ঢাকা: লিচু নিসন্দেহে আকর্ষণীয় সুস্বাদু একটি ফল। বর্ণে-গন্ধে-বৈচিত্র্যের কারণে এটি সকলের কাছেই আদরণীয়। আমাদের দেশে তো বটেই, বিশ্বজুড়েই লিচুর এ সার্বজনীন সমাদর। নাতিশীতোষ্ণ আবাহাওয়ারচিরসবুজ বৃক্ষ লিচুর জন্য সুনির্দিষ্ট জলবায়ুগত উপযোগীতার প্রয়োজন রয়েছে। যার কারণে লিচুর চাষাবাদপৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি দেশে বাণিজ্যিকভাবে হয়ে থাকে।
ব্যাপক পরিসরে লিচু চাষ হওয়া দেশগুলোর মধ্যে চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ইসরাইল, দক্ষিণ আফ্রিকার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। দেশগুলোর অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চলে এর আবদ হয়ে থাকে। বিশ্বে লিচু নামের সঙ্গে যে দেশটির নাম অনায়াসে চলে আসে তা হচ্ছে চীন। যেখানে বিশ্বের মোট লিচু উৎপাদনের সিংহভাগ হয়ে থাকে। বলা যেতে পারে লিচু চাষের কেন্দ্রন্থল এটি। হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় চাষিরা লিচুর চাষ করে থাকেন। সেখানকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষদের জীবন-জীবিকা এ লিচুচাষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। হক ইপ, গুইয়ে, ফেজিসিয়াও, নোমিচি, হুয়াইঝি কত বাহারি জাত।
চীন দেশে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে প্রথম লিচু চাষের অফিসিয়াল রেকর্ড পাওয়া যায় এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৭৬৬ সালে আনঅফিসিয়াল রেকর্ড পাওয়া যায় । সংগৃহীত প্রাচীন তথ্য থেকে জানা যায়, ১০৭৬ সালের দিকে চীনের গুয়াংডং প্রদেশে এবং ১৫৯৭ সালের দিকে ফুজিয়ান প্রদেশে ১০০ টি লিচুর কালটিভার বা জাত ছিল। সপ্তদশ শতাব্দির শেষের দিকে লিচু অন্যান্য নিকটবর্তী উষ্ম ও নাতিশীতোষ্ণ এলাকা যেমন-বার্মা, ভারত, তাইওয়ান, মরিশাস, মাদাগাস্কার এবং পূর্ব আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। অসথুইজেন (১৯৯২) এর মতে ১৭৮২ সালে পিয়েরে সোনারাট প্রথম লিচুর বিস্তারিত বর্ণনা দেন এবং এর বৈজ্ঞানিক নামকরণ (লিচি চাইনেনসিস সন) করেন।
এরপর লিচু ভারত থেকে ইংল্যান্ড হয়ে ফ্রান্সে যায়। সেখান থেকে ১৮৭৩ সালে হাওয়াই ও ১৮৮৩ সালে ফ্লোরিডাতে যায়। ১৮৫৪ সালে চীনের খনিজ কর্মী লিচুকে অস্ট্রেলিয়াতে নিয়ে যায়। মারিসাস থেকে ১৮৭৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাতে পৌঁছে এবং সেখান থেকে ১৯৩৪ সালে লিচু ইসরাইলে প্রবর্তিত হয়। বাংলাদেশে আঠারো শতকের দিকে সম্ভবত মায়ানমার থেকে লিচু এসেছে । চীন দেশের প্রধান এলাকাগুলো হলো- হাইনান, পূর্ব এবং পশ্চিম গুয়াংডং, দক্ষিণ এবং পূর্ব গুয়াংশি, দক্ষিণ ফুজিয়ান, ইউনান, সিচুয়ান, মধ্য-পূর্ব তাইওয়ান। থাইল্যান্ডের দক্ষিন-চানতাবুড়ি, উত্তর চিয়াংমাই এবং চিয়াং রাই।
ভারতের বিহার, পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, উড়িষ্যা। ভিয়েতনামের দক্ষিন হা টায়, মধ্য হুং ইয়েন, থান হা, উত্তর ব্যাক জিয়ান, ল্যাং সান এবং গুয়াং নি। অস্ট্রেলিয়ার উত্তর কেয়ার্নস্, দক্ষিণ মুরউইল্লামবাহ। দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তর লেবুবু, মধ্য হ্যাজিভিউ, নেলস্প্রুইট এবং মালেরেন, দক্ষিন পোর্ট এডওয়ার্ড। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে যেমন চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, নেপাল, ইসরায়েল, স্পেন, আমেরিকার ফ্লোরিডা প্রভৃতি দেশে প্রায় ৯৬% লিচুর উৎপাদিত হয়। পৃথিবীর দক্ষিণে যেমন অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, মাদাগস্কার, মৌরিসাস, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে মাত্র ৪% লিচু উৎপাদন হয়।
চীনের গুয়াংডং প্রদেশের মাউমিং এ রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন লিচুর অপচার্ড। এখানে স্প্রিং ২০০৮ এর একটা স্টোন এর খোদাইকৃত লেখা থেকে পাওয়া যায় যে, কাউ লিশি নামে এক লোক লিচু এনে উপহার হিসেবে প্রাসাদে প্রেরণ করেন। এভাবে তার নামানুসারে কংগিউয়ান লিচি অরচার্ড এর নামকরণ করা হয়। প্রায় সাড়ে পাঁচ হেক্টরের এ অরচার্ডে ৩৯ টির বেশী ৫০০ বছর বয়সী লিচু গাছ আছে। আছে ৮০০ বছর বয়সী লিচু গাছ। কয়েকটি ১৩০০ বছর বয়সী ফলন্ত লিচু গাছও দেখা গেছে।
লেখক: উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৪
বহুমাত্রিক.কম