Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

কালের আয়না-পর্ব ১

পীর হাবিবুর রহমান

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ৬ অক্টোবর ২০১৭

আপডেট: ০০:০০, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯

প্রিন্ট:

কালের আয়না-পর্ব ১

ছবি : সংগৃহীত

সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী স্কুলে আমি তখন ক্লাস সিক্সে। ক্লাস থ্রিতেই এ স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম আমি। সিক্সে বি সেকশনে আমার রোল ছিল ২। সিক্স পর্যন্ত বড় আপার আঁচলে থেকে দস্যিপনার মধ্যেও আমার রেজাল্ট ভালো ছিল। কিন্তু আমার মন কখনো তথা কথিতজব ভালো ছাত্রদের কাতারবন্দী ছিল না। তাদের মতো সারাক্ষণ পড়ালেখা নিয়ে পরে থাকার চরিত্রও ছিল না। ক্লাস থেকে বাইরে সারাক্ষণ দুষ্টুমি, খেলাধুলা, হৈ চৈ আমাকে টেনেছে। ক্লাস সিক্সে জামালগঞ্জ থেকে এসে ভর্তি হয়েছিল সালাম তালুকদার। সে ছিল সিক্স বি সেকশনের ক্লাস ক্যাপ্টেন।

পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন ধর্মশিক্ষা পাঠ দেওয়া হেড মওলানা স্যার ছোটবেলা থেকেই আমার দস্যিপনার জন্য টার্গেট করেছিলেন। সিক্সে এসে তিনি ক্লাস ক্যাপ্টেন সালামকে বললেন, সকল সহপাঠীর স্বাক্ষর নিয়ে প্রধান শিক্ষক বরাবরে একটি আবেদন করতে। আমাকে যেন স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়। এ সেকশনের ক্যাপ্টেন ছিল সাহার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান অনুষদ থেকে স্নাতকত্তোর করা সাহারুল ইসলাম এখন সুনামগঞ্জ খ্যাতিমান সিভিল ল’ইয়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতোকত্তোর করা সালাম তালুকদার একটি বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। দুজনই আমার ছেলেবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সময়ে হেড মওলানা স্যার যদি আদেশটি সাহারকে করতেন তাহলে আমি নিশ্চিত আমার বন্ধু সবার স্বাক্ষর গ্রহণ অভিযান কাজটি শুরু করে দিত; সালাম সেখানে করেনি।
জলিল স্যার ছিলেন আমাদের আরেক বন্ধু সেই সময়ের ভালো ছাত্র জুনেদের বাবা। মেজাজী থাকলেও স্নেহময়ী ছিলেন। পরীক্ষার আগে সাজেশন দিয়ে দিতেন। সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষার আগে কৃষি বিজ্ঞানের পাঠ দেয়া জলিল স্যার দুই সেকশনকে এক করে সাজেশন দিতে গেলেন। কৃষি বিজ্ঞানে প্রশ্ন ১০ টি, লিখতে হতো ৫ টি। যদি ১১ টি প্রশ্ন আসতো তাহলে উত্তর দিতে হতো ৬ টির। জলিল স্যার প্রশ্ন দিলেন ১১ টি। আমি দাঁড়িয়ে বললাম, স্যার প্রশ্ন ১০ টি থাকার কথা; আপনি একটি বেশি দিয়েছেন। স্যার বিরক্তই হননি, রীতিমতো রেগে গিয়ে সাহারের কাছ থেকে নেয়া কৃষি বিজ্ঞান বইখানিই ছুঁড়ে মারলেন। সেই সাথে বললেন, ‘এখান থেকে একটি প্রশ্নও যদি না আসে, তাহলে আমার কান কেটে ফেলবো।’ সাহার শান্ত করতে এগিয়ে গেল, তিনি বললেন, ‘ওরে তোমরা সামলাও।’ আমরা বুঝে নিলাম জলিল স্যারের দেয়া ১১ টি প্রশ্নের যেকোনো ৬ টি পড়ে নিলেই কৃষি বিজ্ঞান পরীক্ষার প্রস্তুতি সম্পন্ন।

ক্লাস সেভেনে উঠার পর আরেক বিপদ নাজিল হলো। মুসলমান ছেলেদের জন্য আরবি নিতে হবে, হিন্দু ছেলেদের জন্য সংস্কৃত। আমার বন্ধু দেওয়ান ইমদাদ রেজা সংস্কৃত নিতে চায়, আমি নিজেও হেড মওলানা স্যারের হাত থেকে মুক্তি নিতে বা তার সঙ্গে বিদ্রোহ করতে জেদ ধরলাম, আরবি নয়, সংস্কৃতই নিবো। প্রধান শিক্ষক তখন আব্দুর রহমান স্যার। তিনি অনুপস্থিত। সহকারী প্রধান শিক্ষক সামসুদ্দিন আহমেদ কাজী স্যার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। পরবর্তীতে তিনিও প্রধান শিক্ষক হয়ে অবসর নেন। আমার বিষয়টি এক পর্যায়ে হেড মওলানা স্যারের বিরোধিতার কারণে তার কাছে গড়াল। কাজী স্যার আমাকে তলব করলেন। নীতিগত দিক থেকে যেকোনো ছাত্রের সংস্কৃত নেয়ার সুযোগ ছিল। স্যার এটি জানতেন। পিতৃহৃদয় নিয়ে তিনি আমাকে বুঝালেন, তুমি পীর বংশের ছেলে; সংস্কৃত কেন নেবে, আরবিই নাও। স্যারের কথায় না করতে পারিনি, আরবিই নিতে হলো।

এ বছরই ধর্মশিক্ষাও পড়াতেন হেড মওলানা স্যার। অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষায় সব বিষয়ে বন্ধু বেলাল ফেল করলেও ধর্ম শিক্ষায় ৫৬ পেয়ে চমক সৃষ্টি করলো। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, বাড়ির গাছের পাকা কাঁঠাল হেড মওলানা স্যারকে উপঠৌকন দিয়ে কাজ হাসিল করেছে। সকল সহপাঠীরা বিষয়টি অবগত হলেও এ নিয়ে হাস্যরসের কমতি ছিল না। কিন্তু হেড মওলানা স্যার ক্লাসে আসতেই আমি বলে উঠলাম, ‘তুম বি কাঁঠাল খায়া?’ তার কানে কথা বাজতেই গৌরবর্ণের চেহারা রাগে রক্তিম রূপ নিল। ডাস্টার ছুঁড়ে মারলেন আমার দিকে। সেদিন তার আর ক্লাস নেয়া হলো না।

সেবার ফাইনাল পরীক্ষায় আরবি পরীক্ষার দিন অংক পরীক্ষার চেয়েও আমি ঘামছিলাম। কারণ যত উপরের দিকে উঠছিলাম, অংক আমার যমের মতো ভয় লাগলো। ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠার সময় আমি থার্ড হয়েছিলাম। ফাইভ থেকে সিক্সে উঠার সময় পঞ্চম স্থান অধিকার করি। সেই সময় জুবিলী স্কুলে ৫ম স্থান পর্যন্ত যারা মেধা তালিকায় স্থান পেতেন তাদের পুরষ্কার দেয়া হতো। অন্যদিকে, বেতন দেয়া হতো ফ্রি করে। টিফিনের টাকা শুধু দেয়া লাগতো। টিফিনের টাকা তখন ছিল মাসে ২ টাকা। আমার লেখাপড়ার স্কুল ব্যাগ, বই-পুস্তক, পড়ার হিসাব নিকাশ সব ছিল আপার সঙ্গে। আপা মানে বার্মিংহামের কবরে শায়িত আমার জুুঁই আপা। তিনি ছিলেন স্কুল শিক্ষক। অসম্ভব নম্র ও মায়াময় আচরণের কারণে তার ছাত্রীরা এখনো তাকে স্মরণ করেন। ভালো ছাত্রীদের তিনি ভীষণ স্নেহ করতেন।
আমাদের জুবিলী স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়া হতো ৩০ ডিসেম্বর। এখনো মনে পড়ে, ১৯৭৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে উঠার রেজাল্ট নিয়ে যখন ঘরে ফিরি, তখন বাড়িতে প্রচুর লোক সমাগম। পরদিন আপার বিয়ে। তখন রান্না-বান্না, প্যান্ডেল বাড়ির মধ্যেই হতো। এখনকার মতো কমিউনিটি সেন্টার গড়ে উঠেনি। বাসায় ফিরে দেখি আমার জন্য আপা না খেয়ে বসে আছেন। আপা আমার কাজলা দিদি। কাজলা দিদি কবিতাটি যখন পড়তাম, তখন আমার মন খারাপ হতো। আপার মৃত্যুর পর কবিতাটি আমাকে ভীষণ টানে। এখনো আমি ইউটিউব খুলে আপার কথা মনে পড়লেই গানে গানে কাজলা দিদি শুনি।

আমার রেজাল্ট দেখার পর গোধুলী লগ্নে আপা আমাকে নিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারলেন। আপা চলে যাবার পর আমার আর ভালো রেজাল্ট হয়ে উঠেনি। আমি তখন মুক্ত বিহঙ্গের মতো অবাদ স্বাধীনতা ভোগ করছি। আমাকে শাসন করার লোক ছিল, বশ মানানোর লোক ছিল না; কি স্কুল, কি বাড়িতে। স্কুল এবং বাসায় দুরন্তপনা, দস্যিপনার জন্য নির্দয় প্রহারের শিকার হয়েছি। শিকার হয়েছি বলে, আমি আমার ছেলে-মেয়ে, ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগিনা-ভাগিনীদের প্রতি কখনো কঠোর হতে পারিনি। আমাদের সময় শুধু পরিবার স্কুলই নয়; আত্নীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, গোটা সমাজ শাসন করার ক্ষমতা রাখতেন। যেকেউ নালিশ করলে যাচাই বাছাই ছাড়াই পরিবার পীড়ন দিতেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ছুটি গল্পে যে ফটিক চরিত্রকে উন্মোচিত করেছিলেন, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমিই কবিগুরুর ফটিক। তিনি আরো বলেছেন, তের-চৌদ্দ বছরের মতো বালাই, পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। পাড়ার খেলার মাঠে বিকালে ফুটবল খেলেছি, আমার ঝাঁকড়া চুল বাতাসে উড়েছে বলে সেই দৃশ্যে মুগ্ধ না হয়ে পাড়ার স্কুল শিক্ষক ক্লাসে গিয়ে চুল ধরে বলতেন, তিনি যখন ফুটবল খেলেন তখন মনে হয় ঘোড়ার চুট্টির মতো তার চুল উড়ে। মনস্তাত্বিক পীড়নে যেমন ছিলেন সেকালের শিক্ষক, তেমন ছিলেন ট্রিপ্রিক্যাল আত্নীয় বা পরিজন।

ঝোঁপ-ঝাড় পরিবেষ্ঠিত তখন শহরের পাড়া মহল্লার রাস্তাঘাত। এত জনবসতি তখনো গড়ে উঠেনি। ছোট্ট শহরে কে কোন বাড়ির ছেলে, কে কার বোন, কে কার ভাই, কে কার পিতা সবাই চিনতেন ও জানতেন। মূল্যবোধের আবরণে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের বেষ্টনীতে বন্দী তখনকার শহর। সেই বন্ধন এখন অনেক ভেঙে গেছে। সেই সময় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বা খেলার মাঠের কোণায় জল বিয়োগ করেছি। সেটিও অনেক মুরব্বি মার্কা আপনজনেরা উঁকি দিয়ে দেখে বাড়িতে নালিশ করতেন। তার জন্যও বেত্রাঘাত সইতে হতো।

জুবিলী স্কুলে বাবর আলী সরকার স্যার প্রধান শিক্ষক হয়ে আসার পর স্কুলের শৃঙ্খলা ফিরে আসে, মান উন্নত হয়। তার ছেলে বকুল আমাদের বন্ধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণ রসায়ন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্য থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া বাবর আলী স্যাররা শিক্ষক হতেন বলেই আদর্শের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠতেন। কুড়াতেন সবার শ্রদ্ধা, আস্থা ও বিশ্বাস। শরীর চর্চা বিষয়ক শিক্ষক ছিলেন সামসুদ্দিন আহমদ যিনি পিআই স্যার হিসাবেই খ্যাত ছিলেন। সুঠাম দেহ, হাতে বেত; স্কুল বারান্দা দিয়ে যখন হাঁটতেন; তখন গোটা শহর যেন শান্ত হয়ে যেত। তার মতো জনপ্রিয় শিক্ষক জুবিলী স্কুলের ইতিহাসে আর কেউ আসেননি। মারতেন, শৃঙ্খলায় রাখতেন, আদর ভালোবাসায় সবার হৃদয় জয় করে নিতেন। খেলাধুলা, স্কাউটিং সব কিছুতে আমরা ছিলাম এগিয়ে। তার সন্তানদের বঞ্চিত করে পকেটের টাকায় আমাদের খাওয়াতেন।

সুনামগঞ্জে তার প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা, তাতে অবসরের পর এই শহরেই স্থায়ী হওয়া উচিত ছিল। ১৯৯১ সালে পেশাগত দায়িত্ব পালনে ময়মনসিংহ শহরে গেলে স্যারকে একনজর দেখতে গিয়েছিলাম। তার বাসায় একটি রাত থাকার জন্য কি আকুতি। কথা বলছিলেন, কথা দাও, আবার আসবে; কি মায়া! কথা রাখিনি। জীবনযুদ্ধে প্রিয় স্যারকে দেয়া অঙ্গিকার ভুলে গেছি। স্যারের মৃত্যুর পর বারবার মনে পড়ে, অপরাধবোধে ভুগি।

বাবর আলী স্যার চলে যাবার পর আব্দুর রহমান স্যার প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন। দবদবে সাদা প্যান্ট, শার্ট, চকচকে কালো শো আর কঠোর নিয়মের মধ্যে স্কুলকে নিয়ে আসেন, যেন দমবন্ধ অবস্থা। টানা তিনদিন যে ক্লাসের সকল ছাত্র উপস্থিত থাকতো সেই ক্লাসের সামনে অনার্স ফ্ল্যাগ (সম্মানী পতাকা) একমাস রাখার নিয়ম চালু করেছিলেন। টিফিন ডাবল করার নিয়ম চালু করেছিলেন। মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন ছাত্রদের দিয়ে। আমাদের বন্ধু সালাম তালুকদার একবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছিল। স্কুলের ছাত্ররা নোংরা পানির, নোংরা রঙের অস্বাস্থ্যকর আইসক্রিম খেলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পানিসমেন্ট খেত।

এখানে বলে রাখা দরকার, ‍মুক্তিযুদ্ধের আগে শহরের আরেক জাঁদরেল অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোহাম্মদ আলী স্যারের প্রতিষ্ঠিত কে জি স্কুলে পড়াশুনা করেছি। তার এক মেয়ে শিক্ষক ছিলেন অন্য মেয়েরা পড়াশুনা করেছেন। পিআই স্যারের ছেলে এখনকার ডাক্তার পারভেজ শামস সেই থেকে আমার বন্ধু। ১৯৬৩ সালের ১২ নভেম্বর বেলা ১২ টায় জন্মেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর অটো প্রমোশনে আপা আমাকে তার কালীবাড়ি স্কুলে ক্লাস টু তে ভর্তি করেছিলেন। না হয় আমার লেখাপড়া আরো এক দু’বছর এগিয়ে থাকতো। প্রথম যেদিন কে জি স্কুলে যাই, আমার সাথে ছিল পাড়ার ইয়াসমিন। আমাদের নিয়ে যান আমার মেজ ভাই মেসিভ হার্ট এ্যাটাকে অকালে চলে যাওয়া ছাবিত আহমদ পীর ও ইয়াসমিনের বড় ভাই যুক্তরাজ্য প্রবাসী কয়েস আহমেদ। দ্বিতীয় দিন স্কুলে যাওয়ার সময় আমাকে বলা হয়েছিল, ইয়াসমিনের সঙ্গে কয়েস ভাইয়ের সঙ্গে চলে যেতে। লজ্জায় আমি কেঁদে দিয়েছিলাম।

ছোটবেলায় এতটাই লাজুক ছিলাম, কোনো মেয়ে বড় বোনের বান্ধবীরাও নাম জিজ্ঞস করলে লজ্জায় কেঁদে দিতাম। অথচ হাঁটা শেখার পর চঞ্চল ছেলেকে নজরে রাখতে মা কোমড়ে গোঁঙড় বেঁধে দিয়েছিলেন। পাশের বাড়ির দাদারা বাসা বিক্রি করে ভারতে চলে যান। যতদিন ছিলেন, আমাকে নজরে রাখতেন। আমাদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল, যেন আত্নীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। শুধু খেলাধুলা, দস্যিপনায় নয়, এর বাড়ির ওর বাড়ির টিনের চালে ঢিল, পাড়া প্রতিবেশির দুপুরের ভাতঘুম ভাঙিয়ে দেয়া, বিচার-সালিশ; সবকিছুতেই মার খেয়েছি অনেক। অন্যায়ভাবে যখন বেত্রাঘাত করা হতো, জিজ্ঞেস করা হতো, আর কখনো করবি? আর কখনো করবি? মা কেঁদে দিতেন। আপা বলতেন, বল আর করবি না। আমি কোনো কথাই বলতাম না। ভিতরে যখন প্রবল জেদ আর একগুঁয়েমি। কারণ আমি কোনো অন্যায় করিনি। মারতে মারতে আমার অভিভাবকরা ক্লান্ত হয়ে যেতেন। হাতের তালু ফেঁটে যেন। কিন্তু আমি কখনো বলতাম, আর করবো না।

১৯৭৫ সালের পর এক অবন্ধকার সময় নেমেছিল বাংলাদেশে। জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার পরিজনসহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে সেনাশাসন আবির্ভূত হয়েছিল; সেই সময় সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের হাল ধরেছিলেন আমার অগ্রজ এ্যাড. মতিউর রহমান পীর। তখন উগ্রপন্থী, চরমপন্থী আর সেনাশাসনের বৈরী পরিস্থিতির মুখে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ছিল কার্যত একা। ছাত্রলীগের মিছিলে আওয়ামী লীগ পরিবারের স্কুল পড়ুয়া সন্তানদেরও ডেকে নেয়া হতো। সেখানে আমার স্কুল জীবনেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর ভালোবাসা আবেগ, অনুভূতি নিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে। সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের প্রথমে আহ্বায়ক পরবর্তীতে দু’বারের সম্মেলনে সর্বসম্মতিতে সভাপতি নির্বাচিত হন মতিউর রহমান পীর। ১৯৭৯ ও ৮১ সালে ছাত্রসংসদ নির্বাচনে প্রথম সুনামগঞ্জ কলেজে ছাত্রলীগের প্যানেল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ১৯৭৯ সালে নান্টু-ফজলু পরিষদ থেকে ভিপি পদে নান্টু রায় ছাত্র ইউনিয়নের ভিপির সঙ্গে সমান ভোট পেয়ে লটারিতে হেরে যান। এজিএস পদে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আনোয়ার চৌধুরী আনুল। তিনিসহ ৯ টি পদে ছাত্রলীগ বিজয়ী হয়। আনুলের বড় ভাই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মারুফ চৌধুরীর ৭৫ উত্তর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সাহসী ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তানরা ছাত্রীদের মধ্যে যেমন অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখেন তেমনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া ছাত্রীরাও সক্রিয় অবদান রাখেন। মরহুমা মির্জা কফতিয়া হাবিব, সালেহা বেগম, সঙ্গমিত্রা ভট্টাচার্য, নিশাত কবীর লিজি, জেসমিন আক্তার মিলন, স্মৃতি দিসহ অনেকের নাম নিতে হয়।

