চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসটি শনাক্ত হয়। এরপর থেকে প্রতিদিনই লাখ লাখ মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং সেইসঙ্গে মৃত্যুর মিছিলো হচ্ছে দীর্ঘ। ভাইরাসটি প্রতিনিয়ত ধরন বদলানোয় এটিকে সহজে আয়ত্তে আনা সম্ভব হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ভাইরাসটি রাজত্ব করে চলায় জনমনে তৈরি হয়েছে নানান প্রশ্নের। কবে নিমূল হবে ভাইরাসটি অথবা আদৌ শেষ হবে কিনা?
শিগগিরই বিদায় নিচ্ছে করোনা!
তবে, আশার কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, হয়তো খুব শিগগিরই এর রাজত্ব শেষ হবে।
বিজ্ঞানীদের অনেকে মনে করেন, করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে এবং তার ফলে এটি দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এছাড়াও সারা বিশ্বে লোকজনকে টিকা দেওয়ার কারণে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা। এসব থেকে ধরে নেওয়া যায় যে মহামারির সময় ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
তারা বলছেন, ইতোমধ্যেই কোভিড মহামারি ‘শেষ হয়ে যেতে শুরু‘ করেছে। এটি যে এখন শেষ পর্যায়ে তার লক্ষণ স্পষ্ট।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে মহামারির পরে কী? জীবন কি আগের অবস্থায় ফিরে যাবে, নাকি তৈরি হবে নতুন কোনো পরিস্থিতি? ভাইরাসটি কি এই পৃথিবী থেকে একেবারেই উধাও হয়ে যাবে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো সন্দেহ নেই যে কোভিড থাকবে, কিন্তু সেটা `প্যান্ডেমিক` হিসেবে নয়, থাকবে `এন্ডেমিক` হিসেবে।
অর্থাৎ আমাদের সামনে কোভিড-পরবর্তী নতুন এক বিশ্ব আসন্ন যেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মহামারির মতো এতো মানুষের মৃত্যু না হলেও, এই অসুখটি আর দশটি সাধারণ রোগের মতোই থেকে যাবে।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যে লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর জুলিয়ান হিসকক্স বিবিসিকে জানান, বলা যায় যে এরকম পরিস্থিতিতে আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। বলতে পারেন মহামারি শেষ হতে শুরু করেছে। অন্ততপক্ষে যুক্তরাজ্যে। আমার মনে হয় ২০২২ সালে আমাদের জীবন প্যান্ডেমিকের আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।
করোনাভাইরাসের দুর্বল ভ্যারিয়েন্ট- ওমিক্রনই তার অন্যতম লক্ষণ। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই ভ্যারিয়েন্ট যত বেশি ছড়াবে ভাইরাসটি ততোই দুর্বল হয়ে পড়বে। এবং এর মধ্য দিয়েই অবসান ঘটবে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সঙ্কটের।
এবিষয়ে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর জানান, খুব শিগগিরই বর্তমান মহামারির অবসান হচ্ছে না।
তিনি বলেন, গত একশ বছরে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন ভাইরাসের প্যানডেমিক পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সেসব মহামারি এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সেই বিবেচনায় হয়তো বলা হচ্ছে যে এটাই হয়তো শেষ বছর। কিন্তু এখানে অন্য প্রশ্নও রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দুটো সম্ভাবনা আছে। আমরা ওমিক্রনের যত মিউটেশন দেখছি সেটি আবার ততোই সংক্রমিত হচ্ছে। যখনই ভাইরাস ব্যাপক ট্রান্সমিশনে থাকে তখন ভাইরাসের আরও বেশি মিউটেশনের সম্ভাবনা থাকে। তখন হয়তো ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। আবার শক্তিশালীও হতে পারে। একারণে প্যান্ডেমিক শেষ হয়ে যাচ্ছে কীনা সেটা বলার জন্য আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, যেখানে এখনও প্রতিদিন ২০/২৫ লাখের ওপর রোগী হচ্ছে, পাঁচ থেকে সাত হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে সেখানে কোনো ভ্যারিয়েন্ট দুর্বল হয়ে যাচ্ছে- এই ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো সময় এখনও আসেনি।
বিজ্ঞানীরা মহামারি শেষ হওয়ার পেছনে দুটো কারণ দেখছেন। একদিকে ভাইরাসের দুর্বল হয়ে পড়া এবং অন্যদিকে ভাইরাসের হোস্ট অর্থাৎ মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত দু`বছরে পৃথিবীর ৩২ কোটিরও বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং এর হাত থেকে রক্ষা পেতে বহু মানুষ টিকা নিয়েছে, যার ফলে তাদের দেহে ভাইরাসটি প্রতিরোধ করার জন্য এন্টিবডি তৈরি হয়েছে। এছাড়া ভাইরাসটি রূপান্তরিত হতে হতে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞানীরা ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কথা উল্লেখ বলছেন, এটি আগের যেকোনো ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক হলেও, রোগীকে আগের মতো কাবু করতে পারে না এবং এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যুর হারও অনেক কম।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর সামনে দুটো সম্ভাবনা রয়েছে। হয় কোভিড পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যাবে যেমনটা পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ইবোলো ভাইরাসের বেলায় হয়েছে। অথবা এটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে আমাদের মধ্যে দীর্ঘসময় ধরে সাধারণ সর্দি কাশি, এইচআইভি, হাম, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মার মতো রয়ে যাবে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন কোভিডের বেলাতেও ঠিক সেরকমটাই ঘটতে যাচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ভাইরোলজিস্ট ড. এলিজাবেটা গ্রোপেলি বিবিসিকে বলেছেন, আমি খুব আশাবাদী যে আমরা খুব শিগগিরই এমন এক পরিস্থিতিতে পৌঁছাবো যেখানে ভাইরাসটি ছড়াতে থাকবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ লোকজনকে রক্ষায় আমাদের কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সাধারণ লোকজনের খুব একটা অসুবিধা হবে না।