ছবি: বহুমাত্রিক.কম
খুলনা : তিন দশক আগে ‘খুলনা হাসপাতাল’ নামে নগরীর বয়রায় স্থাপিত হয় ৭৫ শয্যার হাসপাতাল। পর্যায়ক্রমে হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। পরবর্তীতে এই হাসপাতালকে ঘিরে প্রতিষ্ঠা করা হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ। সেই থেকে ২৫০ শয্যার এই খুলনা হাসপাতালটি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বলে পরিচিতি পায়। তখন থেকেই হাসপাতালটি নানা সমস্য্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ে।
বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালটির সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হলেও কার্যতঃ বাস্তবায়ন হয়নি। আওয়ামী লীগের বিগত সময়ে তৎকালিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন ইউসুফ হাসপাতালটির অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন করেন। ৯ বছর আগে হাসপাতালটি ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও অদ্যাবধি জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। প্রয়োজনীয় জনবল অবকাঠামোর এক তৃতীয়াংশ কর্মকর্তা- কর্মচারী দিয়েই চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ এই হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে ৭০০ রোগী ভর্তি থাকে। আউটডোরে আসে দৈনিক সহস্্রাধিক রোগী। এত রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ২৫০ শয্যার অনুকূলে থাকা চিকিৎসক-সেবিকাসহ অন্যরা।
এ ছাড়া হাসপাতালটিতে অর্থ সঙ্কট রয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের সমস্যা সমাধান ও প্রয়োজনীয় জনবল চেয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার আবেদন জানালেও অদ্যাবধি এর কোন সুরাহা হয়নি। ফলে খুলনা জেলাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে এই হাসপাতালে আসা গরিব ও সাধারণ পরিবারের শত শত রোগী কাক্সিক্ষত সেবা লাভে বঞ্চিত হচ্ছে। মাস তিনেক আগে হাসপাতালটির পূর্ণাঙ্গ জনবল চাহিদা দেয়া হয় সবমিলিয়ে ১ হাজার ৬৫০ জন। এর মধ্যে আগের রয়েছে ৬ শয়ের মত।
পরে ১ হাজার ১ শত জনবলের বিপরীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৩৫৪ জনের অনুমোদন দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয় থেকে হাসপাতালটির সর্বশেষ অবস্থা জানতে চেয়ে এক দাপ্তরিক চিঠি দেয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই পত্রের জবাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে নগরীর ছোট বয়রা এলাকায় ‘খুলনা হাসপাতাল’ নামে যাত্রা শুরু হয়েছিল খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। প্রথমে মাত্র ৭৫ বেড নিয়ে এ হাসপাতালের যাত্রা শুরু। পরে পর্যায়ক্রমে ২৫০ বেডে উন্নীত করা হয়। খুলনা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা লাভের পর এটি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নামে পরিচালিত হচ্ছে।
খুলনাসহ এতদাঞ্চলের মানুষের দাবি ও দীর্ঘ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা থেকে ৫০০ বেডে উন্নীত করা হয়। কিন্তু ৫০০ বেডের জন্য যে জনবল দরকার অদ্যাবধি তা নিয়োগ দেয়া হয়নি। পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ, সিসিইউ, বার্ন ইউনিটসহ রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সঙ্কট রয়েছে এ হাসপাতালে। এখানে ৫০০ বেডের রোগীদের জন্য খাবার, বিছানাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা থাকলেও ৫০০ শয্যার অতিরিক্ত ভর্তি রোগীরা বেড পায় না। বারান্দার মেঝেতে বিছানা নিয়ে তাদের চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। শয্যা সংখ্যার অতিরিক্ত ভর্তি রোগীদের হাসপাতাল থেকে (পথ্য) খাবার দেয়া সম্ভব হয় না। তবে সংরক্ষণে থাকলে যতসামান্য ওষুধ তাদের দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, ৫০০ শয্যার খুমেক হাসপাতালে রোগীদের সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ১ হাজার ৬৫০ জন জনবল প্রয়োজন। কিন্তু হাসপাতালে আছে ২৫০ শয্যার ৬ শয়ের মত জনবল। এখানে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ও চিকিৎসক প্রয়োজন ৭১৩ জন। দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা প্রয়োজন ২৫৬ জন। তৃতীয় শ্রেণীর ১৭৮ জন প্রয়োজন। চতুর্থ শ্রেণীর ৫০৩ জন কর্মচারী প্রযোজন হলেও অর্ধেকও নেই।
৫০০ শয্যা বিশিষ্ট খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটির ২৫০ শয্যা রাজস্ব খাতের অধীন এবং বাকি ২৫০ শয্যা উন্নয়ন খাতের আওতায় রয়েছে। কিন্তু উন্নয়ন খাত থেকে ২৫০ শয্যার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে রাজস্ব খাতের অর্থ দিয়ে উন্নয়ন খাতের ২৫০ শয্যার খরচও চালাতে হচ্ছে। এ জন্য হাসপাতালে অর্থ সংকটও প্রকট হয়েছে। এতে হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। চিকিৎসাধীন গরিব রোগীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। অনেক রোগীর চাপ সামলাতে গিয়ে অপর্যাপ্ত চিকৎসক-সেবিকাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তথাপিও বিভিন্ন সময়ে রোগীর স্বজনেরা উত্তেজিত হয়ে সেবাদানকারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন, কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও হচ্ছেন ।
খুমেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (সুপার) ডাঃ আনন্দ মোহন সাহা বলেন, একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেসব সুবিধা থাকা প্রয়োজন, তা এই হাসপাতালে নেই। হাসপাতালটি জনবলসংকটে আছে দীর্ঘদিন। স্বল্প জনবল দিয়ে অধিক মানুষকে সেবা দিতে হচ্ছে। হাসপাতালে অর্থসংকটও রয়েছে। ৫০০ শয্যার জনবল পাওয়ার জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার আবেদন করা হলেও এখন পর্যন্ত কোন সুরাহা হয়নি। তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া গেলে এই সঙ্কট কেটে যাবে এবং হাসপাতালটি এ অঞ্চলের মানুষের চাহিদামত চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে পারবে।
এ ব্যাপারে খুলনা মেডিকেল এসোসিয়েশনের সভাপতি ডাঃ শেখ বাহারুল আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমলাতান্ত্রিকতার কবলে পড়ে গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। চাহিদামত চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে চাহিদা মতো চিকিৎসক দেয়া হচ্ছে না। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা রয়েছে। অপারেশন থিয়েটারের সঙ্কট রয়েছে। রযেছে ওষুধ সঙ্কট।
তিনি বলেন, হাসপাতালে তিন শিফটে চিকিৎসা দেয়া হয়। সকালের শিপ্টে যদিও কিছু চিকিৎসক, নার্স থাকে। কিন্তু বৈকালিক ও রাত্রের শিপ্টে তেমন ডাক্তার বা নার্স থাকে না। ওই সময়ে গুটি কয়েক চিকিৎসক ও নার্সকে একদিকে যেমন জরুরি বিভাগ সামাল দিতে হয় অন্যদিকে ভর্তিকৃত রোগীদেরদের চিকিৎসা দিতে হয়। এতে করে চিকিৎসকরা সঠিকভাকে চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন না। যে কারণে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে। যার দায় পড়ে চিকিৎসকদের উপর।
বহুমাত্রিক.কম