Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

একজন ‘নায়করাজ’ ও বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্র

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ০২:১২, ২৩ আগস্ট ২০১৭

আপডেট: ০২:২০, ২৩ আগস্ট ২০১৭

প্রিন্ট:

একজন ‘নায়করাজ’ ও বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্র

ঢাকা : বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক রাজ রাজ্জাকের আবির্ভাব খুবই সাদামাটাভাবে। কিন্তু যখন তিনি আবির্ভূত হলেন তারপর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারিতে কলকাতার টালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। মৃৃত্যুবরণ করেন ২০১৭ সালের বাঙালির শোকের মাস আগস্টে তাও আবার ২১ আগস্ট ঘৃণ্য গ্রেনেড হামলার দিনে।

এদিন তিনি বিকাল ৫ টার দিকে অসুস্থ বোধ করলে সাথে সাথে রাজধানী ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালের নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকবৃন্দের সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে সন্ধ্যা ৬ টা ১৩ মিনিটে তিনি ইহকালের সকল মায়া ত্যাগ করে চলে যান পরপারে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

বাংলা চলচ্চিত্রের যেমন একটি অতীত গৌরবোজ্জল ইতিহাস রয়েছে তার একেবারে সাথে সাথে চলেছেন এ কিংবদন্তী ‘নায়করাজ’ রাজ্জাক। আমরা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব ১৯৫৫ সালে ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সবাক জগতে প্রবেশ করি। কলকাতার টালিগঞ্জে তাঁর জন্মভূুমিতে ছোটদের জন্য লেখা ‘বিদ্রোহী’ নাটকে কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর শুরু। তারপর ১৯৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাকালে শরনার্থী হয়ে তিনি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে পাড়ি জমান। এখানে এসে প্রথমেই পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামক একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে ব্যাপক দর্শক প্রিয়তা অর্জন করেছিলেন এ শিল্পী। তারপর বহু প্রতিকুলতা পেরিয়ে তিনি পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের সাথে সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুয্গো পাান বাংলা চলচ্চিত্রে।

তিনি সালাউদ্দিন প্রোডাকশান্সের ব্যানারে ‘তেরো নম্বর ফেকু ওস্তাগড় লেন’ নামক চলচ্চিত্রে ছোট্ট একটি চরিত্রের মাধ্যমেই নিজের অভিনয় প্রতিভার সাাক্ষর রাখতে সমর্থ হন। পরবর্তীতে ‘কার বউ’, ‘ডাক বাবু’, ‘আখেরী স্টেশনসহ আরো কয়েকটি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় সাক্ষরের পওে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ নামক চলচ্চিত্রে সর্বপ্রথম নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। অতঃপর একের পর কালজয়ী সিনেমায় অভিনয় এবং দর্শক প্রিয়তার শীর্ষে গমণ করেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ এ গুরুত্বপূর্ণ অভিনয় করেন। তিনি বাঙালির ভাষা আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ ছবি ‘অলোর মিছিল’, ‘জীবন থেকে নেয়া’ তে অনবদ্য অভিনয় করেন।

তারপর একে একে ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘কখগঘঙ’, ‘স্বরলিপি’, ‘পাগলা রাজা’, ‘পরিচয়’, ‘প্রিয়তমা’, ‘প্রতিশোধ’, ‘পুত্রবধূ’, ‘রজনী গন্ধা’, ‘রংবাজ’, ‘সমাপ্তি’, ‘সোনা বউ’, ‘লাইলী মজনু’, ‘সেতু’, ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘শ্লোগান’, ‘সোনালী আকাশ’, ‘তালাক’, ‘নাগিন’, ‘নূতন পৃথিবী’, ‘নাজমা’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘ঘরনী’, ‘ঝড়ের পাখি’, ‘কাবিন’, ‘কাজল লতা’, ‘কালো গোলাপ’, ‘নাতবৌ’, ‘আনোয়ারা’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘আশার আলো’, ‘অভিযান’, ‘এতা টুকু আশা’, ‘পীচঢালা পথ’, ‘মনের মত বৌ’, ‘ময়নামতি’, ‘দীপ নিভে নাই’, ‘দর্পচূণর্’, ‘যোগ বিয়োগ’, ‘মধুমিলন’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘নাচের পুতুল’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘বেঈমান’, ‘সাধু শয়তান’, ‘অমর প্রেম’, ‘অলংকার’, ‘আসামী’, ‘সোহাগ’, ‘মাটির ঘর’, ‘আনার কলি’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘শুভদা’, ‘রাজলক্ষী শ্রীকাš’Í, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘নিঃস্বার্থ ভালবাসা’, ‘অন্যরকম ভালবাসা’সহ প্রায় তিন শতাধিক বাংলা ও উর্দু ছবিতে অভিনয় করে বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়কের আসনে বসেছেন।

