Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১২ ১৪৩১, শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪

রহস্যের অবগুণ্ঠনে আশা ভৈরবী

অর্ঘ্য

প্রকাশিত: ১১:৪১, ৭ অক্টোবর ২০১৭

আপডেট: ১১:৪৭, ৭ অক্টোবর ২০১৭

প্রিন্ট:

রহস্যের অবগুণ্ঠনে আশা ভৈরবী

সংগীতের জন্ম ইতিহাস সম্পর্কে আজও কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভাব হয়নি। সভ্যতার ক্রমবিবর্তন ধারায় সঙ্গীত আজও সমভাবে বর্তমান। সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায় অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতে স্পন্দিত হয়ে আসছে মানুষের হৃদয়। এই প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বাক্ষী যুগে যুগে জনমনে বিমূর্ত ভাব ধারার সৃষ্টি করে আসছে সংগীত প্রেমী বা অ-প্রেমী নির্দ্বিধায় সকল মানুষের মাঝে। যুগের চাহিদা অনুসারে এতে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা, বহু প্রতিবন্ধকতা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে সংগীত আজও সমান ভাবে সমাদৃত।


প্রকৃতার্থে সংগীতপ্রেমী বা সমঝদার না হলে রাগ সংগীত পিপাসু হওয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সংগীত শিক্ষাবস্থায় শাস্ত্রীয় সংগীত পাঠ এবং সে সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জন অতি আবশ্যিক। সঙ্গীতের মূলমন্ত্র হচ্ছে রাগ সংগীত। শিল্পের বিকাশ ঘটে শাস্ত্রীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে, কিন্তু বর্তমান রাগ সংগীত চর্চায় ততোটা যত্নবান নন শিল্পীরা। যার ফলে পূর্ব প্রচলিত বহু রাগ সমাদরের অভাবে হারিয়েও গেছে।

বর্তমান সংগীত চর্চার প্রসার লাভ ঘটলেও সংগীত গ্রন্থের যথেষ্ঠ অভাব বিদ্যমান। সংগীতের প্রাণ রাগ, সংগীতে রাগ, রূপ সৃষ্টি হয় স্বরের সাহায্যে। স্বর সমষ্টি বা রাগকে তাই একটি শক্তিবিশিষ্ট বস্তু বলে থাকেন সংগীত বিশেষজ্ঞরা। সুর কোন না কোন রাগের রূপ প্রকাশ করে থাকে। নজরুল সংগীতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাংলা গানের সূচনা হয় বৌদ্ধ ধর্মীয় গীতির মাধ্যমে, সেই বিমূত ধর্ম সংগীত ভাব জগতের অনন্ত পরিসর অতিক্রম করতে বাংলা গানের সময় লেগেছে প্রায় হাজার বছর।

প্রসঙ্গ ছিল আশা ভৈরবী রাগ। আশা ভৈরবী রাগ অতি প্রাচীন কারণ এটি একটি অ-প্রচলিত রাগ। ‘সংগীত কোষ’ করুণাময় গোস্বামী রচিত এবং বাংলা একাডেমি,ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থে আশা ভৈরবী রাগের উল্লেখ পাওয়া যায় যা কবি নজরুল সৃষ্ট রাগ হিসাবে পরিচিত (পৃ: নং-৩৪৫)। এছাড়াও নজরুল সংগীতের সুর ইদ্রিস আলী রচিত গ্রন্থে ৬ষ্ঠ অধ্যায় নজরুল সৃষ্ট রাগের মধ্যে আশা ভৈরবী রাগের উল্লেখ্য পাওয়া যায়।

আরোহন : সা ঋা জ্ঞা সা ঋা মা পা দা ণা পা দা র্সা
অবরোহণ : সা দা প মা ঋা র্সা
বাবী স্বর : পঞ্চম
সমবাদী স্বর : ষড়জ
ঠাট : ভৈরবী

এখানে নজরুলের লেখা গান হলো ‘মৃত্যু নাই, নাই দুঃখ আছে শুধু প্রাণ’। গানটি স্বরলিপি গ্রন্থ নবরাগে পাওয়া যায়। স্বরলিপিকার শ্রী জগৎ ঘটক তাল-ত্রিতাল অবরোহণে নিখাদ ও গান্ধার গুপ্ত। আশা ভৈরবী রাগ নজরুল সৃষ্ট রাগ হিসাবে গণ্য। ১২ নভেম্বর সকাল ৯টায় কলকাতা বেতার প্রচার করে এটি ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ। শ্রীজগৎ ঘটকের উদাসী ভৈরব নামক একটি নাটিকায়। এই রাগ উপরোক্ত গানটিতে নজরুল ব্যবহার করেছেন। রাগটি সম্পূর্ণ- ঔড়ব রাগ, গানটি উত্তরাঙ্গ প্রধান রাগ, রাগটি গাইবার সময় দিবা প্রথম প্রহর।

পকড়: সা ঋা জ্ঞা র্সা ঋা মা পা মা ঋা সা এই রাগে কবি নজরুলের একটি মাত্র গানই পাওয়া যায়।

প্রকৃতি:গম্ভীর, রস-করুণ। আশা ভৈরবী নামে একটি শাস্ত্রীয় রাগ রয়েছে। সুরেশ চক্রবর্তী মহোশয়ের “রাগ রূপায়ন” গ্রন্থে তা উল্লেখ করেছেন।

আশা রাত্রি গেয় এবং উত্তর প্রদেশের আঞ্চলিক সংগীত থেকে গৃহীত। এর সাথে ভৈরবী মিশ্রণের কোন সংগতি নেই। কবি নজরুল ইসলাম এ রাগে ভৈরবীর মিশ্রণ করেনি।

সা ঋা জ্ঞা সা স্বর বিন্যাস বিশেষ ভাবে ব্যবহার বৈচিত্র্য এনেছেন মাত্র। ফলে এই রাগে অন্য রাগের রূপ পাওয়া যায় না। এই রাগের সমপ্রকৃতির রাগ শুদ্ধ শান্ত। আশা ভৈরবী বিষ্ণুপুর ঘারানার রে যুক্ত যোগীয়া, বৈরাগী, গুণকেলী, ভৈরবী ঠাটের অন্তর্গত।

আশা ভৈরবী রাগ সম্পর্কে কাঙ্গালী চরণ সেন (স্বরলিপিকার) ‘বরিষ ধারা মাঝে শান্তির বারি’ গানটি আশা ভৈরবী রাগে উল্লেখ করেছেন। স্বরবিতান ‘বরিষ ধারা মাঝে শান্তির বারি’ গানটিতে উল্লেখ আছে। গানটি আশা ভৈরবী রাগে, ত্রিতাল নিবদ্ধ। গানটি সংগীত গীতাঞ্জলী ব্রক্ষ্ম সংগীত স্বরলিপি গ্রন্থে পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, রবি ছায়া প্রকাশিত হয় বাংলা বৈশাখ ১২৯২। গানটির রচনা কাল কবিগুরু ১২৯০ বাংলা ১৮৮৪ খ্রিষ্ট্রীয় সন। গানটি পূজা পর্যায় উপধারায় প্রার্থনায় । কবিগুরুর তখনকার বয়স ২২ বছর। পাদটীকা- তাল ঠুংরী [ব্র-স্ব] (২/২/২/২) প্রচলিত ও [ব্র-স্ব] এর মধ্যে সুর ভেদ আছে।

‘মৃত্যু নাই নাই দুঃখ’ গানে শ্রী জগৎ ঘটক আশা ভৈরবী রাগ উল্লেখ করেছেন। এই রাগ কি একই? বা পূর্বে আশা ভৈরবী নামে কোন রাগ ছিল কি না তার কোন প্রমাণ আপাতত দৃষ্টিগোচর নয়। হয়তো হতে পারে এটি কোন প্রচলিত রাগ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও কাঙ্গালীচরণ সেন যে বিষয় জ্ঞাত ছিলেন।

আমরা জানি কবি নজরুল ১৯৩৬ এর দিকে অপ্রচলিত এবং লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিনী নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন। এগুলো ছিল নজরুল রচিত ‘হারামনি’ অনুষ্ঠানভিত্তিক। উল্লেখ কবিগুরু এই রাগের উল্লেখ করেছেন যখন তখন থেকে প্রায় ৫২ বছর পরে এসে কবি নজরুল তার একটি মাত্র গানে এই রাগ ব্যবহার করেছেন।

এখন প্রশ্ন থেকে যায় কবিগুরুর আশা ভৈরবী এবং নজরুলের আশা ভৈরবী কি একই রাগ? তবে যাই হোক দু’জনেই গানে আগন্তুক স্বর ব্যবহার করেছেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ শুদ্ধ রা ব্যবহার করেছেন- কবি নজরুল শুদ্ধ ধা শুদ্ধ ণা ব্যবহার করেছেন।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত ও নাট্যকলা বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী

 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer