
ছবি- সংগৃহীত
উচ্চ অ্যান্থসায়ানিন সমৃদ্ধ লবণ সহিষ্ণু সীমের নতুন জাত উদ্ভাবন করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের গবেষকরা। অধ্যাপক ড. মোঃ গোলাম রসুল এর নেতৃত্বে দীর্ঘ গবেষণায় উদ্ভাবিত সীমের এই নতুন জাতটি সম্প্রতি জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন লাভ করেছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, নতুন বিইউ সীম-৭ জাতটি লবণসহনশীল ও উচ্চফলনশীল হওয়ায় বাংলাদেশের বিস্তৃত দক্ষিণাঞ্চলে শীত মৌসুমে পতিত থাকা জমির সুষ্ঠ ব্যবহার এবং সেই সাথে অধিক পরিমাণ সবজী উৎপাদন বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হবে।
গবেষকরা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে ২০,৮৮০ হেক্টর জমিতে ১,৪৪,০৫০ টন সীম উৎপাদিত হচ্ছে (বিবিএস, ২০২০)। বিশ্বের তুলনায় (১০.০০ টন/হেক্টর) বাংলাদেশে প্রচলিত জাতসমুহের সীমের ফলন যথেষ্ট কম (৩.০০-৬.০০ টন/হেক্টর)। অধিকন্ত দেশের প্রায় সমস্ত জাতগুলি মৌসুমের একই সময়ে ফলন দেয় এবং বেশীরভাগ চাষী একই সময়ে তাদের সীম বাজারে নিয়ে আসে, ফলস্বরুপ সীমের বাজার মূল্য হ্রাস পায়। তাছাড়া খরা, লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি, পোকামাকড় (এফিড) বা রোগবালাইয়ের আক্রমণে উৎপাদন কমে যায়।
বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৩৭% উপকূলীয় এলাকা। ঐ এলাকাতে চাষ উপযোগী সবজী তথা সীমের অনুমোদিত উফশী তেমন জাত নাই। এমতাবস্থায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা, টেকসই খাদ্য উৎপাদন বজায় রাখা এবং খরা, অতিবৃষ্টি, লবণাক্ততার ঋণাত্বক প্রভাব প্রতিরোধসহ বিস্তৃত উপকূলীয় এলাকায় চাষযোগ্য নতুন জাত উদ্ভাবনই সর্বোত্তম ও বিকল্প উপায়।
উদ্ভাবিত নতু সীমের জাতটির বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরে এই গবেষণা প্রকল্পে নেতৃত্ব দেওয়া বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ গোলাম রসুল গণমাধ্যমকে জানান, উচ্চ ফলনশীলতা এই জাতটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। গাছ প্রতি ২.৪-৩.৫ কেজি ভক্ষনযোগ্য সীম উৎপাদিত হয়। সেই হিসেবে হেক্টর প্রতি সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ফলনশীলতা ৩৫.০ টন।
তিনি জানান, ‘উচ্চ লবণসহিষ্ণুতা এই জাতের সীমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হওয়ায় (১২ ডিএস/এম লবণাক্ততা সহনশীল) দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৯ টি উপকুলীয় জেলাসহ সমগ্র দেশেই এটি আবাদ করা সম্ভব। এছাড়া এই জাতের সীমে উচ্চমাত্রায় অ্যান্থসায়ানিনের উপস্থিতি রয়েছে। যেখানে বিশ্বে টাটকা সবজীতে ০.৫-৩২.০ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম অ্যান্থসায়নিন পাওয়া যায়; সেখানে নতুন জাতটিতে অ্যান্থসায়ানিন রয়েছে ২৯ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম টাটকা সবজী। যা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য।’
‘সীমের কাচা ফলে প্রাপ্ত অ্যান্থসায়নিন হলো পোলিফেনোলিক রঞ্জক যা পরাগায়নে সাহায্যকারী পতঙ্গ এবং বীজ বিস্তরককে আকর্ষণ করে ফসলের বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেই নয় বরং বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গাছকে সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে’-যোগ করেন অধ্যাপক ড. মোঃ গোলাম রসুল।
অধ্যাপক রসুল আরও বলেন, ‘শাকসবজিতে প্রাপ্ত অ্যান্থসায়নিনগুলি মানবদেহের ভাস্কুলার প্রদাহ হ্রাস এবং থ্রোম্বোসিস (রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধা) প্রতিরোধে যথেষ্ট কার্যকরী বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্বীকৃত হয়েছে। অধিকন্ত তারা ক্যারাটিনোসাইট অ্যাওপটোসিসকে বাধা দিয়ে ইউভি তেজক্রিয়তা তথা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। অ্যান্থসায়নিন সমৃদ্ধ খাদ্য পণ্যগুলি তাদের আকর্ষনীয় রং এর কারণে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং তা মানব স্বাস্থের জন্যও উপকারী বলে বিবেচিত হচ্ছে।’