তাঁর বিশেষ সংলাপ ভঙ্গি ও কথোপকথনের জন্য তৎকালীন সাপ্তাহিক চিত্রালীর সম্পাদক আহমেদ জামান চৌধুরী তাঁকে ‘নায়ক রাজ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এবং সেটাই তাঁর জন্য যথোপযুক্ত ছিল। তাঁর সময়কার ও সমসাময়িক সহ অভিনেত্রী ও জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন তাঁেদর মধ্যে সুজাতা, সুচন্দা, শবনম, কবরী, শাবানা, ববিতা, অঞ্জনা, সুচরিতা, রোজিনা প্রমুখই প্রধান। ভারতীয় বাংলা সিনেমায় উত্তম কুমার যেমন ছিলেন মহানায়ক এবং উত্তম-সুচিত্রা জুটি ছিল খ্যাতিমান, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের রাজ্জাক-কবরী, রাজ্জাক-শাবানা, রাজ্জাক-ববিতা, রাজ্জাক-শবনম ইত্যাদি নানা নামের জুটি নাম করেছিল তখন। তাঁর সমসাময়িক নায়ক ও পার্শ্ব চরিত্রে কাজ করেছেন রহমান, সিডনী, বুলবুল আহমেদ, রাজ, আনোয়ার হোসেন, খলিল, বাবর, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, ওয়াসিম, জাবেদ, ফারুক, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন প্রমুখ।

ঐসময়কার রুপালি পর্দার ছবিগুলোকে এখন শুধু হারানো দিনের বা সোনালী দিনের ছবি হিসেবেই গণ্য করা হয়ে থাকে। তখনকার ছবিগুলো কাহিনী, সংলাপ, ঘটনার বিশ্লেষণ ইত্যাদিতে মনোরঞ্জন ও আমোদের পাশাপাশি একেকটি শিক্ষণীয় বাণী থাকত। তখন অভিনয়ের জন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ ছিলনা। তখন দীর্ঘদিনে একেকটি সিনেমা তৈরী করা হতো। কিন্তু তারপরও রাতারাতি তারকাখ্যাতি অর্জনের প্রবনতা করো মাঝেই লক্ষ করা যায়নি। ষাট, সত্তর এমনকি আশির দশকেও সিনেমাই ছিল একমাত্র বিনোদন মাধ্যম। সিনেমা হলের ছিল জমজমাট ব্যবসা। রাজ্জাকের সিনেমা মানেই হলের সকল শো’র সকল টিকেট শেষ। কিন্তু তখন সিনেমাগুলোতে কোন অশ্লিলতা ছিলনা।

বর্তমানে সবাই রাতারাতি তারকা বনে যেতে চায়। সিনেমার মধ্যে নানারকম অশ্লীলতা গ্রাস করেছে। ছবিতে কাহিনী, সংলাপ কিংবা দর্শকদের জন্য না থাকছে শিক্ষণীয় কিছু না থাকছে বিনোদন। সেজন্য এখন সিনেমা হলগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে সুপার মার্কেট গড়ে উঠেছে। তাছাড়া এখন ডিজিটাল যুগে ঘরে বসেই এমনকি একটি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনেই সকল ধরনের দেশি বিদেশি সিনেমা দেখতে পারছে দর্শকবৃৃন্দ।

অথচ এখন দেশে অভিয় শেখনোর জন্য এবং এ নিয়ে গবেষণা করার জন্য অনেক প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রের উপর উচ্চশিক্ষার একধিক বিভাগ রয়েছে। সেখানে এখন আর কোন নায়ক রাজ রাজ্জাক তৈরী হচ্ছে না। নায়ক রাজ রাজ্জাকের মৃত্যুতে তাই সারাদেশের মানুষ কাঁদছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সকল পর্যায়ের মানুষ তাঁকে শোক জানাচ্ছেন। কারণ তিনি ব্যক্তির গণ্ডি পেরিয়ে একটি বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পেরেছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় এমন কোন পুরস্কার নেই যা তিনি পান নি। তিনি পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সর্বশেষ গৌরবময় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানই।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer