Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

আষাঢ় ২৭ ১৪৩২, শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫

নদীময় জীবন নিজেই বেছে নিয়েছি: শেখ রোকন

অপূর্ব ধ্রুবচারী

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ৫ মে ২০১৯

আপডেট: ২৩:৪৭, ৫ মে ২০১৯

প্রিন্ট:

নদীময় জীবন নিজেই বেছে নিয়েছি: শেখ রোকন

-শেখ রোকন। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে ও দক্ষিণ এশিয়ায় নদী আন্দোলনের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শেখ রোকন। নদী বিষয়ক নাগরিক সংগঠন রিভারাইন পিপল’র তিনি প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব। শেখ রোকন নদী নিয়ে গবেষণা, লেখালেখি ও প্রচারণায় অন্তত দেড় দশক ধরে। নদী বিষয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে বিষয় নদী, নদী চিন্তা, মেঘনাপাড়ের সংকট ও সংগ্রাম

শেখ রোকন পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটি থেকে পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকীয় নীতি এবং ভারতের সিকিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারত-বাংলাদেশ পানি-সম্পর্ক বিষয়ে শর্টকোর্স সম্পন্ন করেছেন। আজ শেখ রোকন’র জন্মদিন। এ উপলক্ষে বহুমাত্রিক.কম-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নদীকে ঘিরে তাঁর বদলে যাওয়া জীবনের গল্প শুনিয়েছেন। তুলে ধরেছেন বিপন্ন নদ-নদীর সুরক্ষায় তাঁর প্রাণান্তর প্রচেষ্টা ও বিভিন্ন প্রয়াসের কথা। বহুমাত্রিক.কম’র পক্ষে তাঁর একান্ত এ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন অপূর্ব ধ্রুবচারী

বহুমাত্রিক.কম: আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। বিভিন্ন উপলক্ষে আপনি সবাইকে নদীময় শুভেচ্ছা জানিয়ে থাকেন। এর তাৎপর্য কী?

শেখ রোকন: এটা আসলে রিভারাইন পিপলের পক্ষে আমাদের একটি ছোট্ট ও সহজ প্রচারণা। আমরা মনে করি, নদীমাতৃক দেশে শুভেচ্ছা জানানোর মধ্য দিয়েও নদীর আবহ থাকা উচিত। আপনি দেখবেন, আমরা ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে ধার করে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানাই। ওই অঞ্চল যেহেতু ঠান্ডার দেশ, সেখানে উষ্ণতা উপভোগ্য। কিন্তু আমাদের তো গরমের দেশ। এখানে উষ্ণ শুভেচ্ছা ঠান্ডার দেশের মতো হৃদয়গ্রাহী হওয়ার কথা নয়। বরং নদীর কথা বললে বা শুনলে আমাদের ভালো লাগে। এই চিন্তা থেকেই আমরা শুরু করেছিলাম। এখন আপনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখবেন, আরও অনেকেই এভাবে শুভেচ্ছা জানায়।

বহুমাত্রিক.কম: আমাদের পক্ষ থেকেও তাহলে নদীময় শুভেচ্ছা। আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই।

শেখ রোকন: এই প্রসঙ্গে আমি মজা করে বলে থাকি, আমার জন্ম মেসোপটেমিয়ায়। প্রাচীন ইরাকের ছিল এই নাম। তার মানে এই নয় যে, আমার জন্ম ইরাকে। ইরাককে মেসোপটেমিয়া বলা হতো আসলে নদীর কারণে। দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল হিসেবে। মেসোপটেমিয়া উপমহাদেশে ভাষান্তরিত হয়েছে দোয়াব নামে। আব মানে পানি, দোয়াব মানে দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল। যেমন পাঞ্জাব মানে পঞ্চ নদীর দেশ। আমার জন্ম হয়েছে সোনাভরি ও জিঞ্জিরাম নদীর দেয়াবে বা মধ্যবর্তী অঞ্চলে। কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারীতে চমৎকার এই নদী দুটি প্রবাহিত ছিল। ছিল বলছি এই কারণে, এখন দুটোই নদীই মৃতপ্রায়। আমার শৈশবেও নদী দুটি স্রোতস্বিনী ছিল।

বহুমাত্রিক.কম: সোনাভরি ও জিঞ্জিরাম নদী মরে যাওয়ার কারণ কী?

শেখ রোকন: একেবারেই ধ্রুপদী কারণ। মানে, দেশের অন্যান্য অংশে যেভাবে নদীগুলো মারা যাচ্ছে, এই দুই নদীর মৃত্যুর কারণও সেগুলোর সঙ্গে অভিন্ন। আমাদের দেশে দুটো কারণে ছোট নদীগুলো সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে। একটি হচ্ছে, উজানে পানি প্রত্যাহার বা পানিস্বল্পতা। অন্যটি অপরিকল্পিত স্থাপনা। জিঞ্জিরাম নদী মারা যাচ্ছে উজানে প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে। আর সোনাভরি নদী আমরা মেরে ফেলেছি আড়াআড়ি বাঁধ ও স্লুইসগেট দিয়ে। প্রবাহ বন্ধ ও অপরিকল্পিত স্থাপনার কারণে যখন নদী দুর্বল হতে থাকে, তখন দখল শুরু হয়। আর দখলের পথ ধরে আসে দূষণ। এই দুই নদীর ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। আবার সাম্প্রতিককালে নদীগুলো মরে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ নির্বিচার বালু উত্তোলন। জিঞ্জিরাম নদীতে এই আপদও শুরু হয়েছে নতুন করে।

বহুমাত্রিক.কম: আপনি দেশের অনেক নদী দেখেছেন, নদী নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন। নদী নিয়ে কাজের প্রতি আকৃষ্ট হলেন কীভাবে? শৈশবে জিঞ্জিরাম ও সোনাভরি দেখে?

শেখ রোকন: এই প্রশ্নের মুখে আমি আগেও পড়েছি। হ্যাঁ, এটা সত্য, আমার শৈশবে এই দুই নদীর প্রভাব ছিল। জিঞ্জিরাম নদীতে ও সোনাভরি নদীতে দূর্গা পূজা বিসর্জন হতো। জিঞ্জিরামে প্রতিবছর অষ্টমী স্নান উপলক্ষে বড় মেলা বসতো। এছাড়া আমার আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যেতে হতো জিঞ্জিরাম নদীর পাড় দিয়ে। সোনাভরিতে নৌকায় উঠে আমরা বিপুল ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে চিলমারী বা কুড়িগ্রাম যেতাম। কিন্তু তখন স্বভাবতই মুগ্ধতা ছাড়া আর কোনো ভাবনা ছিল না। নদী নিয়ে কাজের কথা ভাবার বয়সও নয় সেটা। নদী নিয়ে কাজ বলতে যা বোঝায়, সেটা আসলে শুরু করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়।

বহুমাত্রিক.কম: কীভাবে নদী নিয়ে কাজ শুরু করলেন, সেই গোড়ার কথাটা জানতে চাই।

শেখ রোকন: এমন নয় যে, ভেবেচিন্তে, সিদ্ধান্ত নিয়ে, দিনক্ষণ ঠিক করে নদী নিয়ে কাজ শুরু করেছি। এমনিতেই পরিবেশ, বন, পানিসম্পদ, হাওর, নদী, কৃষি প্রভৃতি বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল। ছাত্রাবস্থাতেই বিভিন্ন ম্যাগাজিনে এসব নিয়ে লেখালেখি করেছি। উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে পরামর্শক হিসেবে ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু গবেষণা, ডকুমেন্টেশন কাজ করেছি। তখন আমি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও হালকা পাতলা জড়িত ছিলাম। একসময় দেখলাম, আমার লেখালেখি, গবেষণার প্রতি আগ্রহ বেশি। ভুল বা সঠিক যাই হোক, এক পর্যায়ে মনে হলো ছাত্র রাজনীতির চেয়ে পরিবেশ নিয়ে কাজ করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আবার পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মনে হলো, বাংলাদেশের মতো ব-দ্বীপে নদীই পরিবেশের মূল সূত্র। নদী ঠিক থাকলে পরিবেশ ঠিক থাকবে। তখন আমার আগ্রহ ও অভিমুখ পরিবেশ, নদ-নদী এগুলোর প্রতি বেশি ঘুরে যায়।

বহুমাত্রিক.কম: রিভারাইন পিপলও কি তখনই প্রতিষ্ঠা করেন?

শেখ রোকন: না, ঠিক তখনই নয়। যেহেতু আমি সংগঠন করা মানুষ, সেটার আকর্ষণও ছাড়া কঠিন। তাই আরও কয়েক বছর পর, ছাত্রজীবনেই, একটা লুজ সার্কেল তৈরি করেছিলাম। নদী নিয়ে, কয়েকজন বন্ধু মিলে। নাম, রিভার লাভিঙ পিপল। এর কাজ ছিল নদীতে ঘুরতে যাওয়ার মতো হালকা তৎপরতা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর মনে হলো, নদীর কাজ আরও বিস্তৃত, জীবনঘনিষ্ঠ। ততদিনে বাংলাদেশে ফেসবুক এসেছে কেবল। সেখানেই রিভারাইন পিপল, আরও সিরিয়াস নাম নিয়ে, একটি গ্রুপ তৈরি হয়। সেখানে নদী নিয়ে আগ্রহীরা যোগ দিতে থাকেন। তাদের নিয়ে ২০১০ সালের বিশ্ব নদী দিবসে প্রথমবারের মতো মধুর কেন্টিনে বসি। সেখানেই আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে রিভারাইন পিপল। আমাদের সেই গ্রুপ এখেনা আছে।

                                                   -নদীরই যার ধ্যান-জ্ঞান

বহুমাত্রিক.কম: এখন রিভারাইন পিপল নিয়েই আছেন?

শেখ রোকন: হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। আমার রুটি-রুজির জন্য আলাদা পেশা রয়েছে। লেখালেখিই মূলত আমার পেশা। বাকিটা সময় নদীর জন্য উৎসর্গ করেছি। আসলে আমরা যারা রিভারাইন পিপলে সার্বক্ষণিক সদস্য, তাদের সবারই আমার মতো রুটি-রুজির জন্য আলাদা পেশা রয়েছে। তার বাইরে বাকিটা সময় আমরা নদীর জন্য বরাদ্দ দিয়েছি। রিভারাইন পিপল আমাদের আবেগ ও মর্যাদার ঠিকানা। সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার নিশানা। আমাদের ভালোবাসার ঠিকুজি। আমার কাছে রিভারাইন পিপল সন্তানের মতো। আমার সহযোদ্ধারা প্রত্যেকেই আমার পরিবারের সদস্যের মতো। আমি ও আমার সহযোদ্ধারা কেউই রিভারাইন পিপলকে রুটি রুজির মাধ্যম করতে চাইনি। এখনো চাই না। কখনোই চাইব না। রিভারাইন পিপল আমাদের কাছে সমান্তরাল একটি জীবনের নাম। আমরা এটাকে বলি নদীময় জীবন।

বহুমাত্রিক.কম: আপনি বললেন রিভারাইন পিপল আপনার কাছে সন্তানের মতো, পরিবারের মতো। এই যে এটাকে এত ভালোবাসেন, আপনার নিজের পরিবার মেনে নিয়েছে?

শেখ রোকন: কঠিন প্রশ্ন। হ্যাঁ, মেনে নিয়েছে। পরিবারের সদস্যদের অনেক আবেগ বা পাগলামি আমরা প্রশ্রয় দেই না? ঠিক সেইভাবে মেনে নিয়েছে বা অভ্যস্ত হয়েছে। যেমন আমার স্ত্রী এবার জন্মদিনে ফেসবুকে লিখেছেন- ‘তোমাকে ভালোবাসি আমরা, নদীকে তুমি যতটা ভালোবাসো তার থেকেও অনেক বেশি। যদিও ভালোবেসে আমাদের ভালোবাসা এখন নদীর জলে মিশে, নদীর সাথে কথা কয়। তোমাকে শুভেচ্ছা, আর অবশ্যই নদীময় শুভেচ্ছা।’ তার এই ছোট্ট স্ট্যাটাস আমার জন্য বড় প্রাপ্তি। নিজের কাজের প্রতি পরিবারের সমর্থন না থাকলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো অনেক সময়ই সম্ভব হয় না।

বহুমাত্রিক.কম: আপনার ছেলের নামও সম্ভবত নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত।

শেখ রোকন: ঠিকই ধরেছেন। ওর ডাক নাম রিও। রিও স্প্যানিশ ভাষা। এর অর্থ নদী। শুধু আমি নই, আমার সহযোদ্ধাদের অনেকেও তার সন্তানের নাম নদীর সঙ্গে মিলিয়ে রাখছেন। আপনাকে বলতে পারি, নদীর নামে সন্তানের নাম রাখার প্রবণতা আগের তুলনায় বেড়েছে। আমার কাছেও অনেকে নদীর সুন্দর নাম চায়। সন্তান বা স্বজনের নাম রাখার জন্য। আমার কাছে সেটা একটা বড় প্রাপ্তি মনে হয়।

বহুমাত্রিক.কম:এভাবে কতদিন চালিয়ে যেতে পারবেন?

শেখ রোকন: এটা ঠিক যে, নদীর কাজে অর্থ নেই। যে কারণে আমার কোনো সঞ্চয় নেই, সম্পদ নেই। আর্থিকভাবে নানা টানাপোড়েনের মধ্যে থাকি। গবেষণা, লেখালেখি, ডকুমেন্টেশন, অনুবাদের কাজে আমার সামান্য দক্ষতা রয়েছে। সংগঠনের কাজে যে সময় ব্যয় করি, সেই সময় সেসব কাজ করলেও টাকাপয়শা কম আসতো না। কিন্তু নদীর কাজ আমার ভালো লাগে। এটাই আমার জীবন। নদীময় এই জীবন নিজেই বেছে নিয়েছি। পেছনে ফিরে তাকিয়ে তাই আমার কোনো খেদ নেই, আক্ষেপ নেই। এভাবেই জীবন চালিয়ে যেতে চাই।

বহুমাত্রিক.কম: শেষ প্রশ্ন। নদী নিয়ে আপনারা এতদিন ধরে কাজ করছেন। সাফল্য কতখানি?

শেখ রোকন: দেখুন, সাফল্য বিষয়টি আপেক্ষিক। এই যে মানুষ এখন নদী নিয়ে এতো কথা বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নদী বিষয়ক পোস্ট বেড়েছে, এটাই আমাদের প্রাথমিক সাফল্য। জনপরিসরে, সংবাদমাধ্যমে নদী নিয়ে আলোচনা অনেকে বেড়েছে না? গোটা দেশে নতুন নতুন নদী আন্দোলন গড়ে উঠছে। এমনকি সরকারও আগের চেয়ে বেশি সিরিয়াস। উচ্চ আদালত নানা ইতিবাচক নির্দেশনা দিচ্ছেন। নতুন নতুন আইন হচ্ছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, এগুলো সাফল্য নয়? আমরা মনে করি, এসবের মধ্যেই নদী নিয়ে আমাদের এতদিনের কাজের সার্থকতা নিহিত।

বহুমাত্রিক.কম