
ঢাকা: ১৭ নভেম্বর তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশ অর্থনৈতিক শুমারি প্রকাশিত হলো। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বোঝার জন্য এ শুমারির গুরুত্ব খুবই বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো অর্থনৈতিক শুমারি পরিচালনা করে।
সেবার এর শিরোনাম ছিল ‘Census on Non-Farm Economic Activities and Disabled Persons’। ১৯৮৬ সালের ২৭ থেকে ২৯ ডিসেম্বর দেশজুড়ে এ শুমারি পরিচালনা করা হয়। ওই বছরের শুমারিতে যেসব প্রতিষ্ঠান এবং খানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করত, সেগুলোকে শুমারির আওতায় আনা হয়েছিল। তবে কৃষি খানাগুলোকে শুমারির আওতায় রাখা হয়নি।
দ্বিতীয়বার অর্থনৈতিক শুমারি দুই ধাপে পরিচালনা করা হয়- ২০০১ সালের ২৭ থেকে ৩১ মে শহরাঞ্চলে এবং ২০০৩-এর ২০ থেকে ২৬ এপ্রিল গ্রামাঞ্চলে। দ্বিতীয়বারের শুমারিতে সব ধরনের অকৃষি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে গ্রাম ও শহরের অকৃষি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চিহ্নিত করতে গিয়ে তিন ধরনের অর্থনৈতিক ইউনিটের কথা বলা হয়। এগুলো হলে স্থায়ী ও অস্থায়ী প্রতিষ্ঠান এবং খানার প্রাঙ্গণভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
তৃতীয় অর্থনৈতিক শুমারি পরিচালিত হয় ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত। ১০ বছর পর এটি পরিচালনার উদ্দেশ্য ছিল অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য পরিমাপ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণের জন্য সামগ্রিক পরিসংখ্যানগত তথ্য সংগ্রহ করা। এবারের শুমারির জন্য দুই ধাপে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রথম ধাপে ১৫ থেকে ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সালে ৩৭টি জেলায় আর দ্বিতীয় ধাপে, ১৫-২৪ মে ২০১৩ সালে ২৭ জেলায়। এ শুমারিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত খানা, সব ধরনের অস্থায়ী এবং স্থায়ী প্রতিষ্ঠান অন্তর্র্ভুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র উদ্ভবের ১৫ বছর পর ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো অর্থনৈতিক শুমারি করা হয়। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি, কাঠামোগত রূপান্তর, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন বোঝার জন্য বাংলাদেশের প্রথম দিককার চিত্র বিশ্লেষণের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের সময় কোনো অর্থনৈতিক শুমারি করা হয়নি। সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতির অভাব এবং রাষ্ট্রের আর্থিক সম্পদের অপ্রতুলতা এর কারণ হয়ে থাকবে। জনসংখ্যা শুমারি ১০ বছর অন্তর করা প্রথা প্রচলিত।
জনসংখ্যা শুমারির পাশাপাশি যদি অর্থনৈতিক শুমারিও করা হয়, তাহলে জনসংখ্যা এবং এর বিন্যাসের পরিবর্তনকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিবর্তনের সঙ্গে সহ-সম্পর্কিতভাবে দেখতে পারতাম। স্বীকার করতে হয়, ১৯৮৬ সালে অর্থনৈতিক শুমারির সূচনা একটি সঠিক পদক্ষেপ ছিল। তারপর ১৯৯১ থেকে এ শুমারি যদি ১০ বছর অন্তর নিয়মিতভাবে করা হতো, তাহলে অর্থনীতির অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ও সবলতাগুলো চিহ্নিত করে নীতিনির্ধারণের কাজটিকে আরো সবল ও সুঠাম করা যেত।
মজার ব্যাপার এই যে, সর্বজন নিন্দিত এক স্বৈরশাসকের আমলেই প্রথমবারের মতো অর্থনৈতিক শুমারি করা হয়, দ্বিতীয়টি করা হয় ১৫ বছর পর ২০০১-এ। ওই বছরের শুমারিটিও সেই বছর সম্পন্ন করা হয়নি; গ্রামাঞ্চলে সেটি করা হয় ২০০৩ সালে অর্থাৎ দুই বছর পর। সর্বশেষ শুমারিটি করা হলো ২০১৩-এ। এবার একই বছরে দুই ধাপে বিভিন্ন জেলায় শুমারি করা হয়। আমরা আশা করব, এখন থেকে নিয়মিতভাবে ১০ বছর পর পর শুমারি করা হবে।
২০১৩ সালে শুমারি সম্পন্ন হওয়ার পর আমরা সময় রেখার তিনটি বিন্দুতে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা এবং এর প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে জানতে পারলাম। ২০১৩ সালে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা দাঁড়াল ৮০ লাখ ৭৫ হাজার ৭০৪। ২০০১ ও ২০০৩ সালে সংখ্যাটি ছিল যথাক্রমে ৩৭, ০৮, ১৪৪ এবং ১৯৮৬তে ছিল ২১, ৬৯, ৪১৯। ১৯৮৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৩ সালে অর্থনৈতিক ইউনিটের বৃদ্ধির হার ৭১ এবং ২০০১-০৩-এর তুলনায় ২০১৩ সালে এ বৃদ্ধির হার ১১৮ শতাংশ।
মনে রাখতে হবে, ১৯৮৬ থেকে ২০০১ সালের ব্যবধান ১৫ বছরের। অন্যদিকে ২০০১ ও ২০০৩ সালের তুলনায় ২০১৩-এর ব্যবধান মোটামুটিভাবে ১০ বছরের। দেখা যাচ্ছে, গত ১০ বছরে অর্থনৈতিক ইউনিটে প্রবৃদ্ধির হার বেশ ত্বরান্বিত হয়েছে। এর ব্যাখ্যা কীভাবে করা যায়।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, বাংলাদেশে কৃষিবহির্ভূত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। জমি যখন সীমাবদ্ধ থাকে, জনসংখ্যা যখন বাড়ে ভূমিহীন লোকের সংখ্যা যখন বাড়তে থাকে, তখন জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশকে ভূমিনির্ভর জীবনযাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে ভূমিবহির্ভূত জীবনযাত্রা বেছে নিতে হয়। এ সুযোগ না থাকলে অনেক মানুষকেই না খেয়ে মরতে হতো।
তবে ভূমিবহির্ভূত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে শুধু ভূমিহীনরাই কিংবা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষই এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়নি; যাদের কৃষিজমি আছে, তারাও অতিরিক্ত আয়ের জন্য ভূমিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড বেছে নিয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু করার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। এজন্য অর্থের প্রয়োজন। এ অর্থটা এল কোত্থেকে? বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের আয় খুবই কম হওয়ার ফলে ভোগ-ব্যয় মিটিয়ে সঞ্চয় করা কঠিন। এ অবস্থায় অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে চারটি উপায়ে।
প্রথমত. বৈদেশিক রেমিট্যান্সের অর্থ দিয়ে। দ্বিতীয়ত. ঋণ করে। তৃতীয়ত. অকৃষি খাত থেকে (গার্মেন্টসহ) মজুরি আয়ের সমর্থনপুষ্ট হয়ে অর্থলগ্নি করা সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার ফলে। চতুর্থত. কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃৃদ্ধি এবং উচ্চমূল্য কৃষ্টি থেকে আয়জনিত কারণে স্রেফ সঞ্চয় দিয়ে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতিতে কৃষিবহির্ভূত আয় প্রবিষ্ট হওয়ার কারণে (দৃষ্টান্তস্বরূপ বিদেশী রেমিট্যান্স) কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং ক্ষুদ্র ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি- সবকিছু মিলে অর্থনীতিতে কৃষিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণে ভূমিকা রেখেছে। অনেকে বলেন, রেমিট্যান্সের অর্থ প্রধানত ভোগ-ব্যয় নির্বাহে চলে যায়।
উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ সামান্যই হয়। কিন্তু বুঝতে হবে ভোগ-ব্যয় বৃদ্ধিজনিত কারণে পণ্য ও সেবার চাহিদা বাড়ে। এর ফলে অর্থনীতির অভ্যন্তরে এসব চাহিদা পূরণেও তাগিদ সৃষ্টি করে। আমরা কেইনসীয় অর্থনীতির মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্টের কথা জানি। এ কারণে জাতীয় আয়ের ওপর বহুগুণ প্রভাব পড়ে। এ প্রক্রিয়ায় কৃষিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির প্রেরণা সৃষ্টি হয়।
অকৃষি কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির একটি তাৎপর্য হলো, অর্থনীতিতে বাজারমুখী এবং বাজারভিত্তিক কর্মকাণ্ড ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলা। এর ফলে অর্থের ব্যবহার বাড়ে। অর্থনীতি আশোষণশীলতার মণ্ডল থেকে বেরিয়ে ক্রমান্বয়ে আর্থিক লাভ-ক্ষতির মণ্ডলে প্রবেশ করে। এতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আপোষণশীলতার যৌক্তিকতা (Rationality) থেকে বাণিজ্যায়নের যৌক্তিকতায় উত্তরণ ঘটে। অর্থের সম্পর্ক সম্প্রসারণ দেশের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি বিশ্বপর্যায়ে সম্পর্কিত হয়। ফলে যতই দিন যাবে, বিশ্ব অর্থনীতির উত্থান-পতন এবং সংকটের আঁচ আমাদের স্পর্শ করবে।
রেমিট্যান্সপ্রবাহ একটি দেশবহির্ভূত তাড়না। কোনো কারণে রেমিট্যান্সপ্রবাহের মন্থরতা অর্থনীতির এ রূপান্তরকে শ্লথ করে দিতে পারে, এমনকি অর্থনীতিকে সংকটে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের জন্য গার্মেন্ট খাত অধিকতর সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিলেও খাতটিতে বিদ্যমান নৈরাজ্য এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের শঙ্কায় ফেলে দেয়।
সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর আমাদের যেমন আশান্বিত করে তোলে, ঠিক একইভাবে বৈদেশিক রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্ট খাতের চ্যালেঞ্জ আমাদের সন্দিহান করে তোলে।
অকৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির নিছক জীবনযাত্রার পরিবর্তনেরই চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে না, এটি নগরায়ণেরও বার্তাবাহক।
বাংলাদেশের সর্বত্র অকৃষি কর্মকাণ্ডের বিকাশ নগরায়িত জীবনযাত্রার স্ফূরণ ঘটাচ্ছে। এ নগরায়ণই কোনো নির্দিষ্ট নগরকেন্দ্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না। অবশ্য এ ধারা অব্যাহত থাকার শর্ত হচ্ছে, অকৃষি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অব্যাহত বিকাশ। কৃষি, কৃষক ও গ্রামভিত্তিক বাংলাদেশ দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
এ পরিবর্তন নগরভিত্তিক জীবনযাত্রামুখী। বাংলাদেশের গ্রামে সাত-আট বছরের ব্যবধানে ক্ষুদ্র একটি চায়ের দোকানকে কেন্দ্র করে মার্কেট গড়ে উঠতে আমরা দেখি।
গ্রামে ডাবের পানি গুড়-মুড়ি, পিঠা-পায়েসের পরিবর্তে কোমালপানীয়, চানাপুর বিস্কুট, দিয়ে অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়নের যে অভ্যাস গড়ে উঠছে, সেটি নগর সংস্কৃতি প্রসারে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এছাড়া রয়েছে জিন্স, চামড়ার পাদুকা, ব্যবহারের মতো অভ্যাসগুলো। কুঁড়ে কিংবা বেড়ার জায়গায় উঠছে ইট-সিমেন্টের ঘর। পাকা সড়কে দ্রুতগামী যানের ব্যবহার, মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগ ছড়িয়ে পড়ছে। বদ্যি, কবিরাজের স্থলে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা অনেক বেশি।
গ্রামেও বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানাদির জন্য কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবহার বাড়ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়লে এ প্রবণতায় গতি বাড়বে। আগামী ৪০-৫০ বছরের মধ্যে গোটা বাংলাদেশটাই হয়ে যাবে একটি নগররাষ্ট্র। নগররাষ্ট্র হিসেবে সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের কথা আমরা জানি। কিন্তু এগুলো আকৃতি ও জনসংখ্যায় বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র। মনে হচ্ছে, বর্তমান শতাব্দী শেষ হওয়ার অনেক আগেই বাংলাদেশ একটি নগররাষ্ট্রে পরিণত হবে। এ রাষ্ট্রের ভৌত চাহিদা পূরণের জন্য চিন্তাভাবনা এবং প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।
রাজনৈতিক সংঘাতের আবর্তে এসব নিয়ে ভাবার ফুরসতই পাচ্ছেন না রাজনীতিকরা। দেখা যাবে, পরিবর্তিত পরিস্থিতি একসময় এমন চাপ সৃষ্টি করবে, যা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
সর্বশেষ অর্থনৈতিক জরিপ থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আঞ্চলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ঢাকায় সবচেয়ে বেশি।
এরপর ক্রমানুসারে রয়েছে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট। ঢাকার প্রথমস্থান অধিকার বোধগম্য। রাজধানী নগরীর অর্থনৈতিক গভীরতাকে ভিত্তি করে সামগ্রিকভাবে ঢাকার এ অর্জন। চট্টগ্রাম বন্দর নগরী। বন্দর অর্থনীতির নিজস্ব কিছু ব্যতিক্রমী চাহিদা আছে। তাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা বৃদ্ধির পেয়েছে।
অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো করে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। শুধু সংখ্যার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক ইউনিটের এমন ক্রমনির্ধারণ বিজ্ঞাসম্মত নয়। মোট জনসংখ্যা বা খানার সংখ্যার সঙ্গে অর্থনৈতিক ইউনিটের অনুপাত আমাদের আরো সন্তোষজনক চিত্র উপহার দিতে পারে। সিলেটে দীর্ঘকাল ধরে রেমিট্যান্স আসছে ব্রিটেন থেকে।
তবু সিলেটে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা সেভাবে বাড়েনি। এখানে একটি পরিবার রেমিট্যান্সের যে অর্থ পায়, সেটা অন্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি। বহিঃদেশ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ পাওয়া সিলেটের আধিবাসীর মধ্যে উদ্যোগ-স্পৃহা খর্ব করে দিয়েছে কিনা সেটাও ভাবার বিষয়।
সিলেটে প্রবাসী আয় সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণে ব্যবহার হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু উদ্যোগ ও ঝুঁকি গ্রহণ তুলনামূলকভাবে দৃশ্যমান নয়। অর্থনীতিবিদরা উদ্যোগের তত্ত্ব নির্মাণ করতে গিয়ে প্রাথমিক আর্থিক Endowment এর পরিমাণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসেবে ভাবতে পারেন। বিনা চেষ্টায় বিনা শ্রমে মোটা অঙ্কের অর্থপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকলে নতুন অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণে ঝুট-ঝামেলায় জড়ানোর ইচ্ছা থাকে না বললেই চলে। আঞ্চলিক তারতম্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে উদ্যোগ-স্পৃহার কারণটিও নির্ণয় করা দরকার।
ঢাকায় অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং ঊর্ধ্বগামী হলেও ১৯৮৬ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশের তুলনায় এর হিস্যা ৩১-৩২ শতাংশের মাঝে স্থির রয়েছে। ঢাকা ছাড়াও অন্য বিভাগগুলোয় অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাশাপাশি এ বৃদ্ধির হারও একই মাত্রায় বেড়েছে।
বাংলাদেশের স্থায়ী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, অর্থনৈতিক কাঠামো টেকসই এবং আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির বৃত্ত প্রসারিত হচ্ছে। এ বিকাশকে কেন্দ্র করে সরকার ভ্যাট ও আয়কর বাড়াতে পারে। ফলে সরকারের কল্যাণমুখী অর্থ ব্যয় বাড়ানো সম্ভব হবে। গত এক দশকে খানাভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ মানুষ এখন নিজ আবাসে থেকেই সাইড লাইন ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটিজ বাড়াচ্ছে।
গত ১০ বছরে শহরাঞ্চলের (৬২.৯ শতাংশ) তুলনায় গ্রামাঞ্চলে (১৫০.৬ শতাংশ) অর্থনৈতিক ইউনিটের হার বৃদ্ধির প্রবণতা বেশি। এটি একটি শুভ লক্ষণ। বাংলাদেশের গ্রামগুলো চিরায়ত গ্রামীণ বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। দরিদ্রপ্রবণ রংপুর বিভাগে ব্যাষ্টিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা বাড়ছে। এ বিভাগে ১৯৮৬ সালে অর্থনৈতিক ইউনিট ছিল ২,০৮,১৩৫টি। ২০০১-০৩-এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪,০৫,৫৮৩টিতে এবং ২০১৩ সালে দাঁড়িয়েছে ১০,৮৮,২৫৫টিতে।
অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে এ বৃদ্ধির পরিমাণ আড়াই গুণের মতো। এ প্রসঙ্গে মাও জে দংয়ের একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। তিন বলেছিলেন দারিদ্র্য ভালো, কারণ দারিদ্র্য পরিবর্তনের তাগিদ সৃষ্টি করে। ২০১৩ সালের শুমারি থেকে দেখা যায়, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, মোটরগাড়ি ও মোটরসাইকেল মেরামত এবং পরিবহন ও গুদামজাতকরণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
এছাড়া রয়েছে অন্যান্য সেবামূলক কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশের অর্থনীতি সামষ্টিক পর্যায়ে সেবা খাতনির্ভর। এর প্রবৃদ্ধির গতিও প্রধানত সেবাখাতমুখী। বোঝাই যাচ্ছে, যেসব কর্মকাণ্ড সেবার চাহিদা সৃষ্টি করে, সেগুলো দেশের ভেতরে নেই। এগুলোর অবস্থান অন্য দেশে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে এগুলো অন্য দেশ থেকে আমদানি হয়ে বাংলাদেশে আসে।
ধরা যাক, মোটরযানের কথা,। মোটরযানগুলো বিদেশ থেকে আসে। কোনো কোনো মোটরযানের ক্ষেত্রে এগুলোর খোলস দেশে নির্মাণ হলেও মূল যন্ত্রটি বাইরেই তৈরি হয়। সুতরাং আমদানি সক্ষমতার ওপর বাংলাদেশের সেবা খাতের বিকাশ নির্ভর করছে। কোনো কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিলে, বিদ্যমান সেবা খাতের বিকাশও বাধার মুখে পড়বে।
অন্যদিকে গার্মেন্টের মতো রফতানি খাতও চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এ খাতে চ্যালেঞ্জ আসছে মূলত সুশাসনের অভাব থেকে। সার্বিক বিচারে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্ত বুনিয়াদের ওপর দাঁড় করাতে প্রয়োজন বিনিয়োগ, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং সুশাসন।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
বহুমাত্রিক.কম