Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ২০ ১৪৩১, শনিবার ০৪ মে ২০২৪

বাংলাদেশের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা

মুকিত মজুমদার বাবু

প্রকাশিত: ০০:৪১, ১২ জুন ২০১৫

আপডেট: ২১:৩৩, ১৪ জুন ২০১৫

প্রিন্ট:

বাংলাদেশের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা

ছবি-প্রকৃতি ও জীবন ফাউণ্ডেশন

ঢাকা: সিলেটের হাকালুকি, টাঙ্গুয়া হাওর, নড়াইলের মারঝাত বাঁওড়, সুন্দরবন, কক্সবাজার-টেকনাফ পেনিনসুলা, সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া দ্বীপ, ঢাকা বেষ্টিত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী, গুলশান-বারিধারা লেক-ইসিএ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। ইসিএ অর্থাৎ Ecologically Critical Area.

বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। পরিবেশ নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কাছে ইসিএ শব্দটি পরিচিত হলেও সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটাই অপরিচিত। একটি দেশের নির্দিষ্ট স্থান তখনই ইসিএ ঘোষণা করা হয় যখন সেটা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে বিলীন হয়ে যাওয়ার আগে সতর্কতার সাথে নির্দিষ্ট জায়গা সংকটমুক্ত করে তোলা।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর  সংশোধিত ধারা ৫-এর বিভিন্ন উপ-ধারায় এর বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। আমি মনে করি এ দায়িত্ব কোনো একজনের নয়, নয় কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। এ দায়িত্ব সকলের। প্রকৃতি বাঁচাতে সুন্দর আগামী গড়তে এ কর্তব্যবোধ আমরা কেউই এড়িয়ে যেতে পারি না।

Nature_threatসুন্দরবন। সবুজে ভরা মায়া কানন। পৃথিবীর বৃহত্তর ম্যানগ্রভ এ বন দেশ তথা বিশ্বের কাছে ধরা দিয়েছে এক অপরূপ রূপে। এ বনের ভুবনমোহিনী সৌন্দর্য যেমন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষদের মুগ্ধ করে তেমনি এর বহুমাত্রিক সম্পদও আমাদের কাছে অমূল্য হিসেবে বিবেচিত। সুন্দরবন স্থলজ ও জলজ এই দুইয়ের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিবেশব্যবস্থার এক চমৎকার সহাবস্থান। প্রবাহমান ছোট বড় অসংখ্য নদ-নদীর জোয়ার-ভাটার কারণে এ বন যেন চিরজাগ্রত এক নিসর্গ। উদ্ভিদ ও প্রাণী মিলেমিশে টিকিয়ে রেখেছে বনের প্রতিবেশব্যবস্থা। পরিবেশের ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়ের কারণে সুন্দরবনের চারপাশের প্রান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ভরা যৌবনে সমুদ্দুরে রূপ নেয় দেশের হাওরগুলো। এর মধ্যে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন হাওর হল সিলেটের হাকালুকি ও টাঙ্গুয়া। হাওরের প্রায় সব জায়গাতেই বৈচিত্র্যময় জলজ উদ্ভিদের জন্ম ও  বেড়ে ওঠা। রয়েছে নলখাগড়ার ঝোঁপ, নিমজ্জিত ও ভাসমান উদ্ভিদ, শৈবাল ইত্যাদি। আরও চোখে পড়ে ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও অমেরুদন্ডী প্রাণী। শীতের সময় হাওর পরিণত হয় হাজার হাজার পরিযায়ী পাখিদের আবাসস্থলে। এ দু’টি হাওরই আজ প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন।

সংকটাপন্ন বাঁওড়ের মধ্যে রয়েছে নড়াইলের মারঝাত বাঁওড়। স্বচ্ছ পানির এই অশ্বক্ষুরাকৃতির হ্রদটি বাংলাদেশের জলাভূমির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে দিন দিন অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে এর জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ মিঠা পানির জলাধারা।

Nature_threatবাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর সাগর সৈকত কক্সবাজার-টেকনাফ পেনিনসুলা। বন্যপ্রাণীর প্রজননক্ষেত্র ও উপস্থিতির দিক থেকে টেকনাফ পেনিনসুলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই সৈকত অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীদেরও নিরাপদ চারণভূমি। বর্তমানে পেনিনসুলাকেও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন স্থান হিসেবে বিবেচনায় এনে তা সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

তিনদিকে সমুদ্র সৈকত, সাগরলতায় ঢাকা বালিয়াড়ি, কেয়া-নিশিন্দার ঝোঁপ, ছোট-বড় খাল বিশিষ্ট প্যারাবন নিয়ে গড়ে উঠেছে সোনাদিয়া দ্বীপ। এটি অলিভ রিডলি কাছিমের প্রজননস্থল ও বিভিন্ন স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখিদেরও আবাসস্থল। এই দ্বীপেই দেখা যায় পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন পাখি চামচঠুঁটো বাটান। এছাড়া শামুক, ঝিনুক ও অন্যান্য অমেরুদ-ী প্রাণীর জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। দ্বীপটি বর্তমানে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল সহায়ক দ্বীপ সেন্টমার্টিন বা নারিকেল জিঞ্জিরা। সারি সারি নারিকেলের গাছ, দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের গর্জন, নীল জলরাশির তীরে আছড়ে পড়া, পানির নিচের জীবন্ত প্রবাল আর নানা বৈচিত্র্যের মাছ ও প্রাণীর ছুটোছুটি সবকিছুই সেন্টমার্টিনকে দিয়েছে আলাদা এক সৌন্দর্য।

বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিভিন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণীদেরও এক স্বর্গরাজ্য দ্বীপটি। অনিয়ন্ত্রিত সম্পদ আহরণ ও অপরিকল্পিতভাবে গজিয়ে ওঠা হোটেল-মোটেলের বর্জ্য, পর্যটকদের ফেলে আসা ময়লা-আবর্জনা, জাহাজের দূষণ দ্বীপটিকে করে তুলেছে বিপন্ন। দ্বীপটির সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রাখতে সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত গুলশান-বারিধারা লেক। শহরের ময়লা-আবর্জনা ও দু’ধারে আকাশছোঁয়া অট্টালিকা গড়ে ওঠার কারণে দিন দিন নিজস্বতা হারাচ্ছে লেকটি। নানাভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে লেকের জায়গা। জীবন্মৃত হয়ে কোনও রকম অস্তিত্ব ঘোষণা করছে লেকটি। সঙ্গত কারণেই অদূর ভবিষ্যতে যাতে লেকটি হারিয়ে না যায় তার জন্য প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তারপরও একমাত্র ভবিতব্যই জানে লেকটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে নাকি রাজধানীর সৌন্দর্যের অঙ্গ হিসেবে টিকে থাকবে?

ঢাকার চারদিকে বেষ্টিত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীও ইসিএ হিসেবে ঘোষিত। এক সময়ের প্রমত্তা এই নদীগুলোই ছিল ঢাকা শহরের প্রাণের স্পন্দন। মৎস্য সম্পদের যোগান, পণ্য পরিবহন, মানুষের জীবিকাসহ নানান কাজে নির্ভর করতে হতো নদীগুলোর উপর। ভ্রমণপিপাসুদের চিত্ত বিনোদনের পাশাপাশি নদীগুলো ছিল উভচর ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের অন্যতম আবাসস্থল। বর্তমানে কলকারখানা থেকে নির্গত অপরিশোধিত রাসায়নিক পদার্থ, গৃহস্থালী আবর্জনা, শহরের বর্জ্য ও পলিথিন ক্রমাগত দূষিত করে চলেছে এই নদীগুলোকে। এছাড়া অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নদীগুলোর গতিপথ। অতীতের প্রাণসঞ্চারী নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব জলাশয়ের জীববৈচিত্র্য ও সার্বিক প্রতিবেশব্যবস্থা।Nature_threat

যে জাতি নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও মর্যাদা রক্ষায় করতে উদ্যোগী নয় ভবিষ্যতে সে জাতির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। উন্নত বিশ্ব আজ তাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে যেখানে ব্যস্ত সেখানে আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করছি। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাগুলো রক্ষা করতে আজ আইন ও নীতিমালার চেয়ে বেশি দরকার সবার সচেতনতা। দেশের ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়াগুলোর প্রতিটিই স্বতন্ত্র ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এগুলো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল।

উল্লেখিত সংকটাপন্ন এলাকাগুলোর উপর হুমকি মানেই ওই নির্দিষ্ট এলাকার প্রতিটি উপাদানেরই ক্ষতি, যার প্রভাব পড়ে গোটা পরিবেশের উপর। আসুন, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ঐতিহ্যের স্মারকসমূহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হই। আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাই সুন্দর ও সুস্থ পৃথিবী।

Babu_Impressলেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer