
বাঘ সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২৯ জুলাইকে আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাঘ দিবসটি ২০১০ সালে রাশিয়ায় সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথম পালিত হয়। বাঘের ইংরেজি নাম Tiger এবং বৈজ্ঞানিক নাম Panthera tigris.
টাইগার নামটি গ্রিক শব্দ ‘টাইগ্রিস` থেকে এসেছে যার উৎপত্তি ফার্সি বা ইরানি শব্দ থেকে। শব্দটির দ্বারা একটি তীরকে বোঝায়, যা তার লক্ষ্যটির দিকে অটল ফোকাস নিয়ে গতি করে। বাঘ নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। তাই চলুন বাঘ নিয়ে চমৎকার কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক-
* বর্তমানে মাত্র ১৩টি দেশে বাঘের অস্তিত্ব টিকে রয়েছে। এই ১৩টি বাঘ সমৃদ্ধ দেশকে বলা হয় Tiger Range Country (TRC)। দেশগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, ভুটান, নেপাল, থাইল্যান্ড, চীন, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও রাশিয়া।
* মোট ৬টি দেশের জাতীয় পশু হিসেবে বাঘ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সাইবেরিয়া।
* বাঘের আটটি উপ-প্রজাতির মধ্যে ইতোমধ্যে বালিনিজ, জাভানিজ ও কাম্পিয়ান টাইগার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে বাঘের পাঁচটি উপ-প্রজাতি বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান টাইগার, সুমাত্রান টাইগার, সাউথ চায়না টাইগার এবং ইন্দো-চায়না টাইগার কোনোরকমে টিকে আছে।
* ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বে বাঘের সংখ্যা ৩,৮৯০টি। যার মধ্যে ৭০% বাঘ আছে ভারতে।
* ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে ২০১৫ সালে বাঘ শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিলো ১০৬টি। ২০১৮ সালের শুমারিতে এ সংখ্যা পাওয়া গেছে ১১৪টি।
* বিড়াল প্রজাতির মধ্যে বাঘ সবচেয়ে বড় প্রাণী। ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন গ্রুপ (ডাব্লিউডাব্লিউএফ) এর তথ্য অনুযায়ী একটি বাঘের ওজন ৩০০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর বাঁচে ২৬ বছর পর্যন্ত।
* বাঘের মাথা থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ২৮০ সে.মি.। এখানে শুধুমাত্র লেজর মাপ ১০০ সে.মি.। উচ্চতা হয় ১১০ সে.মি.।
* বাঘের মস্তিষ্ক বড় হয় যার ওজন ৩০০ গ্রামের মত এবং বাঘের স্মৃতিশক্তি অনেক ভালো। বাঘের স্বল্প মেয়াদী স্মরণশক্তি মানুষের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি।
* ৩০০ কেজি ওজনের একটা বাঘ ৫ মিটার পর্যন্ত (প্রায় ১৫ফুট) লম্বা লাফ দিতে পারে। পেছনের পাগুলি তার সামনের পাগুলির চেয়ে লম্বা হওয়ার ফলে তারা অনেক বেশি দূরত্বে লাফ দিতে সক্ষম হয়।
* বাঘ ঘন্টায় প্রায় ৬০-৬৫ কি.মি. বেগে দৌড়াতে পারে। যদিও এরা হেলেদুলে চলতেই বেশি পছন্দ করে।
* বাঘের পেনিসে স্পাইন (কাঁটা) থাকে। এর ফলে এদের মেটিং (প্রজনন) স্ত্রী বাঘের জন্য কষ্টদায়ক হয়। উত্তেজিত হলে বাঘের পেনিস খাড়া হয়ে যায় না। তাদের লিঙ্গে ব্যাকুলাম নামে একটি হাড় রয়েছে, যা সঙ্গমের সময় সংযোগ বজায় রাখতে সহায়তা করার জন্য স্পাইন দিয়ে আচ্ছাদিত থাকে।
* বাঘের লালায় প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপ্টিক থাকে। বাঘ তার দেহের ক্ষত সারাতে লালা লাগায়।
* বাঘের গর্ভকালীন সময় ১০৪-১০৬ দিন। এরা এক সাথে ২ থেকে ৫ টি বাচ্চা জন্ম দেয়। পুরুষ বাচ্চা ৪-৫ বছর ও মেয়ে বাচ্চা ৩-৪ বছরে বয়োপ্রাপ্ত হয়।
* জন্মের সময় বাঘের বাচ্চাগুলো পুরোপুরি অন্ধ থাকে। জন্মের দেড়-দুই সপ্তাহ পরে এদের চোখ ফুটে। এই বাচ্চাদের অর্ধেক যৌবনে বাঁচে না।
