ছবি : সংগৃহীত
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি অনুরাগের শুরুটা দেড় দশক আগে। ব্রিটিশের দ্বিখন্ডিত করা ভারতবর্ষে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়-তা এই অঞ্চলের পরবর্তী প্রজন্মের অধিবাসীদের অনেক ঐতিহাসিক সত্যকেই ভুলিয়ে দিয়েছে। উগ্র সাম্প্রদায়িক ও শোষণনীতির পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠি বাঙালি জাতির ওপর পৃথিবীর নজিরবিহীন নিষ্পেষণ এবং বর্বরতা শুরু করে-তা রুঁখে দিয়ে রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করে স্বাধীন ভূ-খন্ড বাংলাদেশ।
একটি অঞ্চলের এই যে শাসনতান্ত্রিক ভাঙাগড়ার খেলা-তাতে যেমন চাপা পড়েছে বাঙালি জাতির বহু আত্মত্যাগের ইতিহাস, তেমনি প্রজন্মের উত্তরাধিকারদের মাঝেও এনিয়ে নেই কোনো অনুরাগ। বাংলাদেশের শ্যামল প্রকৃতি, এখানকার চিরায়ত সংস্কৃতি-জীবনাচার নেতাজির অতিপ্রিয় ও রাজনৈতিক চর্চার অন্যতম উর্বর ক্ষেত্র হলেও তাঁর অন্তর্ধানের একদশকের মাঝেই তিনি হারিয়ে যেতে থাকেন এখান থেকে। দেশমাতৃকার জন্য তাঁর বিরল আত্মত্যাগ ও গৌরবগাঁথা ব্যক্তিগতভাবে কারো কারো কাছে চর্চিত হলেও তার প্রভাব এখানকার রাজনৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ব্রিটিশ রাজশক্তিকে প্রবলভাবে নাড়া দেওয়ার গল্প শুনিয়ে আমার কিশোর মনে দারুণভাবে দাগ কাটেন বাংলাদেশের ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার প্রয়াত সাংবাদিক-গবেষক শামসুল হক। অপরিণত বয়েসেও সেই গল্প প্রচণ্ড সন্মোহন তৈরি করে ওই মহানায়কের প্রতি। গত দেড় দশক প্রবল আগ্রহ ও ভালোবাসা নিয়ে নেতাজির আদর্শ ও তাঁর আত্মত্যাগ, সংগ্রামী ইতিহাস অধ্যয়নের চেষ্টা করেছি-ঠিক যে আগ্রহ নিয়ে পড়েছি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
এর ফলে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং মুক্তিবাহিনীর সর্বাত্মক সংগ্রামের বহু সাদৃশ্য ফুটে উঠেছে। এই দুটি মুক্তির সংগ্রামের মধ্যেই অসাম্প্রদায়িক ও শোষণহীন রাষ্ট্রের আকাঙ্খা যেমন ছিল, তেমনি হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ সর্বধর্মের বীরযোদ্ধাদের অকাতর বলিদান উভয় সংগ্রামকেই একে মহোত্তম ত্যাগের এক চিরকালীন মর্যাদা দিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুটি মুক্তির সংগ্রামের নেতৃত্বেই ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দুই বাঙালি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি উড়িষ্যার কটকে হলেও বেড়ে উঠা কলকাতায়-যে শহরে লেখাপড়া করতে গিয়ে রাজনীতি ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত হন শেখ মুজিবুর রহমানও। প্রায় দু’শো বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শৃঙ্খল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশকে মুক্ত করতে বহু বৈপ্লবিক সশস্ত্র প্রচেষ্টা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে হলেও ব্রিটিশদের ভীত প্রবলভাবে নাড়াতে সক্ষম হন নেতাজি-ই, এটি দারুণভাবে প্রভাবিত করে তরুণ শেখ মুজিবকেও।
