
ছবি : মো. ফখরুল ইসলাম
প্রতিবছর ঘুরে ফিরে আসে বাঙালির অনেক চিরায়ত উৎসব। তারমধ্যে মুসলমানদের জন্য দুটি ঈদসহ আরো অনেক ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ ও অনুষ্ঠানাদি। আসে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য বিভিন্ন পূজা-পার্বণসহ বারো মাসে তেরো পূজা উদযাপন উপলক্ষ। তেমনি খ্রিস্টানদের জন্য বড়দিন কিংবা ইস্টার সানডের মতো উপলক্ষ। বৌদ্ধদের জন্য রয়েছে বুদ্ধপূর্ণিমা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বাঙালির সকল ধর্মের মানুষের কাছে পহেলা বৈশাখের মেজাজ ও গুরুত্ব সম্পূর্ণ অন্যরকম এবং সত্যিকার অর্থেই সার্বজনীন।
কাজেই পুরো বাঙালি জাতি বাংলা বর্ষ হিসেবে পহেলা বৈশাখকে নববর্ষের শুরু বলে পালন করে থাকে। এটিই বর্তমানে বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির পালনীয় একটি সার্বজনীন উৎসব। বাংলা সন হিসেবে বছরের শেষ মাস হলো চৈত্র। আর চৈত্র মাস পার হয় ৩১ দিনে। সেই চৈত্রের শেষ দিনটিকে বর্ষ বিদায় এবং বৈশাখের প্রথম দিনটিকে নববর্ষ হিসেবে পালন করাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালিরই রেওয়াজ।
আমরা ছোট বেলায় দেখেছি গ্রমের বাড়িতে চৈত্র মাসের শেষ দিনে যার যার লেনা-দেনা পরিশোধ করার সকল কাজ সম্পন্ন করে থাকতেন। ছোট-বড় প্রত্যেক ব্যবসায়ীগণ তাদের পুরাতন খাতা হালনাগাদ করে নতুন খাতা খুলছেন। এবং প্রত্যেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাজার দোকানে রীতিমত মাইক বাজিয়ে, ঢোল পিটিয়ে, নতুন সাজে সজ্জিত করে হালখাতা নামক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো। সেখানে বিশাল ভোজের মাধ্যমে তাদের বাৎসরিক দেনা-পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে। এখনও গ্রাম বাংলার প্রত্যেকটি স্থানে এমনটিই লক্ষ্য করা যায়।
পহেলা বৈশাখ পালনের কিছু গ্রামীণ ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু কথা হলো সেগুলো এখন গ্রাম ছাড়িয়ে শহরের কালচারে পরিণত হয়েছে। গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলা বসে, মেলায় চরকি, নাগরদোলা, খই-মুড়ি-মুড়কি, প্যারা-সন্দেশ, গজা-জিলাপি, মণ্ডা-মিষ্টি, বিভিন্ন ধরেনর খেলনা, বাঁশি ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয় করে থাকে। সেই মেলাকে উপলক্ষ করে নৌকা বাইচ, গরু দৌড়, দাড়িয়া বাধা, কাবাডি ইত্যাদি অনেক খেলার আয়োজন হয়ে থাকে। সেসব স্থানে কাঠের তৈরী নানা আসবাব পত্র, তালের পাতার তৈরী হাতপাখা, খেজুরের পাতার শীতল পাটি ইত্যাদি কিছু ঐতিহ্যগত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে।
গ্রামের সহজ সরল মানুষের মধ্যে একটি সহজ সরল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তারা মনে করেন বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্রের শেষ দিনে যদি নিজেকে ঋণমুক্ত না রাখা যায় তবে সারাবছরই ঋণে জর্জরিত থাকতে হবে। অপরদিকে বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে যদি মাটির তৈরী কোন জিনিস কেনা যায় তবে সারা বছরই মাটি অর্থাৎ জমি কেনা যাবে। কী সহজ মানুষের বিশ্বাস! কাজেই দেখা যেতো সাধারণ মানুষেরা মেলায় গিয়ে প্রথমেই একটি মাটির তৈরী কোন জিনিসপত্র কিনে তবেই বাড়ি ফিরতেন। একসময় পানতা-ইলিশ বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ হলেও ইলিশের অপ্রতুলতার কারণে তা এখন তা চেপা-সুটকি-পানতায় চলে আসছে।
আর সেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন এখন আরো বেশি স্বতস্ফূর্ত ও প্রাণবন্ত হয়েছে। এটি এখন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। সরকার এখন এ দিবসিটি পালরে জন্য সরকারি চাকুরিজীবীদেরকে বৈশাখী ভাতা দিচ্ছে গত দুই বছর যাবৎ। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই এখন তা অত্যন্ত আড়ম্বপূর্ণভাবে পালন করা হয়। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট থিমকে ধারণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষবরণ তো একেবারে অন্যরকম ঐতিহ্যগত। সেখানে চারুকলা অনুষদের আয়োজনে বিশাল ও বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজিত হয়ে থাকে। আর এখন এটি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ নেই ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। এমনকি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও।
আমাদের গর্ব করার মতো একটি মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়ে থাকে প্রতিবছর ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাত্র ১২ বছর হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রতিবছরই খুব জমকালোভাবে পালিত হচ্ছে বাঙালির চিরায়ত এ বর্ষবরণের অনুষ্ঠান মঙ্গল শোভাযাত্রা। আমার বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরপরই এটি বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন। আকার-আকৃতি, অংশগ্রহণকারী, প্রস্তুতকৃত উপাদানের সংখ্যা কোনটাই কারো চাইতে কম নয়। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টির চারুকলা বিভাগের একদল কর্মঠ অনুরাগী শিল্পী, শিক্ষক, শিক্ষার্থীগণ তা তৈরী করেছেন হাতি, ঘোড়া, মোড়গ-মুরগী, প্যাঁচা, নানারকমের মুখোশ ইত্যাদি।
এসব কারণেই বাঙালির ঐতিহ্যগত মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন শুধু বাংলাদেশের নয়, জাতিসংঘের ঐতিহ্য। এটির গুরুত্ব ও আবেগ বিবেচনায় মঙ্গল শোভাযাত্রাকে জাতিসংঘের বিশ্বঐতিহ্যে স্থান দিয়েছে গত দুইবছর আগে। তবে সারাবছরের অমঙ্গলকে দূর করার জন্য বছরের একদিন মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হলেও সত্যিকার অর্থে আমরা এখনো সকল অমঙ্গলকে পিছনে ফেলতে পারিনি। কারণ এখনো বৈশাখী অনুষ্ঠানটিই নির্বিঘ্নে, নিরাপদে করতে পারিনা। এখনো রাস্তাঘাটে ব্যাপকভাবে নরপশুরা শিশু নির্যাতন, নারী নির্যাতন, ধর্ষন, খুন ইত্যাদি করে চলেছে।
তবে আশার কথা, যদিও বর্তমান সরকারের অনেক ভালো কাজকেও ষড়যন্ত্রকারীরা নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে চলেছে। তারপরও বর্তমান সরকারই বর্ষবরণসহ সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠানগুলোকে নির্বিঘ্ন করার চেষ্টা করে চলেছে। এবারেও বর্ষবরণ নির্বিঘ্ন করার জন্য সরকার নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আশা করি এর সুফল সারা জাতি পাবে। এবারের পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে দূর হোক সকল অমঙ্গল- এ প্রত্যাশাই করি।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]
বহুমাত্রিক.কম