‘ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ ছাড়াও শরীরের মাংস গঠন ও রক্ষণাবেক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন সীম থেকে পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম কচি সীম থেকে ৪-৫ গ্রাম প্রোটিন, ১০ গ্রাম শ্বেতসার, ১ গ্রাম স্নেহ, ২ গ্রাম অম্ল ও কিছু পরিমাণ বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়।’
নতুন এই জাতের সীমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এটি কীটপতঙ্গ প্রতিরোধী। অধ্যাপক ড. মোঃ গোলাম রসুল জানাচ্ছেন, প্রায় সব জাতের সীমই জাব পোকা এবং জ্যাসিড দ্বারা আক্রান্ত হয়। শীতের অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সীমের প্রধান পতঙ্গ শত্রু অর্থাৎ এফিড এবং জ্যাসিড মাত্রাতিরিক্তভাবে বংশবিস্তারের কারণে ফসলটি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে ফলন কমে যায়, যা থেকে নতুন জাতটি প্রতিরোধী। ফলে রঙ্গিন অ্যান্থসায়নিনের অস্তিত্ব পোকামাকড় ও প্যাথোজেন সমূহের সংক্রামনকে হ্রাস করে।
‘নগরকৃষিতে উল্লেখযোগ্য এক সংযোজন’
গবেষকরা জানিয়েছেন, বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ধারণা ছাদ কৃষির জন্য নতুন অবমুক্ত এ জাতটি একটি চমৎকার নির্বাচন হতে পারে। কেননা ফলন ও গাছের আকার বিবেচনায় একটি গাছ ছোট একক পরিবারের সীম চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে বলে সংশ্লিষ্ট প্রজননবিদরা জানিয়েছেন।অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে রোপন করলে ১৩০ দিনে ভক্ষণ যোগ্য ফল সংগ্রহ করা যায়। তবে বীজ সংগ্রহের জন্য আরো ২০ দিন সময় বেশি লাগবে।
উৎপাদন পদ্ধতি
দেশের সকল জেলাতে শীত মৌসুমে এই জাতের বীজ রোপণ করা যেতে পারে। গোবর-মাটির মিশ্রণে ভরা (অর্ধেক-অর্ধেক) ছোট পলিথিন ব্যাগে চারা গজিয়ে পরবর্তীতে মাঠে গর্তে লাগানোই উত্তম। প্রতি গর্তে ১০ কেজি পচা গোবর, ১০ গ্রাম ইউরিয়া (দুইবারে), ৩০ গ্রাম টিএসপি ও ২০ গ্রাম পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে।
বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ৯০% বিবেচনায় নিয়ে প্রতি হেক্টরে ৪.০-৫.০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। বীজ লাগানোর ১৩০ দিনের মধ্যে সবজি ফসল হিসাবে সীম সংগ্রহ করা যায়। তবে বীজ সংগ্রহের জন্য আরো ২০ দিন সময় বেশি লাগবে।
প্রস্ফুটিত ফুলের রং বেগুনি এবং অ্যান্থসায়নিনের উপস্থিতির দরুন ফলের রং গাঢ় লালচে বেগুনী, কান্ডের রং গাঢ় বেগুনী, পাতার রং গাঢ় সবুজ, ফলের আকার লম্বায় ১২ সে.মি. ও চওড়ায় ২.৫ সে.মি, বীজের সংখ্যা ফল প্রতি গড়ে ০৪-০৫ টি এবং ১০০টি বীজের ওজন ৪৪ গ্রাম। এক কঞ্চি বিশিষ্ট বাউনী বা মাচা চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে উৎপাদন করা সম্ভব বিধায় অল্প জায়গায় (১মি./১মি. দুরত্বে প্রতি শতকে ৪০ টি গাছ) অধিক সংখ্যক গাছ লাগানো সম্ভব হবে।
উপকূলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিপ্লব ঘটাতে পারে ‘বিইউ সীম-৭’
জাতটি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ গিয়াসউদ্দীন মিয়া বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুকি মোকাবেলায় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে টেকসই উন্নয়ন বজায় রাখার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ গোলাম রসুল-এর নেতৃত্বে উদ্ভাবিত বিইউ সীম-৭ উল্লেখযোগ্য এক অর্জন।
উপাচার্য বলেন, ‘দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ত পতিত জমি উৎপাদনের মূলধারায় আনয়নে ভূমিকা রাখবে বিইউ সীম-৭। এই সীম উৎপাদনের মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকার কৃষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হবে।’
বহুমাত্রিক.কম