Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণে চাই শৃঙ্খলা ও সুসমন্বয়

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ০২:৪৫, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণে চাই শৃঙ্খলা ও সুসমন্বয়

ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আগমনে যে মানবিক বিপর্যয় শুরু হয়েছে সেটা নিয়ে বাংলাদেশ কী করছে এবং আরও কী করণীয় আছে সেটা নিয়ে নানা মুনি নানা মত দিয়েই চলেছেন। এ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে যেমন চলছে আলোচনা, ঠিক তেমনি বহির্বিশ্বও এই ইস্যুতে তৎপর। তবে চলমান রোহিঙ্গা সংকটের কার্যকর সমাধানের পথে বাংলাদেশের পদক্ষেপ এবং সরকার প্রধান শেখ হাসিনার উদারনৈতিক মানবিক অবস্থান বিশ্বজুড়ে দ্বিধাহীনভাবে প্রশংসিত হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞের বিষয়টি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের চলমান ৭২তম অধিবেশনের যথাযথভাবে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তুলে ধরার ফলশ্রুতিতে বিশ্ব জনমত এখন রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতায় একাট্টা।

কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে যেখানে পূর্ব থেকেই প্রায় ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া, কুতুপালং, বালুখালি ইত্যাদি সীমান্তসহ আরো অন্যান্য স্থানে ছিল, তার সাথে ২৫ আগস্ট (২০১৭) থেকে এখনপর্যন্ত প্রায় একমাসে দলে দলে বানের জলের স্রোতের মত এসে সেখানে যুক্ত হয়েছে কমপক্ষে আরও প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক। সবশেষ যোগ হওয়াদের নিয়ে সেখানকার শরণার্থীর সংখ্যা এখন দশলাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে দেশি-বিদেশি জরিপের পরিসংখ্যানে দাবি করা হয়েছে। যার ফলে সমস্যা দেখা দিয়েছে তাদের পুনর্বাসনসহ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে।

আমরা জানি এবং মিডিয়ার কল্যাণে দেখতে পাচ্ছি রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণভয়ে কোনরকমে এক কাপড়ে পালিয়ে চলে আসছেন। সেজন্য সরকার সেখানে বিশৃঙ্খল ত্রাণ তৎপরতা শৃঙ্খলায় আনা ও সমন্বিতভাবে করার জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রথম দিকে যদিও পূর্বের অভিজ্ঞতার আলোকে সমস্যাটির ভয়াবহতা বিবেচনা করে বিজিবি কর্তৃক রোহিঙ্গা স্রোত ঠেকানোর জন্য তাদেরকে আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বাংলাদেশের মানবিকবোধ সম্পন্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে অবস্থান থেকে সরে এসে রোহিঙ্গাদের কষ্টের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে তাদেরকে নিজে সেখানে দেখতেও ছুটে গিয়েছেন।

তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে এসেই কয়েকদিনের মধ্যেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় যোগ দানের উদ্দেশ্যে নিউইয়র্ক গিয়েছেন। সেখানে গিয়ে তিনি স্বস্তিতে নেই। প্রতি মুহূর্তেই তিনি ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিপিএস পদ্ধতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। আগত রোহিঙ্গাদের সাথে মানবিক আচরণ করার জন্য সীমান্তবর্তী কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী ইত্যাদি ছয়টি জেলার ডিসিদেরকে পত্র দিয়েছেন।

সেখানে সরকারি-বেসরকারি ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সেচ্ছাসেবী সংস্থা মানবিক সাহায্য ও ত্রাণ সহায়তা নিয়ে ছুটে আসছেন। তারা প্রত্যেকে তাদের মতো ত্রাণ বিতরণ করার চেষ্টা করছেন। সেখানে ত্রাণের হয়তো তেমন কোন অপ্রতুলতা নেই। কিন্তু আছে বিতরণের সমন্বয়হীনতা এবং শৃঙ্খলার অসাঞ্জস্যতা। কারণ দেখা যাচ্ছে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সকল ধরনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শত আহবান সত্ত্বেও কেউই শৃঙ্খলার সঙ্গে ত্রাণ বিতরণে সাড়া দিচ্ছে না। এতে যা হওয়ার আসলে তাই হচ্ছে।

দেখা গেছে কেউ আসছে ট্রাকভর্তি ত্রাণ নিয়ে, কেউ আসছে গাড়ি নিয়ে আবার কেউবা আসছে হেলিকপ্টার নিয়ে। তারা সবাই এসেই নিজের হাতে বিতরণের জন্য চলে যাচ্ছে কোন না কোন স্পটে। আর যেসব স্থানের যোগাযোগব্যবস্থা অধিকতর ভালো সেখানকার লোকজন বেশি ত্রাণ পাচ্ছে, আর তুলনামুলকভাবে দুর্গম জায়গাগুলোতে শরণার্থীরা ত্রাণ কম পাচ্ছে। অপরদিকে এ সুযোগে পুরাতন শরণার্থী ক্যাম্পেরও কেউ কেউ ত্রাণ নিতে চলে আসছে। তাতে তেলা মাথায়ই তেল দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া প্রতিদিনই নতুন নতুন এসে যারা এসব স্থানে যোগ হচ্ছে তারা প্রায় ৪-৫দিন একটানা খেয়ে না খেয়ে আসার কারণে তাদের শরীর অধিকতর দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলশ্রুতিতে তারা দৌঁড়ে কিংবা অন্যান্যদের সাথে শক্তি প্রয়োগ করে পেরে উঠছেন না। সেজন্য তাদের বেশিরভাগকেই অভুক্ত থেকে দিন কাটাতে হচ্ছে।

তবে ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ থেকে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় নির্মাণ ও সুশৃঙ্খলভাবে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নিয়েছে যা খুবই আশার কথা। কারণ দেশি-বিদেশি শরণার্থীদের আর্ত মানবতার সেবায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিকল্প নেই। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে তারা তা বারবার প্রমাণ করেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শরণার্থীদের প্রতি মানবিক আচরণের প্রেক্ষিতে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন তুলনামূলক সংবাদও প্রচার হচ্ছে যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যেখানে রোহিঙ্গাদের অত্যাচার নির্যাতন করে তাড়িয়ে দিচ্ছে আর সেখানে বাংলাদেশের মানবিক সেনাবাহিনী তাদের নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

যাহোক, পদ্ধতিগতভাবে এবং সুশৃঙ্খলভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে না পারলে একদিকে যেমন ত্রাণপ্রার্থীরা বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অপরদিকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যেতে পারে। দেশের ভিতরে ঈদের আগে খয়রাতির মাল এবং জাকাতের পণ্য নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে শতশত মানুষের অনেক উদাহরণ রয়েছে। কাজেই যেহেতু রোহিঙ্গারা এদেশে এসেই পড়েছে এবং বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে আশ্রয়ও দিয়েছে কাজেই তাদের সব ধরনের মানবিক আচরণ করাটাই বাঞ্ছনীয়। যা প্রধানমন্ত্রী সর্বদা করে থাকেন।

কাজেই ত্রাণ বিতরণে জেলা প্রশাসনকে আরও সৃশৃঙ্খল ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনদিন কোন এলাকা কখন কাকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে তা সমন্বিত থাকলে সহজ হবে। এখন সে কাজটিই শুরু করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। কারণ সরকার যেহেতু একবার ত্রাণ আহরণে নেমে গেছে রোহিঙ্গাদের ত্রাণের কোন অভাব হবে না। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০০ টনের মতো ত্রাণ সংগৃহীত হয়েছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছেন। অনেক সাফল্যের সঙ্গে ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থাতেও আমাদের সাফল্য অব্যাহত থাকুক।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer