
ছবি- বহুমাত্রিক.কম
মজুরি কম থাকায় বস্তি এলাকার নার্সারীসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত চা বাগানের বেকার নারী শ্রমিক। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরুষ শ্রমিকদের সমান কাজ করেন তারা। তবে মজুরির ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় বৈষম্য দ্বিগুণ। বছর ঘুরে নারী দিবস আসে যায়। দিবসে নারীদের মজুরি বৈষম্যে শিকার হওয়ার বিষয়টি জোরেশোরে উচ্চারিত হয়। কিন্তু তাঁদের মজুরির কোন পরিবর্তন হয় না। বৈষম্যমূলক মজুরিতেই মৌলভীবাজারের বিভিন্ন নার্সারী, বাসাবাড়ি ও শহরের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনে শতশত নারীরা কর্মরত।
গত মঙ্গলবার কমলগঞ্জের শমশেরনগর-কুলাউড়া সড়কে নার্সারী ও বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনে দেখা হয় কর্মরত কয়েকজন নারীর সাথে। সাবিত্রি রবিদাস, পাবর্তী রবিদাস, শুকরিয়া ও ফুলমতি রবিদাস বলেন, ‘আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করি দিনে মজুরি পাই ১৩০ টাকা। কেউ কেউ পায় ১৫০ টাকা। পুরুষরা কাজ করলে পায় ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। হামরা নারীদের কম মজুরি পাই। কিন্তু পেটের জ্বালায় কাজ করি। একজনের বাগানে কাজ করে বাচ্চা কাচ্ছা লিয়ে সংসার চালানো যায় না। খুব কষ্ট হয়।’
বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শমশেরনগর চা বাগানের নারী শ্রমিক জোৎ¯œা মৃধা বলেন, ‘সিমেন্ট, বালু দিয়ে পাথর মিকচার করা মশলা বহন করছি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করবো। হামদের মজুরি সাড়ে ৩শ’ থেকে চারশ’ টাকা। মাথায় করে সারাদিন মশলা একজন থেকে আরেকজনের মাথা করে বিল্ডিং পর্যন্ত নিয়ে যাই। খুব কষ্ট হয়। পুরুষরা এই কাজ করলে মজুরি কিছু বাড়িয়ে দিতে হয়। হামদের (নারীদের) কাজে এই মজুরি দেয়। এই কাজে পুরুষদের আরো বেশি টাকা দিতে হয়।’
শহরের কিংবা বাসাবাড়ির বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনে ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন কাজে নিয়োজিত চা বাগানের নারীদের আন্তরিকতা, পারদর্শী ও দায়িত্বশীলতার সহিত তারা কাজ করেন। তবে কাজে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব, ঝুঁকি আর কম মজুরিতেই তারা নিয়োজিত। নারী দিবসে সভা, সেমিনার হলেও এসব বিষয়ে দেখার কেউ নেই। শ্রম আইনে বিভিন্ন ধরণের সুযোগ সুবিধার কথা থাকলেও মৌলভীবাজারের চা শিল্পের ও বস্তি এলাকার বেকার নারী শ্রমিকরা বৈষম্যমূলক মজুরিতে প্রতিনিয়ত কাজ করছেন। ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও তারা নিয়োজিত। তবে মজুরিতে দ্বিগুণ বৈষম্য রোধ করার দাবি এসব নারী শ্রমিকদের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘুম থেকে উঠেই নাস্তা সেরে কাজে বের হন আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে রান্নাবান্না করেন চা বাগান আর বস্তি এলাকার বেকার নারী শ্রমিকরা। এভাবেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম। বস্তির অতি দরিদ্র ও চা শিল্পে শ্রমজীবীদের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে বেকারত্ব। বেকার এসব যুবতী ও নারী শ্রমিকরা জীবিকার তাগিদে শিল্পের বাইরে কনস্ট্রাকশন, মাটি কাটা, মাথায় টুকরি নিয়ে ইট, বালু, পাথর বহন করার মতো কাজ করেন। তবে তাদের মজুরি বৈষম্য দীর্ঘদিনের!
চা বাগানে কর্মরত নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা দৈনিক সর্ব্বোচ্ছ ১৭০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। এর বাইরে বিপুল সংখ্যক বেকার নারী শ্রমিকরা বস্তি কিংবা শহরে কাজ করেন। চা বাগানের জরাজীর্ন কলোনী সমুহে গাদাগাদি পরিবেশে বসবাসরত নারী-পুরুষ শ্রমিকরা স্বল্প মজুরি আর বেকারত্বের কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ। এমনিতেই পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে চেহারায় হাড্ডিসার দশা। তার উপর দিনভর কঠিন কাজ। রোদ, বৃষ্টিতে ভিজে, পোক-মাকড়ের আক্রমনের মধ্যেই চলে তাদের কাজ। বেকার নারী শ্রমিকরা চা বাগানে কাজ না পেয়ে সংসারের চাকা সচল রাখতে বস্তি ও শহরে বেঁচে নিয়েছেন কঠিন কাজ।
বস্তির নারী শ্রমিক পারভীন বেগম বলেন, পেটের দায়ে যখন যে কাজ পাই সেটা করতে বাধ্য হই। তারপরও দেড়শ কিংবা দুইশ টাকা রোজ দেয়া হয়। আর পুরুষরা কাজ করলেই তিন থেকে চারশ টাকা পান। আমরাও পুরুষদের চেয়ে কাজ কম করি না।
শমশেরনগর চা বাগানের শ্রমিক লছমী রাজভর বলেন, চা বাগানের নারীদের কাছ থেকে সস্তায় শ্রম পাওয়া যাচ্ছে। বাগানে সারাদিন পরিশ্রম করে মজুরি ১৭০ টাকা, আর শহর-বস্তিতে কাজ করলে সর্ব্বোচ্চ দুশ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা দেয়া হচ্ছে। অথচ পুরুষ শ্রমিকদের বেলায় তিন থেকে চারশ’ টাকা মজুরি। এই বৈষম্য কোন মতেই কাম্য নয়।
মৌলভীবাজার চা শ্রমিক সংঘের নেতা রাজদেও কৈরী বলেন, চা বাগানে কর্মরত আর বেকার শ্রমিকরা বাগানের বাইরে কর্মরত। তারা কঠিন কাজ ও পরিশ্রম করলেও ন্যায্য মজুরি বঞ্চিত। তার উপরে রয়েছে মজুরি বৈষম্য। নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও মজুরি বৈষম্য রোধ হওয়া উচিত বলে তিনি দাবি করেন।