প্রখর মেধাবী সুভাষ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস(আইসিএস) পরীক্ষায় চতুর্থ হয়েও তাতে যোগ না দিয়ে পরাধীন দেশমাতাকে উদ্ধারের সংকল্প করেন। জাতীয়তাবাদী নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের হাত ধরে সেই সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে রাজনীতিতে এসে পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুললেন, যেখানে তৎকালীন জাতীয় নেতারা ক্ষমতার অংশীদার হতে সর্বোচ্চ স্বায়ত্বশাসন পর্যন্ত দাবি তুলতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে কোটি কোটি ভারতবাসীর অন্তরের কথা যেন সুভাষের কণ্ঠেই ধ্বনিত হল। দেশবাসী কংগ্রেস সভাপতি পদে তাকে সমর্থন দিয়ে জয়যুক্ত করলেন, ব্রিটিশদের কাছে ক্রমেই বিজ্জনক হয়ে উঠতে থাকলেন সুভাষ। আপসকামী রাজনীতিবিদদের কুটচালে দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি পদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে জয়ী হলেও পদত্যাগ করতে হল তাকে। একযোগে সুভাষচন্দ্র বসুকে লড়তে হয় ব্রিটিশ ও নিজদেশের ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে সমানতালে।
স্বাধীন বাংলাদেশে একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বাংলাদেশের জাতির জনককে। কংগ্রেস সভাপতি পদ ত্যাগ করার পর ফের কারারুদ্ধ সুভাষ অনশন শুরু করলেন, অবস্থা বেগতিক দেখে কলকাতার নিজ বাড়িতে অন্তরীন করা হল তাকে। ব্রিটিশের পুলিশ-গোয়েন্দাদের হাজারো চোখে ধুলো দিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। এরপরের ঘটনায় তিনি কেবল ভারতবর্ষের নন, বিশ্বের এক কিংবদন্তি স্বাধীনতা সংগ্রামী মহান নেতায় পরিণত হলেন, হলেন সবার প্রিয় নেতাজি।
তৎকালীন বিশ্বের মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর প্রধানরা নেতাজির অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বের কাছে ম্লান হয়ে যেতে থাকলেন। তাকে বরণ করে নিতে থাকেন শ্রদ্ধার আসনে। নেতাজি বিশ্বের ক্ষমতাধরদের কাছ থেকে ভারতমাতাকে উদ্ধারের সমর্থন-সহযোগিতা আদায় করতে বেশি সময় নেননি। শক্তিশালী ব্রিটিশ-মার্কিন যৌথশক্তির বিরুদ্ধে নেতাজির এই যুদ্ধে আরেক ক্ষমতাধর জাপানসহ বেশকিছু দেশ পাশে থাকলেও তাঁর মূলশক্তি ছিল দেশপ্রেমের, সততার ও আদর্শের। সামরিকভাবে শক্তিশালী পাকিস্তানি জান্তাদের সঙ্গে নিরস্ত্র বাঙালির সংগ্রামে শেখ মুজিবেরও অস্ত্র ছিল দেশপ্রেমের মন্ত্র। নেতাজি তাঁর গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিটি সেনার অন্তরের সেই আদর্শের বীজ যথাযথভাবে রোপণ করতে পেরেছিলেন। সেই যুদ্ধে আজাদ হিন্দ ফৌজের ২৬ হারেরও অধিক সৈন্যের শাহাদাৎবরণসহ বহু বীরত্বগাঁথা ইতিহাসে ঠাঁই পায়নি।
জাপানের সহায়তায় নেতাজির নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে অভূতপূর্ব সাফল্য পায়। রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাভূত করে মনিপুর-আন্দামান ও নিকোবর (নেতাজি যার নাম দেন ‘শহীদ দ্বীপ’ ও ‘স্বরাজ দ্বীপ) সহ বিস্তীর্ণ ভারতভূমি অধিকার করে আজাদ হিন্দ ফৌজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেই সময়ে জাপানের আত্মসমর্পণ নেতাজির লড়াইয়ে ছন্দপতন ঘটায়। কিন্তু দেশজুড়ে গণমানুষের মাঝে যে অগ্নিস্ফূলিঙ্গ তিনি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন তা ব্রিটিশদের বিতাড়নের পথকে প্রশস্থ করে। স্বাধীনতার প্রশ্নে গণজোয়ারের সঙ্গে নৌবাহিনীতে বিদ্রোহ শুরু হয়।