* বাঘের বাচ্চারা ৬ মাসে স্বাবলম্বী হয়। এর আগে তাদের দেখাশোনা পুরোটাই মা বাঘ করে। পুরুষ বাঘ (পিতা) কোন দায়িত্ব পালন করে না। উল্টো অনেক সময় নিজের বাচ্চাকেও খেয়ে ফেলে। "বিখ্যাত বাঘ শিকারি জিম করবেট বলেছেন, বাচ্চারা মায়ের সাথে ১৮ মাস পর্যন্ত থাকে।" যখন তারা নিজেরা চলাফেরা শিখে যায়, তখন তারা তাদের মাকে ছেড়ে চলে যায় এবং নিজেদের মতো করে একটা এলাকা বেছে নিয়ে বসবাস করা শুরু করে।
* বাঘ সাধারণত নিশাচর প্রাণী। পুরুষ বাঘ বাঘিনী এবং শাবকদের ছাড়াই নিঃসঙ্গভাবে চলাফেরা করে। তবে পুরুষ বাঘ শিকার ধরে স্ত্রী বাঘ এবং শাবকদের আগে খেতে দেয়।
* বাঘের কপালের নিদর্শনটি চীনা প্রতীকের সাথে হুবহু মিলে যায় যার অর্থ রাজা, এজন্য বাঘ চীনা সংস্কৃতিতে রাজকীয় মর্যাদা লাভ করেছে।
* বাঘের জিহ্বা ভর্তি পিছনের দিকে মুখ করা অনেক ধারালো প্যাপিলা থাকে। যেগুলো যেকোন শিকার থেকে লোম, চামড়া বা পালক ছাড়িয়ে খেতে সাহায্য করে। এগুলো এতটাই অমসৃণ হয় যে তারা খুব সহজেই যেকোনো হাড়ে লেগে থাকা মাংস চেটে তুলে আনতে পারে।
* বাঘের ডোরাকাটা দাগ শুধু তার লোমে না, চামড়ায়ও থাকে। মানুষের যেমন স্বতন্ত্র ফিঙ্গারপ্রিন্ট থাকে, সেরকম দুইটা বাঘের চামড়ার স্ট্রাইপের প্যাটার্ন কখনো এক হয় না। যার ফলে বাঘেরা খুব সহজেই একে অপরকে শনাক্ত করতে পারে।
* বিড়ালের মত প্যাডেড পা (নিঃশব্দে চলাফেরার জন্য), প্রায় ৩ ইঞ্চি লম্বা একেকটা ধারালো ক্যানাইন দাঁত, ১০ সে.মি. লম্বা নখর, সমস্ত ফেলাইনের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর থাবা ও দ্রুতগতি থাকা সত্ত্বেও বাঘের শিকার ধরার সফলতার রেট ১০%। অর্থাৎ প্রতি ১০ বারের চেষ্টায় বাঘ মাত্র ১ বার সফল হয়। তবে একটু বড় কিছু ১ বার শিকার করতে পারলে ৫-৬ দিন আর শিকার করে না।
* বাঘ একবারে মোটামুটি ৪০ কেজির মত মাংস খায়। এরা সাধারণত মহিষ, হরিন, বন্য শূকর, বানর, বড় পাখি, বড় মাছ শিকার করে থাকে। এরা ২-৩ সপ্তাহ না খেয়ে থাকলে মারা যায়।
* বাঘ অন্যান্য প্রাণীর ডাক নকল করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বোকা বানিয়ে শিকার করে।
* সুন্দরবনের বাঘে মানুষও খায়। সাতক্ষীরার পচাব্দী গাজী এরকম ৫৬ টি (মতান্তরে ৫৭টি) মানুষখেকো বাঘ শিকার করে বিখ্যাত বাঘ শিকারি হয়েছিলেন।
* বাঘের গর্জন ৩ কি.মি. দূর থেকেও শোনা যায়। এরা দূরবর্তী বাঘদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ভয়ঙ্কর শব্দে গর্জন করে। কাছ থেকে বাঘের গর্জন শুনলে বধির হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা আছে।
* বাঘের প্রস্রাবের গন্ধ বাটার মাখানো পপকর্ণের মত। নিজেদের এলাকা চিহ্নিত করতে এবং অন্যদের সতর্ক করতে বাঘ প্রস্রাবের গন্ধ কাজে লাগায়। এছাড়া গাছে নখের আঁচড় রেখেও এলাকা চিহ্নিত করে।
* বিড়াল পরিবারের মধ্যে একমাত্র বাঘ-ই পানিকে ভালবাসে। এরা খুবই ভাল সাঁতারু, একটানা ৬ কি.মি. সাঁতারও কাটতে পারে। সাঁতরানোর সময় শিকার ধরতেও এরা বেশ পটু।
* বাঘ রাতে স্পষ্ট দেখতে পেলেও দিনের বেলা মানুষের তুলনায় চোখে কম দেখে। এরা অন্ধকারে মানুষের চেয়ে ৬ গুণ বেশি দেখতে পায়।
* বাঘের পা এতটা শক্তিশালী যে এরা মারা যাওয়ার পরও কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
* বাঘ সচারচর সামনে দিয়ে আক্রমণ করে না। এজন্য সুন্দরবনের জেলে, বাউয়ালি, মৌয়ালিরা বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য মাথার পেছনে মুখোশ পরে।
* বাঘের কানের পেছনের সাদা দাগটিকে ওসেলি বলে। কানের পিঠের এ সাদা দাগগুলি কখনও কখনও পিছন থেকে সম্ভাব্য আক্রমণকারীদের বাধা দেওয়ার জন্য `চোখ` হিসাবে কাজ করে বলে মনে করা হয়। আবার কখনো এ সাদা দাগগুলি বাঘের শাবকগুলি লম্বা ঘাসের মাধ্যমে তাদের মাকে অনুসরণ করতে সহায়তা করে।
* বাঘ ও সিংহীর সাথে প্রজননের ফলে ‘টাইগন` এবং সিংহ ও বাঘিনীর প্রজননের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির সংকর প্রাণী `লাইগার` এর জন্ম হয়।
সংগৃহীত