Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৪ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

দলীয় পদ হারালে মেয়র পদ কী থাকবে?

সৈয়দ মোকছেদুল আলম

প্রকাশিত: ২৩:৫১, ২৪ অক্টোবর ২০২১

প্রিন্ট:

দলীয় পদ হারালে মেয়র পদ কী থাকবে?

দলীয় পদ হারালে জাহাঙ্গীর আলমের মেয়র পদটি থাকবে কিনা-তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে এক ভাইরাল হওয়া ভিডিও-তে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর বিতর্কিত বক্তব্য তাকে করুণ বিউগলের সুরে বিদায় বার্তা জানান দিচ্ছে। বার্তাটি অবশ্য অনেকটাই ‘মিডিয়া মোঘল’ বা ’মিডিয়া সম্রাট’ বনে যাওয়া জাহাঙ্গীর আলমের জাল ফসকে কিছু গণমাধ্যম-ই প্রকাশ করলো।

মুখের সেলাই ছিঁড়ে ফেলতে কিছুটা বিলম্ব হলেও থলের বিড়ালটা ঠিক সময়েই বের করে আনলো। নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়ে দিলো- গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন থাকার আর কোন আশা নেই মোঃ জাহাঙ্গীর আলমের। কারণ তার দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও স্বার্থ পরিপন্থি কর্মকা-ের শোকজ নোটিশের জবাবে সন্তুষ্ট নন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।

গত শুক্রবার দলের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত সবার কাছে জাহাঙ্গীর আলমের ব্যাপারে মতামত জানতে চান। এ সময় বৈঠকে উপস্থিত অধিকাংশ নেতা জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তি প্রদানের পরামর্শ দেন। তখন শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে জাহাঙ্গীর আলমের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক ২৩ অক্টোবর ২০২১)।

আপডেট খবর হচ্ছে, আগামী ১৯ নভেম্বর হতে পারে এ বিষয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। সুবিধাভোগী সমর্থক-অনুসারীরা এরপরও আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় আছেন শেষ রক্ষা হয় কিনাÑ তাদের পৃষ্ঠপোষক জাহাঙ্গীর আলমের। এ প্রসঙ্গে কিছু বললে প্রথমে অবশ্যই গণমাধ্যমের নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিবেকের আদালতে হেঁটমাথা-নিজেকেও দেখতে পাই সেই আসামির কাঠগড়ায়। কেননা বহু আগেই

জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের মত অনেক ঘটনাই ঘটেছে; যা প্রকাশিত না হয়ে ধামাচাপা পড়েছে। অঢেল টাকা আর ক্ষমতার দাপট -এর নেপথ্য কারণ। ক্ষমতাসীন এক শীর্ষ নেতার অন্ধ আনুকুল্য ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দিন দিন দিল্লীর সম্রাট জাহাঙ্গীর থেকেও ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। সবার মাথায় চড়ে বসেন। সিনিয়র নেতাদেরও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য জ্ঞানে অবজ্ঞা দেখাতে শুরু করেন। একে একে নানা অন্যায়, জুলুম আর সীমালঙ্ঘনের পাপে হাবুডুবু খেতে থাকেন। আর সীমালঙ্ঘনের সেই তথ্য-প্রমাণ ভাইরাল ভিডিও আকারে পৌঁছে যায় ক্ষমতার একেবারে পাহাড় চূঁড়ায়।

প্রথমত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম সভাতেই প্যানেল মেয়র নির্বাচিত করার বিধান লঙঘন করা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন জনাব জাহাঙ্গীর আলম। ্িদ্বতীয়ত, করোনা মহামারির শুরুতে রাষ্ট্রীয় আইন ও বিধি-বিধান না মেনে চীন থেকে ১ লাখ কিট আনেন। অথচ গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এতো দ্রুত তা কাজে পরিণত করতে পারে নাই আইন ও বিধি-বিধান মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকায়। ফলে মারাত্মক একটা ভুল বার্তা পেলেন সবাই। জানলেন, রাষ্ট্র যেখানে ব্যর্থ, জাহাঙ্গীর আলম সেখানে সফল। আর এত

বড় একটা অনিয়ম নিয়ে যখন তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি তখন জাহাঙ্গীর আলমের ‘সাত খুনও মাফ’। তৃতীয়ত স্ব-উদ্যোগে তিনি ৩০০ জনকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক সহকারী হিসেবে নিয়োগ দান করেন (সূত্র: দৈনিক সমকাল, ২২ অক্টোবর ২০২১ সংখ্যায় গাসিক মেয়রের পক্ষে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন)। অথচ গাসিক অর্গানোগ্রামে এরকম কোন পদ-পদবীর স্থান আছে বলে জানা নেই আমাদের। এভাবে তিনি তথাকথিত ট্রাফিক সহকারীদের হাতে সিটির যানজট নিরসনের গুরু দায়িত্ব তোলে দেন এবং ট্রাফিক পুলিশের পেশাদারী কর্তৃত্বের আওতা খর্ব করেন। আর যথারীতি তিনি সিটি এলাকার সড়ক-মহাসড়কগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রায় পুরোটাই কব্জা করে ফেলেন। এরপর যানজট নিরসনের দোহাই দিয়ে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য সিটিজুড়ে চক্রাকার বাস সার্ভিস ‘তাকওয়া পরিবহণ” এর^ ব্যবসা চালু করেন। প্রশিক্ষিত ট্রাফিক পুলিশের বদলে তথাকথিত ট্রাফিক সহকারী হিসেবে ওই মেয়র বাহিনী গোটা মহানগরীর সড়ক-শৃঙখলার বারোটা বাজান। কোন জবাবদিহিতা না থাকায় মেয়র জাহাঙ্গীর বাহিনীর নানা অনাচারের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার সাহস পাননি কোন নগরবাসী।

মোটাদাগের বিচার-বিশ্লেষণেই ধারণা পাওয়া যায়, গাজীপুর সিটিকে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম একটি ভিন্ন রাজ্য বা মুল্লুকে পরিণত করতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালান। যে মগের মুল্লুকে তিনি হবেন একচ্ছত্র অধিপতি। যেখানে তার হুকুমের দাস ছাড়া বাকীরা থাকবেন অত্যাচারিত ও সুবিধা-বঞ্চিত হরিজন নাগরিকসম।
সেই জ্ঞানে তার রাজ্যে ‘তথ্য অধিকার আইন’ -এ তথ্য চাওয়ার পথ পুরোপুরি বন্ধ করে রেখেছেন তিনি। সিটি করপোরেশনের রিসিভ শাখায় এরকম আবেদন কোনভাবেই গ্রহণ করেন না মেয়র অধীনস্ত কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ বিষয়েও কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর পেছনের কারণ ও তথ্য সূত্রগুলো বলছে, মেয়র জাহাঙ্গীর আমলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে কি পরিমাণ বিজ্ঞাপন ও টেন্ডার দুর্নীতি হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা মুস্কিল। কারণ তথ্য পাওয়ার পথ অবরুদ্ধ। তবে গাসিক প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনকে হত্যা এবং মেয়রের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশিত হলেই লক্ষ লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপন প্রদানের নজিরগুলো বলছে, ‘দুর্নীতি আছে সীমাহীন’। যা প্রকশিত হলেই ‘বিপদ’।

নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম একটি প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ৩০ শতাংশ কিনে নিয়েছেন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আলাপচারিতায় জাহাঙ্গীর আলম নিজেই তা প্রকাশ করেছেন গণমাধ্যম কর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের কাছ্।ে এরপরও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে কিছু অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা গেছে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে।

যেমন: প্রতিদিন ৩ হাজার টন বর্জ্য অপসারণ কাজে কর পরিশোধের পাশাপাশি নগরবাসীকে আলাদাভাবে অর্থ ব্যয় করতে হয়। প্রত্যেক বাসাবাড়ি থেকে ভ্যান গাড়িতে ময়লা নিয়ে আসার জন্য এই অতিরিক্ত অর্থ মাশুল গুনতে হয় নগরবাসীকে। কিছুদিন আগে একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলেও ওই নৈরাজ্যকর অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। এছাড়াও কোনরকম ক্ষতিপূরণ না দিয়ে এবং অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া ছাড়াই মানুষের জমিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সড়ক প্রশস্ত করার কাজ করিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে হাস্যকর তথ্য দিয়ে নিজের উন্নয়ন কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরেন মেযর জাহাঙ্গীর আলম্। দাবি করেন, সাড়ে ৮শ’ কি: মি: সড়ক প্রশস্ত করার কাজ সম্পন্ন করেছেন তিনি। বর্গ কি: মি: করলে যার পরিমাণ হয় ২১২ দশমিক ৫ বর্গ কি: মি:। গুগল ম্যাপ এর তথ্য বলছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মোট আয়তন ৩২৯.৯০ বা প্রায় ৩৩০ বর্গ কি: মি:। এর মধ্যে জাহাঙ্গীর আলমের প্রশস্তকরণকৃত সড়ক ২১২ দশমিক ৫ বর্গ কি: মি:। যা সিটির মোট আয়তনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ্। বাকী মাত্র ১১৭ দশমিক ৫ বর্গ কি: মি: জায়গায় সিটির সকল বাড়ি-ঘর, কৃষি জমি, বন-জঙ্গল, মিল-কারখানা, নদীনালা, খালবিল, ডোবা, পুকুর, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলৈার ঠাঁই হবে কিনা জানা নেই।
উন্নয়নের মজার হিসাপত্র অধ্যায় গেল। এবার বলি পতন যাত্রার সূত্রপাত হলো কী অধপাত দিয়ে। সর্বশেষ মেযর জাহাঙ্গীর আলম নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য গত ৮ আগষ্ট গাজীপুর প্রেসক্লাব দখলের মত বেআইনি কাজের নেতৃত্ব দেন। এবং গঠনতান্ত্রিকভাবে একটি নির্বাচিত কমিটির বিরুদ্ধে আরেকটি কমিটি ঘোষণা করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ পন্থার কমিটি দিয়ে তিনি অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। এ অপকর্মের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বরাবর বিচার চেয়ে স্মারকলিপি দেন সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ।

কাজেই বলা যায়, এসব কারণে দলীয় বা মেয়র পদ হারাতে হলে আগেই তা হতে পারতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীর আলমের বিতর্কিত কথোপকথনের টানা ১১ মিঃ ১৪ সেঃ ও সম্পাদনা ছাড়া ৫০ মিনিটের বেশি সময়ের আনকাট অডিও-ভিডিও পাল্টে দিয়েছে দৃশ্যপট। এই অবস্থায় গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ হারালে জাহাঙ্গীর আলম তাঁর পিঠ বাঁচাতে মেয়র পদ আকড়ে ধরে টিকে থাকতে চাইবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে তাঁর স্বঘোষিত শত শত বিঘা সম্পত্তি সহ সকল অপকর্ম ও অনিযম-দুর্নীতির হিসাব বড়ো বাধা ও ভোগান্তির বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন হত্যা মামলার জমদূতও পিছু তাড়া করা ছাড়বে না। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সনদ নিয়ে বিতর্ক ও প্রমাণগুলো তো আছে অনেকের-ই হাতে হাতে।

কাজেই আইনের শাসন দেশে আছে কি নাইÑ তা প্রমাণ করতে হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারকেই। আর তা করতে হলে জাহাঙ্গীর আলমের মেয়র পদে টিকে থাকার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও দেখি না। উপসংহার বলে, জীবন এমনই এক তল না পাওয়া অতল কাহিনির বিচিত্র সাগর।

পাদটীকা: বিতর্কিত পরীক্ষা সনদ নিয়ে নানা তথ্য-প্রমাণ থেকে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছে যে, জাহাঙ্গীর আলমের নামের সাথে এ্যাডভোকেট যুক্ত করা সঙ্গত হবে না। এছাড়াও মোঃ নিয়েও তালগোল বাধে- গাসিক ওয়েব সাইটে তাঁর নামের সাথে “মোহাম্মাদ” যুক্ত থাকায়।

-লেখক: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক মুক্ত সংবাদ

 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer