কুষ্টিয়া: ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ বর্তমান সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার। এনিয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নানা সমালোচনা-বিতর্ক থাকলেও প্রযুক্তির কল্যাণে তৃণমূল থেকে জাতীয় উন্নয়নের গতি সঞ্চারের বিষয়টি কেউই অস্বীকার করবেন না হয়তো।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে মাঝেমধ্যে কিছু অপরাধ সংঘটনের খবর এলেও প্রচুর ইতিবাচক নজিরও সৃষ্টি হচ্ছে, যেসবের খবর হয়তো আমরা অনেকেই রাখি না।
অনলাইন দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে প্রচুর জনকল্যাণ সাধনের ঘটনা রয়েছে দেশের আনাচে-কানাচে। প্রযুক্তির ব্যবহারিক ইতিবাচক দিক নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন আমাদের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি এস এম জামাল। তার প্রতিবেদনে থাকছে বিস্তারিত-
দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানীখ্যাত কুষ্টিয়া জেলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আমজনতার তুলে ধরা তথ্য বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ত্বড়িৎ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাই উপকারভোগী মানুষদের কাছে ‘ফেসবুক’ বিবেচিত হচ্ছে ত্রাণকর্তা হিসেবে।
কুষ্টিয়ার এক তরুণ ফারুক খান। ফেসবুক পেইজে তার এলাকার রাস্তা সংস্কারের অনিয়মের বিষয়ে একটি পোস্ট করেন। সেটি কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজেও শেয়ার করেন।
পোষ্টটি জেলা প্রশাসকে গোচরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাৎক্ষনিক বিষয়টি জানবার চেষ্টা করেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে। এসময় ঘটনা সত্য হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনাও দেন জেলা প্রশাসক।
বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন পর দিনই পরিদর্শণে যান ওই রাস্তায় এবং বাস্তবায়ন কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
সামান্য ফেসবুক পেইজের পোস্ট জনপ্রশাসনের এতখানি গুরুত্বেও সঙ্গে বিবেচিত হবে, তা রীতিমতো হতবাক করে দিয়েছে ফারুক খানকে। বিস্মিত ফারুক কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের এই আন্তরিক উদ্যোগে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জাতীয় উন্নয়নে অন্যদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
অন্যদিকে, মিটুল নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী কুমারখালীতে শতবর্ষের এক বৃদ্ধাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতে দেখে তার কাছে এগিয়ে যান। অস্পষ্টভাবে ওই বৃদ্ধা মিটুলকে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেয়ার অনুরোধ করেন। তখন মিটুল কার্ড করে দিতে না পারলেও জেলা প্রশাসকের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবেন বলে আশ্বস্থ্য করেন বৃদ্ধাকে।
মিটুল বৃদ্ধার একটি তুলে কুষ্টিয়া ডিসি অফিস ফেসবুকের পেইজে পোস্ট করেন। এর কয়েকদিন পর তিনি জানতে পারেন বয়স্ক ভাতার কার্ডের ব্যবস্থা হয়েছে ওই বৃদ্ধার। এতে বৃদ্ধার চেয়েও বেশি আনন্দিত জেলা প্রশাসকের গোচরে মানবিক আবেদনের খবরটি তুলে ধরা ওই তরুণ।
অন্যদিকে, কুমারখালী উপজেলার নিভৃতপল্লীর খাইরুল ইসলাম নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী বলেন, ‘‘স্থানীয় মোতাহার হোসেন নামের অসহায় বৃদ্ধ ও তার স্ত্রী দুজনেই পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। তাদের জন্য কিছু একটা করবো বলে প্রায় ২বছর ধরে চেষ্টা করেও আমি তার কোন উপকার করতে পারিনি। হঠাৎ ফেসবুকে দেখি কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মহদোয় এমন ফেসবুকের সমস্যার কথা তুলে ধরে পোষ্ট করলেই তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছেন।’’
‘‘আমি পক্ষাঘাত আক্রান্ত ওই দুইজনের ছবি ও তাকে সাহায্যও জন্য ফেসবুকের একটি আবেদন করি। তারপর দেখি জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি সেই পরিবারের সাথে কথা বলেছেন এবং তার বাড়ী করার জন্য ঘর তুলে দিয়েছেন ও চিকিৎসার খরচ ব্যবস্থা করেছেন স্বয়ং জেলা প্রশাসক মহদোয়। শুধু তাই নয়, তাদের প্রতিবন্ধীর ভাতার কার্ডও করে দেওয়া হয়েছে’’-যোগ করেন তিনি।
কুমারখালী উপজেলায় কর্মরত এক সংবাদকর্মী ফেসবুকে মাঠে ইদুরের গর্ত খুড়ে খুড়ে ধান সংগ্রহ করছে ৯২ বছর বয়সী এক দরিদ্র ব্যক্তি এমন একটি ছবি পোষ্ট দেন জেলা প্রশাসকের ফেসবুক ওয়ালে। এর পরের দিনই তাকে সহযোগীতার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন জেলা প্রশাসক।
জামাল খান নামের এক ব্যক্তি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ফেসবুক পেজে মেসেজ পাঠিয়ে অবহিত করেন যে, মিরপুর উপজেলাধীন বলিদাপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সকল দাপ্তরিক অনুমোদনের পরও বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হচ্ছেনা। যার ফলে স্কুলটিতে মাল্টিমিডিয়া সহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা যাচ্ছে না। ফেসবুকে ক্ষুদেবার্তা পেয়ে তাৎক্ষণিক জেলা প্রশাসক ওই বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করেন।
অপরদিকে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফেসবুক ব্যবহারকারী জানান, কুষ্টিয়া শহরে একটি দোকানে কনফেকশনারীর ব্যবসার আড়ালে মাদকের ব্যবসা পরিচালিত হয়, এমন গোপন একটি ম্যাসেজ জেলা প্রশাসকের ফেসবুক পেইজে পাঠানো হয়। জেলা প্রশাসন অবৈধ ব্যবসারোধেও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সচেষ্ট হন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনগণের অভিযোগ-আবেদন জেনে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যক্তিগত মতামত জানতে বহুমাত্রিক.কম-এর মুখোমুখি হয়েছিলেনর জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন। আলাপচারিতায় তিনি জানিয়েছেন এসংক্রান্ত ভাবনার কথা।
সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, ‘‘প্রযুক্তির উৎকর্ষতাকে কাজে লাগিয়ে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বর্তমান সরকার। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ডিজিটাল দেশে পরিণত করতে প্রতিশ্র“তিও রয়েছে এই সরকারের।’’
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘‘জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে সেবা কেন্দ্র থেকে সাধারন মানুষগুলো প্রতিনিয়িত বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারছে। সাধারন মানুষদের আরো ডিজিটাল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা ডিসি অফিস কুষ্টিয়ার ফেসবুক পেজ চালু করেছি। মানুষের সমস্যা এবং দৈনন্দিন চাহিদার ব্যাপারে পোষ্ট করে। পোষ্ট করার সাথে সাথে আমার তাৎক্ষকিভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি। এতে করে সাধারন মানুষ অনেকটাই উৎসাহিত হয়।’’
এর মাধ্যমে অনেক অনিয়মগুলো দুরীভূত হয় স্বীকার করে প্রযুক্তিপ্রিয় এই জেলা প্রশাসক বলেন, ‘‘ফেসবুকের কল্যাণে আমি কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর চর এলাকার মানুষের সাথে যুক্ত থাকতে পারছি। আমি বিস্মিত হয়েছি মানুষের উৎসাহ দেখে। কোনো পোস্ট পাঠানোর পর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সেটারও ফলোআপ করছেন তারা। পুনরায় পোস্ট দিচ্ছেন-কোনা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’’
এধরণের সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম মাঠপ্রশাসনের জবাবদিহিতা ও সক্রিয়তার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখছে বলেও মনে করেন সৈয়দ বেলাল।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতার বদৌলতে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথাও বলেন তিনি। জেলা প্রশাসক বলেন,‘‘ ১৬ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ঘরে বসে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করার সুযোগ তৈরি করতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে।’’
বেকারত্ব মোচনে ডিজিটাল ব্যবস্থা উজ্জ্বল সম্ভবনা নিয়ে হাজির হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বহুমাত্রিক.কম