক্ষ রাখেনা।
লক্ষ রাখতে হবে যে তাঁদের সন্তান কি করে! তাঁর সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। ঠিক সেই মূহুর্তে যখন তাঁদের এসএসসি পরিক্ষার ফলাফল প্রকাশ পায়। তখন খারাপ ফলাফলের জন্য তাঁরা আত্মহত্যা করে।তাঁদের ভিতরে কাজ করে পৃথিবীতে এর থেকে হয়তো লজ্জার আর কিছু নেই। এই জন্যই তাঁদেরকে তখন কাছাকাছি রাখতে হবে। বুঝাতে হবে এসএসির ফলাফল জীবনেও জন্য সবকিছু নয়। সামনে অনেক সময় আছে চিন্তা করোনা। আর বাবা মা যখন সন্তানকে বকাবকি করে সেই জন্য ও মাঝে মাঝে তাঁরা আত্মহত্যার মতো জগণ্য পথ বেঁচে নেয়!
আরও অনেকগুলো কারণেও মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে, চাকুরিচ্যুত হওয়া,ব্যবসায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, পারিবারিক কলহ, ঋণগ্রস্ত, অনেক সময় দেখা যায় স্বাভাবিক মানুষ চলাফেরা করছে কিন্তু হুট করেই আত্মহত্যা করে থাকে। এঁদের আত্মহত্যাটা হয়ে থাকে হঠাৎ করেই বড় কোন ধাক্কা খেয়েছে কিন্তু মূহুর্তে তা সামাল দিতে না পারার কারণে তাঁরা আত্মহত্যা করে থাকে।
আবার সাংসারিক প্রেম-সংক্রান্ত বিষয়ে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। প্রেম-বিয়ে এক্ষেত্রে যোগ্যতা অনেক বাঁচাই করে থাকে। দেখা যাচ্ছে সম্পর্কের একটা সময় আসলো ভালো কোন সঙ্গী বাঁচাই করতে পারলে পূর্বের জনের সাথে একটা সম্পর্কচ্ছেদ করে থাকে! আর তখন সে হীনমন্যতায় সময় পার করে। আত্মহত্যা টা সেই জন্যও হয়ে থাকে।আত্নহত্যা নিয়ে কাজ করে মাজেদা ফাউন্ডেশন থেকে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা প্রবণ এলাকা ঝিনাইদহের মহেশপুর আমরা গিয়েছিলাম জনসচেতনতা মূলক কার্যক্রমে। আমাদের সাথে স্থানীয় সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
মহেশপুরে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে আমরা এসএসসি পরিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা ক্যাম্পেইন করি। ক্যাম্পেইন চলাকালীন সময়ে আমরা সকলের কাছ থেকে জানতে চাই তোমাদের কোন সমস্যা আছে কিনা! তখন দেখলাম অনেকেই বলতে ইচ্ছুক নয়। পরে আমরা সকলের হাতে কাগজ কলম দিয়ে বলি তোমাদের সমস্যা গুলো এখানে লিখো, ২০ মিনিট পর আমরা সেই কাগজ আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে সংগ্রহ করি। তখন আমরা যা পাই তা হলো। একজন লিখেছে আমার বাবা জমিতে কাজ করে আমার বড় ভাই বাবার কাছ ১০০ টাকা চেয়েছি বাবা দিতে পারেনি। তাই ভাই আত্মহত্যা করেছে। এখন আমি কোন টাকা চাইনা আর বাবার কাছে।আরো একজন লিখেছে (মেয়ে)আমাদের এখানে ৪/৫ দিন পরপর মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। কেন করে আমরা তা জানিনা।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানিয়েছে। স্কুলের বয়স প্রায় ১৮ বছর এই সময়ে তাঁদের ২০ এর অধিক ছাত্র ছাত্রী আত্নহত্যা করেছে। তাঁর মানে বছরে ১ এর অধিক। আমরা কিছু বাড়িতে পরবর্তী সময়ে ঘুরে আসি। মহেশপুর থানাটি একেবারে ভারতের বর্ডার সাইড। নির্জনে ওখানে স্থানীয়দের মতে অনেক মানুষ আত্নহত্যা করে থাকে। ছেলের সাথে হালকা ঝগড়া হলে মা আত্নহত্যা করে। ছেলের বউয়ের সাথে শশুর কিংবা শাশুড়ির।
আত্মহত্যা নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোন পরিসংখ্যান নেই। আমরা মাজেদা ফাউন্ডেশন থেকে চেষ্টা করে চলেছি প্রতি বছর আত্মহত্যা নিয়ে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে। যেমন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতি বছর প্রায় ৮ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। মানে হলো প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে ১ জন! বর্তমান সময়ে যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। প্রতি বছর প্রায় ৬৫ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকে। যাঁদের বেশির ভাগ অল্প বয়সী এবং নারী।আত্মহত্যা বর্তমানে অনেক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সেলিব্রেটি, খেলোয়ার, ইত্যাদি।
আত্মহত্যা থেকে বাঁচার উপায়
বর্তমানে কভিড-১৯ এর সময়ে দীর্ঘদিন ধরে ঘর বন্দি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। প্রথমদিকে সবাই স্বাভাবিক থাকলেও আস্তে আস্তে তা ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে। দীর্ঘদিন ঘরে থাকার কারণে পারিপার্শ্বিকতা এবং পারিবারিক কলহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের ফেসবুক পেজে প্রায় এই টাইপ মেসেজ আসে। আমরা কাউন্সিলিং সেন্টারের মাধ্যমে চেষ্টা করে থাকি সমাধানের জন্য।
কভিড-১৯ এর কারনে অনেকেই ব্যবসায়ীক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেকের চাকুরি চলে গেছে এইসব কারণেও অনেকেই বর্তমানে মারাত্মক হতাশায় ভুগছে। তাঁদের উদ্দেশ্য বলা এই সময় এই ২০২০ সালটা বেঁচে থাকার বছর। আপনি বেঁচে আছেন এটাই হলো মূল সফলতা আপনার।
অনেকেই তো অনেক প্রিয়জন হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন। কারো কারো ৪ জন পরিবারের সদস্যের ৩ জনই নেই। তাঁদের অবস্থা তাঁদের মানষিক অবস্থা কেমন ভাবতে পারেন। এটা ভাবুন আপনি। এবং নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। চাকুরি চলে গেছে ব্যস্ত হয়ে পড়ুন কৃষিতে অনেকেই এসবে ভালো করছে। মূলত আপনাকে এই সময়ে ঘরবন্দী থাকার পাশাপাশিই প্রয়োজনে বই পড়ুন।
ব্যায়াম করুন। মানসিক চাপ সবসময় নিতে হয়না। ভবিষ্যতে ভালো কিছু এই আঁধার কেটে যাবে। আলো আসবেই। আমাদের আলোতে আমরা সব বিষন্নতা সব দুঃখ ভাসিয়ে দিয়ে কাঁধে কাধ রেখে জয়গান গেয়ে যাবো
‘আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি’
লেখক: নাট্য-নির্মাতা ও সভাপতি, মাজেদা ফাউন্ডেশন
বহুমাত্রিক.কম