ফলশ্রুতিতে দেশভাগের মত সুদূরপ্রসারী সর্বনাশ করে ভারত ছেড়ে যায় ব্রিটিশরা। তবে রেখে যায় তাদের অনুগত দোসরদের, যারা নেতাজিকে মৃত প্রতিপন্ন করার চক্রান্তে মেতে উঠে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রকাশ্যে শারীরিক অনুপস্থিতির (১৯৪৫-এর পর থেকে) সাত দশক পেরিয়ে বহু তথ্য বহু কল্পকাহিনী ডানা মেলেছে। তাঁর বেঁচে থাকার বহু তথ্য প্রকাশ্যে এলেও ‘নেতাজি মৃত’ এমন প্রামাণ আজও অনুপস্থিত। অপরদিকে, স্বাধীন দেশে মাত্র চার বছরের মাথায় উচ্চবিলাসী সেনা সদস্যদের হাতে সপরিবারে প্রাণ দিতে হয় বঙ্গবন্ধুকে।
বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর গভীর আদর্শিক সম্পর্ক ইতিবৃত্ত স্থান পায়নি ইতিহাসের পাতায়। তবে ২০১২-সালে প্রকাশিত জেলাখানায় বসে লেখা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে সুভাষ-মুজিবের আদর্শিক সম্পর্কের অনেক চিত্র উঠে এসেছে। যেখানে মুজিব তাঁর তরুণ বয়েসে নেতাজির দ্বারা উদ্বেলিত-আলোড়িত হওয়ার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেছেন।
নেতাজি-বঙ্গবন্ধু সম্পর্ক নিয়ে সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন ইস্টওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের গণমাধ্যম বিষয়ক উপদেষ্টা মোহাম্মদ আবু তৈয়ব, যিনি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনে। নেতাজির দারুণ অনুরাগী এই গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব জানালেন নেতাজি ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক সম্পর্কের অজানা অনেক অধ্যায়। তাঁর প্রদত্ত তথ্য রীতিমতো আন্দোলিত করার মত। দুই প্রজন্মেও এই দুই নেতাজি অনুরাগীর কথপোকথনের কিছু তুলে ধরলে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
মোহাম্মদ আবু তৈয়বকে বলছিলাম চলতি বছরের (২০১৭) জানুয়ারিতে প্রয়াত হওয়া, নেতাজির সারথি কর্ণেল নিজাম উদ্দিনের কথা। নেতাজির কথা শুনেই শ্রদ্ধায় আপ্লুত হন ষাটোর্ধ্ব এই গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। এসময় কলকাতায় দায়িত্ব পালনের সময়গুলোতে ফিরে যান আবু তৈয়ব। নেতাজির মহিমান্বিত জীবনের নানদিক নিয়ে মূল্যবান মন্তব্য তুলে ধরেন তিনি। নেতাজি ও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শগত ঐক্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি অবতারণা করেন একটি ঘটনার, যা তিনি শুনেছিলেন কলকাতা ডেপুটি হাইকমিশনে দায়িত্ব পালনের সময়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার মুখে।
সেই পুলিশ কর্মকর্তা ব্রিটিশ শাসনামলে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন ব্রিটিশমুক্ত ভারতেও।
মোহাম্মদ আবু তৈয়বের ভাষ্যে, ‘১৯৯৮ সালের ঘটনা। আমি তখন কলকাতা ডেপুটি হাই কমিশনে প্রেস কাউন্সিলর। সেখানে একজন রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার এসেছিলেন-নাম এস কে দে। তিনি একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। তাঁর বাড়ি কলকাতার শহরতলীর হাবড়াতে। তিনি আমাকে একটি ম্যাগাজিন দিতে এসেছিলেন। ম্যাগাজিন দেওয়ার কারণ হল-১৯৭২ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা সফরে গিয়েছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তা এস কে দে তখন রাজভবনের বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তায় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন ভারতের কেন্দ্রিয় সরকারের পক্ষ থেকে।’
‘‘তিনি আমাকে বললেন, ‘আপনারা অনুসন্ধান করে দেখুন-এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একচল্লিশের সেই শেখ মুজিব কিনা?’
তিনি একটি ঘটনা বললেন, সুভাষচন্দ্র বসু তখন এলিগন রোডের বাসায় গৃহবন্দী ছিলেন। তখনও ওই ভবনের নিরাপত্তার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন এস কে দে। তিনি তখন কলকাতা পুলিশের নতুন অফিসার। চাকরি জীবনের প্রথম ওই বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্ব পান। তখন ব্রিটিশের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছিল কিছুসংখ্যক অতিথি নেতাজির সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। নেতাজি নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্তদের তালিকা দিয়েছিলেন। সেই তালিকায় নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের।’’ নেতাজি-বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিষয়ক এরকম তথ্য আরও আগ্রহী করে তুলে ।
তিনি বলে চলছেন, ‘‘এস কে দে আমাকে বললেন, ‘একদিন তিনি বসা আছেন-সকাল বেলা একটা লম্বা ছেলে পাতলা চেহারা। এসে নেতাজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য স্লিপ দিল। লিস্টে দেখলো শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আছে। নাম জানার পর নেতাজি তাকে ডেকে পাঠালেন। তখনি তিনি তাকে একজন পুলিশ দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন নেতাজির কাছে। ওই সদস্য দিয়ে চলে আসলো। এখন ঘটনাটি হল-উনি (শেখ মুজিবুর রহমান) ঢুকেছিলেন সকালে-বেরিয়েছেন বিকালের দিকে। এই লম্বা সময় কী করলেন উনি সেখানে? আমাদের তো ক্ষমতা নাই জিজ্ঞেস করার যে, স্যার টাইম চলে যাচ্ছে। তারপরও একবার রিমাইন্ডারও দেওয়া হয়েছিল। কার সঙ্গে কতক্ষণ কথা বলবেন নেতাজি সেরকম সময় নির্দিষ্ট করা ছিল না। এস কে দে’র ভাষ্য অনুযায়ী-শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভবত সেখানে মধ্যাহ্নভোজও করেছেন। বিকাল বেলায় বেরিয়ে আসেন ওই লোক(শেখ মুজিবুর রহমান)। তিনি বলেন, ওই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যে নেতাজি অন্তর্ধান হলেন। উনি বলছেন, আমার ধারণা নেতাজির অন্তর্ধানের পেছনে এই শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোগিতা ছিল। তিনি কোনোভাবে এখান নেতাজিকে বের করে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন।’’
আলোচনার এই পর্যায়ে মোহাম্মদ আবু তৈয়ব-কে স্মরণ করিয়ে দিলাম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সেই মহাঅন্তর্ধান নিয়ে প্রচলিত ও বহুল চর্চিত ইতিহাসের কিছু তথ্য। তাকে জানালাম, ব্রিটিশ বিতাড়নে নেতাজি নিজ মাতৃভূমি থেকে গোপনে তাঁর অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মিয়া আকবরের সহায়তা নেওয়ার তথ্যটি সর্বজনবিদিত। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে মিয়া আকবরকে তারবার্তা পাঠিয়ে ছিলেন নেতাজি। সেই তার পেয়ে মিয়া আকবর এলগিন রোডের বাড়িতে অন্তরীন নেতাজির বাসভবনে দেখা করেন। মিয়া আকবরই আফগানিস্তানের রাশিয়ান ফেডারেশনের আশীর্বাদপুষ্ট আঞ্চলিক বাম ঘরানার রাজনৈতিক দল কীর্তিকিষাণ পার্টির কর্মী ভগৎরাম তলোয়ার প্রমূখের সহায়তায় কাবুলের রাশিয়া সীমান্তে নেতাজিকে পৌছে দিয়েছিলেন বলে তথ্যটি প্রতিষ্ঠিত। পশতু ভাষা না জানা ও পুলিশ এবং স্থানীয়রা সন্দেহ করতে পারে সেই চিন্তা থেকে নেতাজিকে বোবা-কালা সাজার নাটক করতে হয়েছিল। তাঁর সেই অন্তর্ধানে বাম রাজনৈতিক কর্মীরা ভূমিকা রাখেন বলে বিখ্যাত সেই অন্তর্ধান কাহিনীতে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
এইবার আবু তৈয়ব আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এইখানে একটি কথা বলে রাখি। বাম নেতাদের সঙ্গে নেতাজির সাংঘাতিক মতপার্থক্য ছিল। কমরেড মুজাফফর আহমেদ ও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ব্যাপক মতপার্থক্য ছিল নেতাজির, অন্তত ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে। উনি ছিলেন মূলত জাতীয়তাবাদী নেতা। খাটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা।’
তিনি নেতাজির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও আদর্শগত যে সাদৃশ্য তা ব্যাখ্যা করতে আরও কিছু ঘটনার অবতারণা করলেন। আবু তৈয়ব বললেন, ‘এখন স্মরণ করতে পারি-বঙ্গবন্ধুর সিস্টার রুমমেট কবি গোলাম কুদ্দুসের কথা। সম্ভবত গত কয়েক বছর আগে তিনি গত হয়েছেন। কবি গোলাম কুদ্দুস বেকার হোস্টেলে থাকতেন, বঙ্গবন্ধুর পাশের রুমটাই তাঁর ছিল। গোলাম কুদ্দুস ছিলেন কট্টর বামপন্থী।
অপরদিকে বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা। বঙ্গবন্ধু ক্লাস শেষ করে বিকাল বেলা যেতেন তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দীর কাছে, রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা নিতে। আর গোলাম কুদ্দুস যেতেন কমরেড মুজাফফর আহমেদের কাছে। গভীর রাতে দু’জনের একসঙ্গে দেখা হত। তখন দু’জন দুজনকে ঠাট্টা করতেন-বঙ্গবন্ধু বলতেন গোলাম কুদ্দুসকে-‘কী কমিউনিস্ট কী অগ্রগতি?’ গোলাম কুদ্দুস-ও বঙ্গবন্ধুকে বলতেন, ‘কী জাতীয়তাবাদী, ভারতের স্বাধীনতার কদ্দূর এগুলে?’
তখন গোলাম কুদ্দুসের কাছে শুনেছি, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে। কুদ্দুস সাহেব বলতেন, পাকিস্তানকে বিশ্বাস করে শেখ সাহেব পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হননি। সুদূর প্রসারী চিন্তার অংশ ছিল এটা। তিনি ভাবতেন যদি ভারত এক থাকে তবে বাঙালিরা আর কোনোদিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। যদি বাংলা ভারতবর্ষের এক রাষ্ট্রের অধীনে থাকে..। পাকিস্তান হলে সেখান থেকে বাংলাকে বের করে আনার একটা পথ তিনি খোঁজে পাবেন। এই সুদূর প্রসারী চিন্তার অংশ হিসাবে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এটা তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দীর মাধ্যমে।
যদিও সোহরাওয়ার্দী অবাঙালি ছিলেন। এইখানে বলছি যে কমিউনিস্টরা নেতাজিকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন এটা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। দ্বিতীয়ত আপনাকে বলি, নেতাজিকে কারামুক্ত করার জন্য যে হলওয়েল মুভমেন্ট হয়েছিল কলকাতায়, সেই মুভমেন্টের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে একটা পরিকল্পনা হয়েছিল, পরিকল্পনা ছিল বিধানসভা ঘেরাও করার। তখন গোলাম কুদ্দুস প্রমূখদের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়েছিল, দেখা গেল মিছিলটি খুবই ছোট, শ’খানেক ছাত্রের। তখন তারা কলেজস্ট্রিটে অবস্থান নিল, কারণ শেখ মুজিব বিশাল মিছিল নিয়ে আসবে তখন তারা মার্চ করব।
এর ঘন্টা খানেক পর দেখা গেল বিশাল মিছিল এগিয়ে আসছে, স্লোগান ছিল ‘বিধানসভা ঘেরাও কর, সুভাষকে ছিনিয়ে আনো, মুক্ত কর’। সেই মিছিলে কয়েক হাজার ছাত্র, সবাই খুব উৎফুল্ল। সেই কর্মসূচি সফল হয়েছিল। ওখানে একটি ঘটনা আছে, তখন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিধানসভার নব্য বিধায়ক। উনি মিছিল প্রতিরোধকারীদের একজন হিসাবে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ধাক্কাধাক্কি হয়েছিল। বিধায়কদের সঙ্গেও ছাত্রদের ধাক্কাধাক্কি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ধাক্কায় জ্যোতি বসু পড়ে গিয়েছিলেন।
পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতায় গেলেন, তখন জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করে বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চেয়েছিলেন। জ্যোতি বসু আমাদের বলেছিলেন, সেই চল্লিশের দশকের ঘটনায় বাহাত্তরে এসে ক্ষমা চাইতে এসেছে শেখ মুজিব, তিনি একজন গ্রেট লিডার। তাঁর মানে নেতাজির সঙ্গে তাঁর রাজনীতির যে আদর্শ ও অনুপ্রেরণাগত..চিন্তা-চেতনার মিল তার সবই ছিল। তিনি তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিতও হয়েছিলেন। আজকে আমরা বাংলাদেশকে যে স্বাধীন ভূ-খন্ড হিসেবে পেয়েছি তার মূলে বঙ্গবন্ধু অনুপ্রাণিত হয়েছন নেতাজির চিন্তাধারা থেকে।’’
মোহাম্মদ আবু তৈয়বের এসব তথ্যের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজতে আমি বেশকিছুদিন প্রাসঙ্গিক কিছু প্রামাণ্য গ্রন্থের হদিস করেছিলাম। হঠাৎ মনে হয় ২০১২-তে প্রকাশিত শেখ মুজিবুর রহমানের জেলখানায় বসে লেখা ‘অপ্রকাশিত আত্মজীবনী’ এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। অনুমান ভূল নয়। ৩২২ পৃষ্টার ইতিহাসের অমূল্য এই গ্রন্থটিতে নেতাজির প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর শ্রদ্ধা, ব্যক্তিগত অনুরাগ, তাঁর আদর্শের প্রতি সংহতি একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর লেখনিতে নেতাজি সম্পর্কে যেসব মূল্যায়ন উচ্চারিত হয়েছে তা মোহাম্মদ আবু তৈয়বের তথ্যকেই সমর্থন করে।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখছেন, ‘তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজর আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হত, মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিল। পনের-ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশীরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নেই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া-আসা করতাম। আর স্বদেশী আন্দোলনের লোকদের সাথেই মেলামেশা করতাম।’
আত্মজীবনীর অন্যত্র মুজিব লিখছেন, ‘যখন আবার হিন্দুরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল তখন অনেকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে মরতে দ্বিধা করে নাই। জীবনভর কারাজীবন ভোগ করেছে, ইংরেজদের তাড়াবার জন্য। এই সময় যদি এই সকল সকল স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের উপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না। হিন্দু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং নেতাজী সুভাষ বসু এ ব্যাপারটা বুঝেছিলেন, তাই তাঁরা অনেক সময় হিন্দুদের হঁশিয়ার করেছিলেন। কবিগুরুও তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে হিন্দুদের সাবধান করেছেন।’
নেতাজির সংগ্রামী জীবনাদর্শ তরুণ শেখ মুজিবের মনে গভীর দাগ কাটে। বঙ্গবন্ধুর আপোসহীন সংগ্রামী যে জীবন তাঁর ভিত্তি অনুসন্ধানে আমরা খোঁজে পাব নেতাজিকে। কারাপ্রকোষ্ঠে মুজিব শ্রদ্ধার সঙ্গে নেতাজির ত্যাগের মহিমা বর্ণনা করেছেন তাঁর জীবনালেখ্যে। তিনি লিখছেন, ‘‘আমাদেরও ইংরেজের বিরুদ্ধে একটা জাত ক্রোধ ছিল। হিটলারের ফ্যাসিস্ট নীতি আমরা সমর্থন করতাম না, তথাপি যেন ইংরেজের পরাজিত হওয়ার খবর পেলেই একটু আনন্দ লাগত। এই সময় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যদের দলে নিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন। মনে হত, ইংরেজের থেকে জাপানই আমাদের আপন। আবার ভাবতাম, ইংরেজ যেয়ে জাপান আসলে স্বাধীনতা কোনোদিনই দিবে না। জাপানের চীন আক্রমণ আমাদের ব্যাথাই দিয়েছিল। মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুর থেকে সুভাষ বাবুর বক্তৃতা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠতাম। মনে হত, সুভাষ বাবু একবার বাংলাদেশে আসতে পারলে ইংরেজ তাড়ান সহজ হবে। আবার মনে হত, সুভাষ বাবু আসলে তো পাকিস্তান হবে না। পাকিস্তান না হলে দশ কোটি মুসলমানের কি হবে? আবার মনে হত, যে নেতা দেশ ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারেন তিনি কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। মনে মনে সুভাষ বাবুকে তাই শ্রদ্ধা করতাম।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের সময়ে ১৯৪৫ সালের ১৭ আগস্ট সায়গন থেকে নেতাজির অজানা বিমানযাত্রার পর চলে গেছে সাত দশক। এর পর ইতিহাসের এই মহানায়ককে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। একের পর এক তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছে। হয়েছে তাঁকে মৃত প্রতিপন্ন করতে সরকারি বা আন্তর্জাতিকভাবে নানা চেষ্টা। তা সত্বেও কল্পলোকের রাজপুত্র হয়ে বার বার গণমানুষের আলোচনায়, কখনো রাশিয়ায়, কখনো সাইবেরিয়ায়, কখনোবা চীনে কিংবা প্যারিসে-ভিয়েতনামে নেতাজির উপস্থিতির খবর বেরিয়েছে।
সবশেষে আশির দশকে ভারতের উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদেও আশ্রমে গুমনামিবাবা বা ভগবানজির ছদ্মবেশে নেতাজির উপস্থিতির খবর সাম্প্রতিক দশকেও আলোচনার তুঙ্গে। ভারতবর্ষের বহু সাধুরা বার বার উচ্চারণ করেছেন, নেতাজি আজও জীবিত-তিনি ভারতে ফিরে আসবেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে কলকাতা সফরে গিয়ে রেড রোডে নেতাজির প্রতিকৃতিতে অবনত শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তাঁর আদর্শ পুরুষের প্রতি। পরবর্তীতে বাংলাদেশে নেতাজিকে নিয়ে বাংলাদেশের কোনো সরকার প্রধান বা জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক উপমহাদেশের মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে স্মরণ রাখেননি। শ্রদ্ধা জানাননি সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই বীর বাঙালিকে।
-লেখক : প্রধান সম্পাদক, বহুমাত্রিক.কম ও নেতাজি গবেষক।
সহায়ক গ্রন্থ
-সুভাষ ঘরে ফেরে নাই : শ্যামল বসু
-অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান
- নেতাজি গেলেন কোথায়? (১৯৯৫) : ড. জয়ন্ত চৌধুরি
বহুমাত্রিক.কম