সুনামগঞ্জের ক্রিকেটে ওয়াইসিসির রানা ভাইয়ের নাম নিতেই হয়। অনেক ক্রিকেটার তৈরি করেছেন। ওয়াইসিসিতে স্কুল জীবনেই জেলা লীগে ওপেনার ছিলাম আমি এবং আমার বন্ধু জয়ন্ত তালুকদার মুন্না। মুন্নার বড় ভাই সুবীর তালুকদার বাপ্টু ৭৫ উত্তর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে আমাদের নেতা ছিলেন। একালের তরুণরা কতটা জানে জানি না, মতিউর রহমান পীরের সঙ্গে প্রথম জেলা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হায়দার চৌধুরী লিটন। তার পিতা এ্যাড. খলিলুর রহমান চৌধুরী একজন আদর্শিক আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। সেই সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মরহুম এ্যাড. আব্দুর রইছ এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মরহুম আব্দুর জহুর। দুজনই জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে ইন্তেকাল করেন। তাদের সততা নিয়ে শত্রুরাও প্রশ্ন তুলতে পারবে না।

সেই সময় রাজনীতি ছিল প্রকৃত অর্থেই গণমূখী ও আদর্শিক, মানবকল্যাণের জন্য নিবেদিত, আত্নত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত। সেই রাজনীতি আর কোনোদিন এদেশে ফিরে আসবে না। যেমন ছিলেন গণসংগঠনের নেতারা, তেমন ছিলেন ছাত্র রাজনীতির কিংবন্তীরা। তাদের রাজনীতিতে ব্যক্তিস্বার্থ কখনো প্রাধান্য পায়নি। বঙ্গবন্ধু ও মানুষের রাজনীতিকে তারা চিন্তা, চেতনায় লালন করেছিলেন। মানুষের মুক্তির রাজনীতি তারা করেছেন। ওয়াইসিসির হয়ে ব্যাটিং শেষে ছাত্রলীগের মিছিল দেখে ছুটে গেছি। রানা ভাই রাগ করেছেন, নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।
১৯৮০ সালের এসএসসি পরীক্ষার আগে টেস্ট পরীক্ষায় অংক পরীক্ষায় বসেছি। স্কুলের বাইরে আবুল হোসেন মিলনায়তনে (বিডি হল) ছাত্রলীগের নবীনবরণ অনুষ্ঠান। জমকালো অনুষ্ঠানে মরহুম আব্দুস সামাদ আযাদ, বাহালুল মনজুন চুন্নু, মুকুল বোসরা অতিথি হয়ে গেছেন। ছাত্রলীগের স্লোগান পীরক্ষার হলে কানে বাজছে। অংক পরীক্ষায় আমার মন বসে না। সরল অংক, চলিত নিয়ম সব বাদ দিয়ে শূণ্য খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে সেই অনুষ্ঠানে ছুটে গেছি। ১৯৮০ সালের ১৬ ডিসেম্বর জুবিলী স্কুলের স্কাউটিংয়ে শেষ কুচকাওয়াজ। স্টেডিয়ামে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আশরাফ আহমদ আমাদের স্কাউট টিচার মকবুল হোসেন স্যারের সঙ্গে অসদারচরণ করেছেন। স্যারের চোখের কোণে অপমানের অশ্রুবিন্দু, আমাদের ভেতরে দ্রোহ। কিন্তু কিছু বলি না।

ক্লাস নাইনে আমাদের শ্রেণী শিক্ষক সাইফুদ্দিন আহমেদ পীর আমার ভাতিজা বাড়িতে এসে আমাকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে ফুসফুস করেন। ক্লাসে চাচাকে কিছু বলতে পারেন না। ইংরেজির শিক্ষক সাইফুদ্দিন আহমেদ পীর অকালে হৃদরোগে ইন্তেকাল করেছেন। একদিন সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় অন্যদিনের মতো তিনি আসেন। এক পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের মকবুল হোসেন স্যারকে এসডিও যে অপমান করেছেন, তোমরা কিছু করবা না? আমি তখন অস্থির চিত্ত নিয়ে পড়ার টেবিলে, সামনে এসএসসি। আমাকে নিয়ে রেজাল্ট কি হয়, বাড়ির সবাই টেনশনে। এরমধ্যে শহরে শীতের যাত্রাপালা চলছে। বাংলো ঘরে তখন আমি থাকি ও পড়ি। মধ্য রাতে মাইকের আওয়াজ আসে। প্রিন্সেস টিনা খান এক দৌঁড়ে বুলচাঁন্দ হাইস্কুলের মাঠে দৌঁড়ে যাই। সিনিয়র বড় ভাইয়েরা একটা ভিআইপি তাবুঘেরা প্যান্ডেলে বসাতে নিয়ে যান। অগ্রজ মতিউর রহমান পীর গ্রামের ছাত্রদের ভোটের জন্য যাত্রা ঢুকিয়ে দিয়ে বাড়িতে এসে ঘুমাতেন। তাকে দেখেই চাদরে মুখ ঢেকে আমি পালিয়ে যাই। সামনের সারিতে ৫ টাকার টিকেট কেটে বসে যাই। টিনা খান নাচে, সবার সঙ্গে আমিও দেখি।

সাইফুদ্দিন স্যারের প্রস্তাবে সাহস পেয়ে যাই। শিক্ষকরা তো আমাদের সঙ্গেই আছেন। কারণ এর আগে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তখন এমপি ও পৌর চেয়ারম্যান মরহুম মেজর ইকবাল হোসেন চৌধুরী। অমিয়াংশু স্যার যার চিবুক ছুঁইয়ে রূপের মাধুর্য্য ছুঁইয়ে পরতো, তিনি ও প্রমথ স্যার অংক করাতেন। অমিয়াংশু স্যারের কাছে তুহিন, কুসুম, ময়না, রেজান, তারেক যারা কর্মাস নিয়েছিল তারা প্রাইভেট পড়তো। অমিয়াংশু স্যারকে দেয়ার জন্য তুহিনের টাকা অন্য বন্ধুরা মেরে খেয়েছে। অমিয়াংশু স্যার বুঝতে পেরে লাজ-নম্র হাসি দিয়েছেন। স্কুলে যাবার পথে এই বন্ধুরা বলছিল, সেনাশাসক জিয়াউর রহমান এসএসসি পরীক্ষার্থীদের দুজন নিরক্ষরকে অক্ষর-জ্ঞানের যে ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করেছেন; সেটি ছাত্র সরবরাহের দায়িত্ব পৌরসভার। যেই বলা সেই কাজ। স্কুলে গিয়েই আমরা মিছিল বের করি, নিরক্ষর ছাত্র পৌরসভাকে সরবরাহ দিতে হবে। কিন্তু এটি কোনো নিয়ম ছিল না। নিরক্ষর খুঁজে বের করার দায়িত্ব ছাত্রদের। সে আর এক এলাহী অবস্থা। কেউ বাড়ির কাজের বুয়া, কেউ গৃহকর্মী নিয়ে আসে। বন্ধু সাফকাত ক্লাস এইটে গিয়ে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। কলমা বুয়াকে তার চাচার বাড়ি থেকে ছাত্রী হিসাবে নিয়ে আনে। আমি আনি ফাইভ পাস রিক্সাচালক বেনু স্যার। আমার ছাত্রের অক্ষরজ্ঞান দেখে বলেছিলেন, ছাত্রের দেখি শিক্ষকের চেয়ে যোগ্যতা বেশি।

আমাদের সেই আন্দোলনে কলেজ ছাত্রসংসদের ভিপি সামসুন্নাহার বেগম শাহানা, জিএস জাসদ থেকে নির্বাচিত মাহফুজ ও এজিএস ছাত্রলীগের আনোয়ার চৌধুরী আনুলরাও এসে যুক্ত হন। তখন আমাদের প্রধান শিক্ষক সুদর্শন রাজ্জাক আলী স্যার। স্কুল কর্তৃপক্ষ এই ঘটনাকে শৃঙ্খলাভঙ্গে অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। এই আন্দোলনে আমি ছাড়াও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহ আবু তারেক মুসলিম হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র জাসদের সাইফুল ইসলাম ও হৃদরোগে অকাল প্রয়াত জাসদ ছাত্রলীগের আবদুস সালাম যাকে সবাই বাজারে সালাম বলতো কারণ তার বাসা ছিল বাজারসংলগ্ন মুক্তারপাড়ায়। শিক্ষকরা তদন্ত করতে গিয়ে একটি ফরম দিলেন, সেখানে জানতে চাইলেন কারা তোমাদের এই আন্দোলনে প্ররোচিত করেছে? কারা তোমাদের এই মিছিলে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে?

আজকের গাইনোকোলজিস্ট ননীভূষণ রায় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা রজব আলী ছাড়া সবাই আমাদের ৪ জনের নাম লিখিত দিয়েছে। শিক্ষকরা আমাদের বহিষ্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন। বিশেষ করে আমার নাম শীর্ষে দেখে সেই হেড মওলানা ভীষণ খুশি, তিনি খুবই তৎপর। আমি, সালাম ও তারেক টেনশনে হাঁটি। বাড়িতে জানলে মহাবিপদ। এসএসসি পরীক্ষার আগে রাজটিকেট পেলে ভবিষ্যত অন্ধকার। একদিন বিকাল তিনজন জুবিলী স্কুলের সামনে যখন চিন্তামগ্ন হয়ে যাচ্ছিলাম, তখন দেখি বারান্দা দিয়ে প্যান্টের দু’পকেটে হাত ঢুকিয়ে সুদর্শন হেড মাস্টার রাজ্জাক আলী স্যার হেঁটে যাচ্ছেন। আমরা স্কুলের ভিতরে প্রবেশ করি। তখনো স্কুলের ভিতরে একটি ভবন কাঠের পাটাতনের ওপরে ছিল। সেখানে গিয়ে স্যারকে সালাম করে বসি। স্যার আমাদের তার বাসভবনে নিয়ে যান। চা, সিংগারা খাইয়ে গভীর মমতায় আমাদের সহপাঠীদের লিখিত মতামত দেখিয়ে বলেন, তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষকদের মতামত। কিন্তু আমি খুশি তোমাদের ভুলের জন্য তোমরা অনুতপ্ত। কাল বিকালে আসো, আমি দেখি, কি করা যায়? পরদিন বিকালে আমরা রাজ্জাক আলী স্যারের বাসভবনে যাই। স্যার ভিতরে গেলে আমরা ফন্দি আঁটি তথাকথিত ভালো ছাত্রদের যেভাবেই হোক আমাদের সঙ্গে বেত্রাঘাত খাওয়াতে হবে। কারণ স্যার বলেছেন, আমি তোমাদের দু’টো করে বেত মারবো-এটাই তোমাদের সাজা। স্যার ভিতর থেকে আসার পর আমরা বললাম, আপনার কাছে ক্ষমা চেয়েছি-এটা জেনে আমাদের বন্ধুরা আমাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করছে। আমাদের তখন কেঁদে দেয়ার অবস্থা। স্যার শুনে বললেন, তোমরা তো আত্নপোলব্ধি করেছো-এটি মহত্বের লক্ষণ। কারা ঠাট্টা করেছে তাদের নাম লিখে দাও। আমরা সাহার, বাবলু, নাসিমসহ যারা মনস্তাত্বিক দিক থেকে আমাদের বিপরীত মেরুতে এমন ১৭ জনের নাম দিলাম। বিশ্বজিৎ নামের দু’জন সহপাঠী আমাদের ছিল। একজন আমার প্রতিবেশি আরেকজন নতুনপাড়ার। নতুনপাড়ার বিশ্বজিৎ’র সাথে সালামের পুরোনো ঝামেলা। সালাম তার নামও ঢুকিয়ে দিল। ১৭ জনের নাম স্যারের হাতে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরলাম।

পরদিন ক্লাসে গিয়ে আমাদের টেনশন হঠাৎ অফিস সহকারী এসে আমাদের তিনজনকে স্যারের কক্ষে ডেকে নিয়ে গেল। ক্লাসের সহপাঠীরা বিশেষ করে বিজ্ঞান বিভাগের ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখা বন্ধুরা টিপ্পনী কাটলো। স্যার তার কক্ষে আমাদের বাড়ানো হাতে দু’টো করে বেত্রাঘাত দিলেন। মন খারাপ করে শ্রেণীকক্ষে এসে বসলাম। স্যার তো আসেন না। যাদের নাম দিয়েছিলাম তাদের পানিসমেন্ট হচ্ছে না। আমাদের তিনজনের মন খারাপ। সাইফুলকে আগেই আমরা বাইরে রেখেছি। শহরের সঙ্গে ছাত্রাবাসের বন্ধুদের মনস্তাত্বিক দূরত্ব ছিল। কিছুক্ষণ পর স্যার এসে ঢুকলেন ক্লাসে। পিছনে বেত ও তালিকা হাতে অফিস সহকারী মখয় ভাই। মখয় নাম ডাকছে, ভালো ছাত্ররা একে একে দাঁড়াচ্ছে। স্যার তাদের বেত্রাঘাত করছেন। আমাদের মনে তখন ঈদের খুশি।

এরপর মকবুল হোসেন স্যারকে অপমানের ব্যাপারে সাইফুদ্দিন স্যার যখন ইঙ্গিত দিলেন আমি তারেক ও সালামকে নিয়ে মুসলিম হোস্টেলে সাহারের কাছে। আলাপ-আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ছাত্র আন্দোলনের। সে রাতে হোস্টেলেই থাকলাম। সকালে প্রথম ডালের পানির স্বাদ নিলাম সালাম তালুকদারের তত্ত্ববধানে। ক্লাস থ্রির শ্রেণীকক্ষ ছিল সবচে বড়। সেখানেই আমরা ছাত্রসভা ডাকলাম। সভাপতিত্ব সাহারকে দিলাম। বক্তা আমিই হলাম। সেই থেকে বক্তৃতার পাঠ নেয়া। আমরা তুমুল ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুললাম। শহরে ১৪৪ জারি চলছে। মাইকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। তখন জেলা সমন্বয়কারী ছিলেন এমপি সৈয়দ রফিকুল হক। তিনি এসে মহকুমা প্রশাসকের পক্ষে ক্ষমা চাইলেন। আন্দোলনের ইতি ঘটলো।

পরবর্তীতে আমরা এসএসসি পরীক্ষার্থীগণ বৈঠক করলাম। তথাকথিত ভালো ছাত্রদের হয়ে সাহারসহ সবাই বললো, আমরা বাংলা, অংক, ইংরেজিতে পরীক্ষা দিবো। এই দাবি নিয়ে রাজ্জাক আলী স্যারের বাসভবনে গেলাম। বিজ্ঞানের ছাত্ররা অংক ও ইংরেজিতে ভালো। মানবিক ও কমার্সে আমরা যারা পড়ি সেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে অংক ও ইংরেজি ভয়ের বিষয়। স্যারের সামনে যাওয়ার পর স্যার বললেন, বিবেচনার দায়িত্ব আমার। মনতাজ আলীর মতো ছেলে যেখানে ইতিহাসে ২২ পায়, সেখানে তোমরা কি করবে? আমরা সাহারদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলাম। বললাম, স্যার আপনি যা বলবেন, তাই হবে। সাহারদের মন খারাপ হয়ে গেল। আমরা হৈ হৈ করে ফিরে এলাম।

সেবার এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় সংবর্ধনায় স্যাররা আমাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। টেস্ট পরীক্ষায় ৩ বিষয় পর্যন্ত যারা অকৃতকার্য হয়েছে রাজ্জাক আলী স্যার তাদের এসএসসি দেয়ার সুযোগ দিলেন। এখানে একটি বিষয় না বললেই নয়, হরিচরণ স্যার প্রধান শিক্ষক হয়ে অবসর নিয়েছেন। তিনি ও তার সন্তানরা দারুণ গান গাইতেন। হরিচরণ স্যার মারতেন না, স্নেহের বাঁধনে আটকাতেন। ক্লাস নাইনে শ্রেণী শিক্ষক হিসাবে আমার জন্য তিনি ক্লাস নিতে পারতেন। একবার ক্লাসে এসে আমাকে দুই টাকা দিয়ে বললেন, বাবারে তুই ঘুরে আয়; আমি ক্লাসটা নিই। আমি স্যারের টাকা নিয়ে বাইরে যাই, এটা-ওটা খাই, ফূর্তিতে সময় কাটাই। তিনদিন পর বললেন, এমন হলে তো তোর পড়ালেখা হবে না। বাবা তুই ক্লাসে চলে আয়। আমি আবার ক্লাসে সুবোধ বালকের মতো চলে এলাম। অংক আমার মাথায় ঢুকতো না। প্রাইভেট শিক্ষক হিসাবে আমি, তুহিন, সাফকাত সাইফুদ্দিন স্যারের কাছে পড়েছি। অংকে কেউ আমাকে ভাগে আনতে পারলেন না।

এইচএমপি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ধূর্যটী কুমার বসু, রাখাল স্যার বলেই যিনি খ্যাত। বড় ভাইয়ের শিক্ষক তার অনুরোধে তিনি প্রাইভেট পড়াতে রাজি হলেন। অংক করতে দিলে ভুল করতাম। তিনি বলতেন, বাহ-দারুণ করেছিস। মার বেটা আমার পিঠে ঘুষি মার। আমাকে তিনি হিপনোটাইজ করে ফেললেন। অংকে এসএসসি পরীক্ষায় ৩৩ পেয়ে জানে বাঁচলাম। যে দশজন মানবিক বিভাগে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হলো-আমি তাদের একজন। স্যার নিজেই বিস্মিত। এসএসসি পাসের জন্যই জন্য, লেখাপড়ার জন্য আমি যে তিনজনের কাছে ঋণী, তাদের একজন রাজ্জাক আলী স্যার। অন্য দুজন রাখাল স্যার ও সাইফুদ্দিন স্যার। ইংরেজিটা সাইফুদ্দিন স্যার পানির মতো পড়াতেন। অংকে এসএসসিতে আমি জ্যামিতি বক্স নিয়ে যাইনি। সরল অংকে মার্ক ছিল ২০। সেটি কনফার্ম করলাম। চলিত নিয়ম করেই বীজগণিতে দুটো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এলাম। সরল ও চলিত নিয়মে ৩০ পাক্কা হয়ে গেল। বীজগণিতের ৬ মার্কে ৩ কাটা পড়লো, ৩ পেয়ে গেলাম। ৩৩ এ এএসসি উত্তীর্ণ হয়ে গেলাম।
স্কুল জীবনে পাঠ্য বইয়ের চেয়ে গোয়েন্দা সিরিজ আমাকে বেশি টেনেছে। কুয়াশা, দুস্য বনহুর, দস্যু বাহারাম ও নীহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা উপন্যাস আমাকে টেনেছে।

চলবে...

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer