Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

গ্রেস কটেজে নজরুল

মদন সরকার

প্রকাশিত: ১১:৩১, ২৬ মে ২০২৩

আপডেট: ১১:৩৪, ২৬ মে ২০২৩

প্রিন্ট:

গ্রেস কটেজে নজরুল

-এই সেই ঐতিহাসিক ছবি যা গ্রেস কটেজের সামনে তোলা হয়েছিল। ছবিতে প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র বুলবুলকে কোলে নিয়ে নজরুল, উপবিষ্ট (ডানে) কবিপত্নী প্রমীলা নজরুল ও (বামে) শাশুড়ী গিরিবালা দেবী এবং পাশে দণ্ডায়মান বুলবুলের সেবিকা। ছবি: নজরুল ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ‘নজরুল অ্য

সময়টা ছিল ১৯২৫ সালের শেষের দিক। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অন্যতম প্রধান সহকারী কৃষ্ণনগরের হেমন্ত কুমার সরকার হুগলি থেকে কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারকে কৃষ্ণনগর গোয়াড়ির এক অত্যন্ত ঘি‌ঞ্জি এলাকায় এক হোমিওপ্যাথিক ডাঃ জ্ঞানচন্দ্র সরকারের এক বাড়িতে বসবাসের জন্য নিয়ে আসেন।

প্রতিবেশীদের প্রায় সকলে রক্ষণশীল হিন্দু হলেও তাদের পরিবারের লোকজন কবির গান শুনবার জন্য এই বাড়িতে আসতেন। স্বাভাবিকভাবেই এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে কবি ও তাঁর পরিবারের অবস্থান ছিল। অবশেষে চাঁদ সড়ক এর এক বাড়িতে কবির পরিবার চলে আসেন। বাড়িটি ছিল পাঁচ বিঘে জমির উপর। বসবাসের ঘরের সামান্য দূ‌রে চার পাঁচটা বোম্বাই আমের গাছ সহ আরো কয়েকটি আমের গাছ ছিল। বাড়িটির দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রায় ৫০ গজ গেলে কৃষ্ণনগর

রেলস্টেশনে যাওয়ার বড় রাস্তা। বাড়ি থেকে প্রায় ৩০ গজ দূরে পশ্চিম দিকে চাঁদ সড়কের পাড়ায় যাওয়ার রাস্তা। রাস্তার পশ্চিম দিকে ছোট আমবাগান যার নাম মোড়ল বাগান। পূর্ব দিক ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা। উত্তরপ্রান্তে একটি ছোট আম বাগানের পরে "অমন-কাঁথলিপাড়া"।  

পশ্চিমদিকে কৃষ্ণনগরের বৃহত্তম মুসলমান পাড়া । তারও পশ্চিমে গোয়ালপাড়া। বসবাসের জন্য দুটি বড় শোবার ঘর, চওড়া বারান্দা সামনে ও পেছনে। তা ছাড়া আছে একটা ছোট্ট ঘর, রান্নাঘর, তার সাথে ভাঁড়ার ঘর। উঠানের একপাশে একটা বড় ইঁদারা।

বাড়িটার অবস্থান শহরের মধ্যে অথচ দূরে সেজন্য শহরের কোলাহল এখানে ছিল না। ইঁদারার পাশে বোম্বাই আম গাছের তলায় বসে ক‌বি বহু কবিতা, গান লিখেছিলেন। বিশেষ করে "দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার" গানটি এখানে বসে লেখা। বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের কৃষ্ণনগর অধিবেশনে এই গানটি উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে হারমোনিয়াম, ক্লারিওনেট ও এক বিরাট ঢাক সহযোগে গাওয়া হয়েছিল। যদিও গানটি গোয়া‌ড়িতে থাকা অবস্থায় লেখা হয়েছে এমন একটি অভিমতও আছে। বাড়িটির নাম "‌গ্রেস ক‌টেজ"।

নজরুলের প্রতিবেশী ছিলেন আকবরউদ্দীন। তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগর পৌরসভার ভাইস- চেয়ারম্যান। কৃষ্ণনগরের উত্তর অংশে জলঙ্গী নদীর ধারে নতুন এলাকা- নাম গোয়া‌ড়ি। আর দক্ষিণে পুরানো শহর মহারাজার বাড়ি। এই এলাকা তখন ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। লোক বসতি খুব কম ছিল। একটা পাড়ার নাম "আনন্দময়ীতলা"। সেই সময়ের কৃষ্ণনগরের লোকেরা নিজেদের প্রগতিশীল দাবি করলেও আসলে তারা ছিলেন রক্ষণশীল।  চাঁদ সড়কের নজরুলের বাড়িতে দু-চারজন মহিলাকেও আসতে দেখা যায়নি। এমনকি পুরুষ মানুষও খুবই কম আসতো। কেবলমাত্র হেমন্ত সরকার, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, তার ভাই মিহির লাল এই ধরনের কয়েকজন আসতেন।

আকবরউদ্দিন বয়সে নজরুলের চেয়ে চার বছরের বড়। নজরুল মেলামেশার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ, বয়সে বড় বা ছোট এসব সাধারণভাবে না মানলেও আকবরউদ্দিনকে তিনি সমীহ করে চলতেন। তাঁর পরিবারের সাথেও কবির সুসম্পর্ক বজায় ছিল।

এই আকবরউদ্দীন এর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তার মা তার আগে মারা যাওয়ার পর বা‌ড়ি ছিল একেবারে শূন্য। এমতাবস্থায় আকবর উদ্দীনের বাবা পুত্রের দ্বিতীয়বার বিবাহ দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নজরুলকে ধরেন। এই নিয়ে চা খেতে খেতে কথা উঠলে দোলেনা অর্থাৎ প্রমিলাদেবী দরজার পাশ থেকে বেরিয়ে এসে হুগলির এক মহিলা 'আকতার'কে বিয়ে করার জন্য অনুরোধ করেন। একই প্রস্তাব প্রথমে শাশুড়ি গিরিবালা দেবী করেছিলেন চা দেওয়ার সময়। এবং গিরিবালা দেবীর কথায়- নজরুল হুগলিতে যে বাড়িতে আগে থাকতেন তার উল্টো দিকের এক বাড়িতে বিয়ের খবর দিয়ে পাকাপাকি ব্যবস্থা করেন। এবং এই বিয়েতে নজরুল ও দো‌লেনা উভয়ে গিয়েছিলেন।

পাঠক জেনে আশ্চর্য হবেন যে নজরুল বিয়ের আসরে শুধু গানই গেয়েছিলেন না। তিনি বিয়েতে নেচেছিলেন। শুধু নাচ জানতেন তা নয়- অতি সুন্দর নৃত্য পরিবেশন করে সকলকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর দো‌লেনা প্রতিদিন সন্ধ্যায় আকতারের বাড়ি যেতেন। ১৯২৮ সালে যখন নজরুল ঢাকায় আড়াই মাস ছিলেন তখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোলেনা এই বাড়িতে কাটাতেন। আবার কখনো কখনো আকবর উদ্দিন গাড়ি ভাড়া করে কোনদিন শান্তিপুরের দিকে, কোনদিন নবদ্বীপের দিকে, আবার কোনদিন বাদকুল্লার দিকে, শহরের বাইরে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে গিয়ে ফাঁকা মাঠে গল্প করতেন।

একদিন সকালে চা খেতে খেতে ঠিক হয় শহর থেকে ৭-৮ মাইল দূরে একটা বিলে শিকার করতে যাওয়া হবে। ফলে দুজন শিকারি বন্ধু ইব্রাহিম ও জয়নাল এলেন। সঙ্গে গাড়িও এল। সবাই মিলে যাওয়ার সময় নজরুল হারমোনিয়ামটা তুলে নিলেন। যাত্রা শুরু করে নজরুল তার বন্ধুকে নিয়ে গাড়ীর ভেতর থেকে বাইরে এসে গাড়ির উপরে বসে গান ধরলেন। অবস্থাটা ভাবুন- গাড়ির উপরে দেশ বিখ্যাত নজরুল গান গাইছেন তার সঙ্গে কৃষ্ণনগর পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান  বসে আছেন। দর্শক শ্রোতার অভাব নেই। মাঝে মাঝেই রাস্তায় থাম‌তে হলো।

বিলে পৌঁছে একটা নৌকা ও দুটো ডোঙ্গা নিয়ে যাত্রা শুরু হ'ল। পাখী বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না। তারপর খাওয়া দাওয়া হ'ল। তারপর নৌকা ভ্রমণ। তারপর হঠাৎ করে কবি ধীর, স্থির, ধ‌্যানগম্ভীর। এই অবস্থা বাড়ি আসা পর্যন্ত চলল। আর কোন কথা নেই।

আকবরউদ্দিন বলেছেন  বাড়ির বারান্দায় অথবা ইঁদারার ধারে আমগাছ তলায় বসে হয়তো দুজনে আলাপ করছেন,চা খাচ্ছেন হঠাৎ দেখা গেল কয়েক মিনিট তিনি নীরব। চোখ দুটি শুন্য। কাছে একটা মানুষ বসে আছে তাও যেন তিনি জানেন না। কিছুক্ষণ পরে উঠে ঘরের ভেতর‌ে চলে গেলেন। আধ ঘন্টা, এক ঘন্টা দেখা নেই। বুঝতে পারছেন নতুন কিছু রচনা করছেন। ফিরে যখন এলেন তখন হাতে একটা কলম ও কাগজ। কবিতা হলে পড়ে শোনাতেন। সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করতেন। গান হলে গুনগুন করে সুর দিতেন। খানিক পরে হারমোনিয়াম এনে হয়তো গাইতেন।

একদিন এক ঘটনার কথা আকবরউদ্দিন বলেছেন- তা এইরকম। নজরুলের কথা মতো তাঁরা স্টেশনের  রাস্তা দি‌য়ে যাচ্ছিলেন। সড়কের অপরপ্রান্তে বউবাজার। নজরুল বলতেন "না ছিল বউ, না ছিল বাজার"। পাঁচ ছটা দোকান ছিল। এই দোকানের কাছে ছিল এক অনেক পুরানো অশ্বত্থ গাছ। শান্তিপুরের দিকে যাওয়ার রাস্তার মোড় পর্যন্ত যেতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সেখান থেকে ফি‌রে বউবাজারের কাছে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পাশের দিকে তাকিয়ে জোরে হেঁসে বললেন।

"আরে এখানে উট এলো কোথা থেকে"? আসলে একটা লোক অসুস্থ হয়ে দুই হাত আর দুই পা ধনুকের মতো ক‌রে বেঁকে চলছে। লোকটি নজরুলের হাঁসি শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে বলে- "হাসছো? তোমারও তো একদিন এরকম হতে পারে?" নজরুলের তখন হাঁসি উবে গেছে। হঠাৎ তার সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বললেন "আমি অপরাধী আমাকে মাফ করো"। লোকটি বলে "ভগবান তোমাকে ক্ষমা করুন।"

এরপর আর কোন কথা না বলে হন হন করে বাড়িতে পৌঁছে আমতলায় বেতের  চেয়ারে বসে পড়লেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে বিশ্বের ব্যথা-বেদনা জমাট হয়ে আছে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অত্যন্ত ধীরে ধীরে বললেন "আমার হাতের রেখা কি বলে জানেন ? জ্যোতিষীর কথাই ‌ঠিক। আমার সামনে রয়েছে নিবিড় দুঃখ।" তিনি আকবরউদ্দিনকে আরো বলেছিলেন "জানেন আমি তো কোনদিন মানুষকে অপমান করতে চাইনি এতকাল পরে আজ কেন এমন হল?" বলতে বলতে তিনি একেবারে ভেঙে পড়েন। কিছুক্ষণ পর আবার বলেন। কিন্তু "নিয়তি".......... । এই ঘটনা থেকে কবি মনের আরও একটা দিকের পরিচয় পাওয়া যায়।

যতদূর জানা যায় নজরুল হাতের রেখা দেখার অনেক বই পড়াশোনা করেছিলেন। কোথাও কোথাও কোন কোন জ্যোতিষীর সাথে এসব বিষয়ে আলোচনাও করেছিলেন। তিনি যেমন তার ‌নি‌জের হাতের রেখা দেখতেন। আবার অন‌্য কা‌রোর হাতের রেখাও ‌দেখ‌তেন। এমনই কয়েকজন আছেন তার ম‌ধ্যে আকবরউদ্দিন একজন। আসলে তিনি ছিলেন 'একদিকে যেমন বিদ্রোহী, অপরদিকে তিনি ছিলেন নিয়তির হাতের পুতুল।

মানুষের সব শক্তির ঊর্ধ্বে যে একজন মহাশক্তির সত্ত্বা বিদ্যমান যে শক্তিকে অতিক্রম করে যাওয়ার ক্ষমতা মানুষের নাই' এই বিশ্বাস তার গভীর ছিল। তার মনে দ্বন্দ্ব ছিল একটা বিষয়ে সে হচ্ছে মহাশক্তির চরম রূপ যদি মঙ্গলম পরম সুন্দর হয় তাহলে এ পৃথিবীতে এত কুৎসিত, এত অসমতা, এত অসুন্দরের রূপ প্রত‌্যক্ষ করা যায় কেন? নজরুলের বিদ্রোহ ছিল অসুন্দরের বিরুদ্ধে, অসমতার বিরুদ্ধে, কুৎসিতের বিরুদ্ধে।

কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা একটা চিঠিতে নজরুল লিখেছিলেন। "আজ একটি মহিলা বলছিলেন -এবার আপনাকে বড্ড নতুন নতুন দেখাচ্ছে। যেন পাথর হয়ে গেছেন। বেশ ভাবুক ভাবুক দেখাচ্ছে।" আবার ১৯২৭ সালের শেষদিকে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় নজরুলের ওখানে দুদিন ছিলেন তিনি আকবরউদ্দিন কে বলেছিলেন "কাজীর কি হয়েছে বলতে পার brother?" "কেন কি হয়েছে?" উনি বলেছিলেন "য কাজী- সে কাজী তো আর নেই অনেকটা বদলে গিয়েছে মনে হচ্ছে"। অবশেষে বলেন "নজরুলকে কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে"।

সংসারের অভাব অনটন ছিল নজরুলের চিরসাথী। ডি এম লাইব্রেরী সহ অন্যান্য পাবলিসাররা যদি নিয়মিতভাবে টাকা পাঠাতো তাহলে কি হতো বলা যায় না। একমাত্র গিরিবালাদেবী না থাকলে এ সংসার অনেক আগেই ভেঙে যেত। দোলেনা সংসারের বিষয় কিছু তেমন বুঝতেন না। তাই গিরিবালা দেবী কবিকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছিলেন। তারপ‌রে যখন ঢাকার মিস ফজিলাতুন্নেসার খবর গি‌রিবালার কাছে এসে পৌঁছায় তখন গিরিবালাদেবী কলকাতায় নজরুলকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্তভাবে মনস্থির করে ফেলেন।

এই প্রসঙ্গে এক  অতীব সুন্দর অথচ বেদনাময় ঘটনার কথা উল্লেখ করে এবা‌রের সংখ্যা সমাপ্ত হবে। ঘটনা‌টি হ‌লো আকবরউদ্দিনের স্ত্রীর নাম সৈয়দা আক্তারুন্নেসা বেগম। এবং তার ডাকনাম ছিল 'সেতারা'। সেতারা- আকবরউদ্দীন এর বিয়ের এক মাস পর সালটা ছিল ১৯২৮ সালের জুলাই বা আগস্ট মাসের কোন একটা সময়। সন্ধ্যের পর বাড়ি ফি‌রে আকবরউদ্দীন দে‌খেন তার স্ত্রী সেতারা এক মহিলার সাথে আলাপ করছেন। মহিলার বয়স ২৫-২৬ হবে। সেই দিনই তিনি বিকাল পাঁচটার ট্রেনে কৃষ্ণনগরে পৌঁছে আকবরউদ্দিনের বাড়ি এসেছেন।

ইতিমধ্যে কৃষ্ণনগরে তার আসার কারণ সেতারা কে বলেছেন- যার কথা তিনি পূর্বে একাধিকবার নজরুলের কাছে শু‌নেছেন। ইনিই ফজিলাতুন্নেছা । সেতারা নজরুলকে "দাদা ভাই" বলে ডাকতেন। সেতারা তার স্বামীকে পাশের ঘরে নিয়ে গি‌য়ে সব বলেন এবং নজরুলের সাথে একবার দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আকবরউদ্দিন মহিলাকে বলেন "দেখুন আপনার কথা আমি নজরুল এর কাছে শুনেছি। ডে‌কে আমি আনতে পারি কিন্তু তাতে লাভ কি?" আসলে ফজিলাতুন্নেসা তখন বিবাহিতা। কিন্তু নজরুলের প্রতি প্রবল আকর্ষণের জন্যই স্বামীর বাড়িতে যান না।

তিনি বললেন "কোন রকম‌ে একবার দেখা করিয়ে দিন। কসম করে বলছি আর কখনো তার সঙ্গে দেখা করতে চাইবো না। তাকে একথা বলতে পারেন।" অবশেষে আকবরউদ্দীন একান্ত বাধ্য হয়ে নজরুলের কা‌ছে গিয়ে সব বলেন। নজরুলের সেই একই উত্তর "দেখা করে লাভ কি"? অবশেষে বলেন "বেশ চলুন। এসেছে যখন দেখা দিয়ে আসি"।  

ঘরে ঢুকে নজরুলের কথায় সেতারা চা আনতে গেলেন এবং কাজী কে একটু মিষ্টিও দিও বলে তিনিও বেরিয়ে যান। যাওয়ার সময় দেখ‌লেন সেই মহিলা নজরুলের পায়ের ধুলো নিলেন। ১০ মি‌নিট পর নজরুল হাঁক দিলেন। "কইরে এক পেয়ালা চা করতে এত দেরি হ‌লে সংসার করবি কি করে"? অবশেষে চা মিষ্টি নিয়ে স্বামী-স্ত্রী ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন ঘরের একপাশে ভদ্রমহিলা বসে আছেন। চো‌খে সারা আকাশের মেঘ পু্ঞ্জিভুত হয়ে আছে। নজরুলের মুখের হাঁসির পেছনে বেদনার ছায়া"।
নজরুল চলে গেলে মেয়েটির "অঝোর- নিঃশব্দ কান্না"। সেই দিনই রাত তিনটের ট্রেনে উঠবার আগে মহিলা বললেন "ভাই সাহেব, আজ আমার যে উপকার করলেন যতদিন বাঁচি ভুলতে পারবো না"।

১৯২৫ সালের শেষের দিকে কৃষ্ণনগরের গোয়াড়ি থে‌কে চাঁদ সড়কের ‘গ্রেস কটেজে’ সপরিবারে প্রবেশ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে তার অমর সৃষ্টি ”মৃত্যু-ক্ষুধা”, 'গজল সংগীত' ও 'কান্ডারী হুঁশিয়ার' প্রভৃতি সহ প্রিয় পুত্র বুলবুলের স্মৃতিকে বুকে নিয়ে কলকাতা থেকে আগত নলিনী রঞ্জন সরকার, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ও আরো কয়েকজনকে সঙ্গে ক‌রে ‘গ্রেস কটেজ’ ছাড়লেন বিদ্রোহী কবি কাজী  নজরুল ইসলাম। প্রশ্ন একটাই- এর কি খুব প্রয়োজন ছিল?  উত্তর দিয়েছিলেন, মাসিমা গিরিবালা দেবী, “ ভালোই ছিলাম বাবা। তবে এখানে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে।”  বলেছিলেন কবি পরিবারের সত্যিকারের সুহৃদ আকবরউদ্দীনকে । এর উত্তর ছিল না আকবরউদ্দিনের কাছে। তবে তার মনে হয়েছিল 'মানুষটা যে সত্যি সত্যি মরতে চলেছে' !

সেটা ছিল ১৯২৮ সালের শেষ অথবা ১৯২৯ সালের গোড়ার দিক। কবি পরিবারের ’গ্রেস কটেজ’ ত্যাগ করার পর গ্রেস কটেজও তার সমস্ত আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। বাস্তবে তা ছিল একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। ইতিমধ্যে কেটে গেছে প্রায় ৮০-৮৫ বছর। ‌সে‌দিনটা ছিল ২০১০ সালের ২৯ আগস্ট। একদল কবিপ্রেমী গড়ে তুলেছেন কৃষ্ণনগরে ’সুজন বাসর’ নামে এক সাংস্কৃতিক সংস্থা। তাঁরাই আবিষ্কার করেছেন বিদ্যুৎ দপ্তরের পরিত্যক্ত একটি বাড়ি। যার অতীতে নাম ছিল ’গ্রেস কটেজ’ । সুজন বাসরের সম্পাদক ইনাসউদ্দিন । আজ তারা সেইদিন সকালে দলবল নিয়ে হাজির নজরুল স্মৃতিধন্য ’গ্রেস কটেজ’ র সামনে। ঘরের সামনের ভাগ ঝোপ জঙ্গলে ঢাকা ।  

সুজন বাসরের প্রাণপুরুষ ইনাসউদ্দিনএর ভাষায়,   ”দরজায় ঠেলা দিয়ে খুলতেই একটা চওড়া বারান্দা। দুপাশে দুটো বড় বড় ঘর। চারপাশে লোহা-লক্কর। পুরনো মিটার বক্স আর বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের জঙ্গল। বাঁ দিকের ঘরটায় পা দেওয়ার পরিস্থিতি নেই। ডান দিকের ঘরটা কিছুটা ফাঁকা। মেঝে অনেকটা পরিষ্কার । একপাশে একটা তোলা-উনুন। কখনো হয়তো মিস্ত্রি- শ্রমিকদের রান্নার কাজে ব্যবহার হয়েছে। দুদিকের দেওয়ালে কাজী নজরুলের দুটি মাঝারি সাইজের ছবি ঝুলছে। বিবর্ণ মলিন সাধারন ফ্রেমের ছবিতে গাঁদা ফুলের শুকনো মালাও ঝুলছে। মনে হল কয়েক বছরের পুরনো।

অন্য একটি দেওয়ালে উঁচুতে তক্তায় তোলা গাদাগু‌চ্ছের পু‌রো‌নো ফাইল ও খাতাপত্র। উত্তরের দেওয়ালে আরও দুটো ছোট ছোট ঘর। জানালা দরজাও ভাঙ্গা ভাঙ্গা। মোটা লোহার রডগুলো লতাপাতার জঙ্গল। লোহার বিমের উপর লোহার পাতের বর্গাগুলি বিপদজ্জনক ভাবে ঝুলে আছে। বোঝাই যায় স্থানে স্থানে জল পড়ে। বাইরেই দেখেছি ছাদের উপর বড়সড় একটা পাকুড়গাছ। ছাদ ফুটো করে শিকড়ের জাল বিছিয়েছে বিস্তর।

বাঁদিকের ঘরে পেছনের দিকে একটা বড় দরজা । সম্ভবত উঠানে, বাগানে যাওয়ার রাস্তা। পরিত্যক্ত  পোড়োবাড়ির মতো সেসব অংশে ‌ইতস্ততঃ মদের বোতল, ডেনড্রাইট এর খালি টিউব ছড়িয়ে আছে। বোঝা যায় রাতে বা ছুটির দিনগুলিতে নেশাখোরদের মাদক সেবনের নিরাপদ আস্তানা। এই হ‌লো গ্রেস ক‌টেজের অভ‌্যন্তর। বাইরে ঢোকার মুখে দু'পাশের জঙ্গলেও এরকম বোতল ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। প্রবেশ দরজার মাথায় ছাদের উপরে তিনকোণা একটা নকশা। খসে যাওয়া প্লাস্টার এর মধ্যে অক্ষত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে । রাজমিস্ত্রির অপটু হাতের লেখা। '1923-4'  গ্রেস কটেজ কথাটা লেখা নেই। হয়তো ছিল ঘসে গেছে।

সুজন বাসরের ইনাসউদ্দিন সহ সুপ্রতিম কর্মকার, দীপাঞ্জন দে ও  আরো দু-একজনের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ঘটেছিল। আমাদের উদ্যোগে বিদ্রোহী কবির পুর্ণাবয়ব মূর্তি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে, দীপাঞ্জন দে ম‌ঞ্চে উপ‌স্থিত ছি‌লেন এবং দমদমে সরোজিনী নাইডু উইমেন্স কলেজে কবির আত্মীয়া  সোনালী কাজী ও আমাদের ক‌য়েকজ‌নের উদ্যোগে এক সেমিনারে রাজ্যের অতি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে ইনাসউদ্দিন এর সাথে পরিচয় হয়েছে।

এছাড়া সুপ্রতিম কর্মকারের সাথে মোবাইলেও কৃষ্ণনগর স্টেশনে আমার কথা হয়েছে। আমরা ‘গ্রেস কটেজে’ একটি অনুষ্ঠান করতে চাইলে তাদের আগ্রহ আমাকে উজ্জীবিত করেছে। শেষ পর্যন্ত গ্রেস কটেজের বদলে দমদমে সেই অনুষ্ঠান হয়। এই  ’গ্রেস কটেজ’ র একটি অনুষ্ঠানে আমি নিজে উপ‌স্থিত ছিলাম। তখনই ’সুজন বাসর’  সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়।

এই সুজন বাসরের উদ্যোগে ২০১০ সালের ২৬ শে মে ’গ্রেস কটেজ’ এ  সকাল দশটা নাগাদ “দূর্গম গিরি কান্তার মরূ” গানটি সহযোগে কবিস্মরণ অনুষ্ঠান হয়। এর পরের ঘটনা ঐতিহাসিক। ২০১১ সালের ২৯ শে আগস্ট সোমবার বৈকাল তিনটের সময় ৮২ বছর পর নব চেহারায় ’গ্রেস কটেজ’ কে ফিরিয়ে এনে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিতে কেটে  উদ্বোধন করেন ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার দেবাশীষ ঘোষ। প্রায় ৬০ জনের উপস্থিতিতে কবিতা, গান ও বক্তৃতার ভেতর দিয়ে স্মরণ করা হলো কবিকে।

এই সুজন বাসরের অনুসন্ধান পর্ব হ‌তে জানা যায়, কাজী নজরুল ইসলাম সপরিবারে কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন ১৯২৬ সালের ৩রা জানুয়ারি।  প্রথমে তারা ছিলেন গোয়াড়ির গোলাপট্টিতে। পরে আড়াই বছর ’গ্রেস কটেজ’ এ । হুগলিতে থাকাকা‌লিন এক দিকে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অপরদিকে প্রথম পুত্র কৃষ্ণ-মহাম্মদ এর মৃত্যুতে যখন কবির জীবন ভীষণ বিপর্যস্ত, সেই সময় থাকা, খাওয়া, চিকিৎসার প্রায় সব রকম দায়িত্ব নিয়ে সুভাষ চন্দ্রের সহপাঠী হেমন্ত সরকার, চিত্তরঞ্জন দাশের অনুগামী কবিকে কৃষ্ণনগরে নিয়ে আসেন এবং গোয়া‌ড়ির গোলাপট্টির কাছে মদন সরকার লেনে একটি ভাড়া বাড়িতে  কবির  আশ্রয় জোটে। তখন কবির বয়স ২৭ বছর। কৃষ্ণনগরের খ্যাতনামা ডাক্তার জে.এন. দে তাঁকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। সেই সময় গিরিপালা দেবীর নিকট থেকে সাংসারিক প্রয়োজনের ফর্দ্দ নিয়ে সেখানকার ছেলেরা তারক দাসের 'দরিদ্র ভান্ডার' থেকে নজরুলের নামে পয়সা নি‌য়ে  বাজার করে দিত।

তবে ঠিক কোন কোন কারণে  গোয়াড়িতে হেমন্ত সরকারের নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকে, কঠোর কঠিন দারিদ্র্যকে সম্বল করে, শহরের এক প্রান্তে, অশিক্ষিত ও নিম্নশ্রেণীর মানুষের পাড়া চাঁদ সড়কের পাশে ’গ্রেস কটেজ’ এ এসে নজরুল সপরিবারে উঠে এলেন তার নির্ভরযোগ্য তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে যে সকল গুঞ্জন  শোনা যায়, তা হলো লালগোলার বরোদা চরণ মজুমদার কে এনে গোলাপট্টিতে বেশ বড় করে কালীপূজো করেছিলেন । তাতে স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তখন হেমন্ত সরকারের পরামর্শে তাঁর বন্ধু এস এম আকবরউদ্দিন তাকে চাঁদ সড়কে নিয়ে যান।

অপর একটি মত হলো, নজরুল মুসলমান বলে গোয়া‌ড়ির হিন্দু পাড়ায় থাকতে পারেননি । মুসলমান জামাইয়ের সংসারে থেকেও শাশুড়ি গিরিবালা দেবী একাদশী-নিরামিষ সহ হিন্দু বিধবার যাবতীয় আচার মেনে চলতেন। তা নিয়ে পাড়ায় নানা টিটকারি দেওয়া হতো। এই অবস্থা থেকে শাশুড়িকে রক্ষা করতে নজরুল নিজ উদ্যোগে গোয়াড়ি ছেড়ে চাঁদ সড়কে চলে গিয়েছিলেন।

চাঁদসড়ক পল্লীর পূর্বপ্রান্তে কোন এক সম্ভ্রান্ত রুচিশীলা খ্রিস্টান মেমসাহেব অঞ্জনা খালের  ধারে পাঁচ বিঘা খোলা জায়গা আর আমবাগানের মধ্যে এই একতলা বাড়িটি বানান। যার নাম ’গ্রেস কটেজ’। চাঁদ সড়ক  এ ছিল হতদরিদ্র মুসলমান ও খ্রিস্টান পরিবারের পাশাপাশি বাস। বেশিরভাগ লোকজন ছিল রাজমিস্ত্রি ,ছুতার মিস্ত্রি, খানসামা, আরদালি, বাবুর্চি জাতীয়  দেশি-বিদেশি সাহেবদের বাড়িতে কাজ করা মানুষ । ”মৃত্যু-ক্ষুধা” উপন্যাসে কবি এইসব পল্লী ও তার বাসিন্দাদের নিখুঁত বর্ণনা করে গেছেন। এই ’গ্রেস কটেজ’ এ কবি সপরিবারে আসেন ১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।

২০১০ সালের পয়লা বৈশাখ জনৈক তরুন নদী গবেষক সুপ্রতিম কর্মকারের উদ্যোগে ইনাসউদ্দিন এর সরকারি আবাসনে গুটি কয়েক সংস্কৃতি প্রেমী মিলিত হন।  সেখানে গঠন করা হয় “সুজন বাসর” নামে এক সাংস্কৃতিক সংগঠন।  তাদেরই অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সাহসী উদ্যোগে এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে হেরিটেজ কমিশনের ৫৪৯/ড‌ব্লিুউ,বি,এইচ,সি তারিখ ৬/৮/২০১২ গ্রেস কটেজকে হেরিটেজ ভবন হিসা‌বে ঘোষণা করে। যা ২৫/৮/২০১২ তারিখে সংবাদপত্রে এক বিজ্ঞপ্তি মারফত প্রকাশিত হয়।

২০১৭ সালের ২৬শে জুন গ্রেস কটেজের বারান্দায় কবির একটি আবক্ষ মূর্তি বসানো হয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে বলা যেতে পারে ১৯৮০ সালে তদা‌নিন্তন জেলাশাসক দীপক ঘোষের উদ্যোগে পাওয়ার হাউসের প্রবেশপথে শ্বেত প্রস্তরের একটি ফলক বসানো হয়।

এখানে উল্লেখ করার বিষয় নজরুল কলকাতায় চলে যাওয়ার পর  ”বি, এল, এলিয়াস কোম্পানি” নামে এক বিদ্যুৎ কোম্পানি এই ’গ্রেস কটেজ’ সহ সমগ্র এলাকাটি কিনে নেন। সেখানে দীর্ঘদিন পাওয়ার হাউস চলে। পরবর্তীকালে এই পাওয়ার হাউস রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের অধীনে যায়। কিন্তু জমির রেকর্ডে নাকি বি, এল, ইলিয়াস কোম্পানির নাম নথিভুক্ত আছে।

’গ্রেস কটেজ’টি ফি‌রে পাওয়া কৃষ্ণনগর বাসী তথা নজরুল প্রেমী সমস্ত মানুষের কাছে খুবই আনন্দের খবর। এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। তবে কৃষ্ণনগর বাসী তথা সুজন বাসর যে ভূমিকা নিয়েছিলেন বা অদ‌্যাব‌ধি নি‌য়ে  চলেছেন তা নিয়ে আমাদের গর্ব করার অবশ্যই অধিকার আছে। সেজন্যই সংক্ষিপ্ত হলেও ’গ্রেস কটেজ’ এ নজরুল সম্পর্কে আলোচনার কিছুটা হলেও স্পর্শ করে যাওয়া হলো।

ফিরে আসি ’গ্রেস কটেজ’ আলোচনায়। ফজিলাতুন্নেসাকে নজরুলের নানা পত্রালাপ সম্পর্কে কৌতুহলী পাঠকবৃন্দ অবগত আছেন। কিন্তু প্রশ্ন আকবরউদ্দীন বলেছেন ”দোলেনা কে জানতাম। অমন শান্ত, একনিষ্ঠ স্ত্রী থাকতে আর একজনের সাথে মোহান্ধ হওয়ার কারণ আমার মত একজন অতি সাধারণ মানুষের পক্ষে দুর্বোদ্ধ"।

তি‌নি ব‌লে‌ছেন,"ফজিলাতুন্নেছা সম্পর্কিত ঘটনাটি নজরুলের মুখে যা শুনেছি তাতে আমরা কেহই বিষয়টি সঠিক উপলব্ধি করতে পেরেছি বলে মনে হয় না"। সেটা ১৯২৮ সালের ঘটনা। মাসিমা ও দোলেনা কবিকে অনেকগুলো চিঠি লিখেছিলেন। আকবর সাহেবও অনেক চিঠি ও টেলিগ্রাম করেছিলেন। কিন্তু কোনটারই উত্তর আসেনি। দোলেনা আকবরউদ্দীনের স্ত্রীর সাথে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলতেন।

এদিকে সংসার তখন অচল। অবশেষে কবি ফিরে এলেন। তখন তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। জিজ্ঞাসা করলে বললেন "শরীর ভালো যাচ্ছে না"। এরপর একদিন বললেন বললেন "মাসিমা কলকাতায় যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কারণ জানতে চাইলে নজরুল বললেন "এখানে থাকলে সংসার অচল হয়ে যাবে।......... তবে এইটাই একমাত্র কারণ নয়"।

এরপর যা বললেন তার সারমর্ম হল। "ঢাকা থেকে কেউ মাসিমাকে চিঠি লিখেছে। ওরা ব্যাপারটা জেনেছেন। আর মনে করেছেন চিরকালের বাউন্ডুলে আমি যেকোনও দিন পালিয়ে যেতে পারি"। অন্যান্য কিছু কারণের মধ্যে এমনই ছিল ’গ্রেস কটেজ’ ত্যাগ করার অন্যতম প্রধান কারণ। তাই মাসীমার কথায় সায় দেওয়া ছাড়া নজরুলের কোন উপায় ছিল না। তাহলে প্রকৃত ব্যাপারটা কি হতে পারে? এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত আছে।

যাইহোক আকবরউদ্দীন বলেছেন “ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর বাকহারার মনের একটা রুদ্ধদ্বার খুলে গিয়েছিল। পূর্বাপর ‌তিনি খুঁজছিলেন তার মানসী প্রিয়াকে, অথচ সেটা যে  কি, তার রূপ কি, এসব বিষয়ে তাঁর কোন নির্দিষ্ট ধারণা ছিল না। থাকা সম্ভব নয়। কৃষ্ণনগরে কয়েক বছর থাকার ফলে বহু সঙ্গ বঞ্চিত মন ফজিলাতুন্নেসা কে হঠাৎ দে‌খে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে  সেই মানসি প্রিয়ার দেখা পেয়েছে ব‌লে তাঁর  মনে হয়েছিল। তার এই আকর্ষণ ছিল প্রধানত সা‌প্নিক-লালসাগত নয়। আর ফজিলাতুন্নেসার যে দাবি ছিল তা পূরণ করার শক্তি সাপ্নিক নজরুলের ছিল না। এই পরস্পর বিরোধী দুটি মন বা ভাবের মধ্যে মিলন সম্ভব নয়। সুতরাং কে কাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তা বিচার করাও যেমন কঠিন তেমনি তা অসমীচীনও বটে।

এই প্রসঙ্গে আরো একটি ঘটনার কথা পাঠকদের জানিয়ে এবারের মতো প্রসঙ্গ শেষ করবো। আকবরউদ্দীন বলেছেন “ তিন বছর কৃষ্ণনগরে থাকার সময় একবার ঈদের নামাজের দিন নামাজ পড়তে চাঁদসড়ক মসজিদে গিয়েছিলেন। পরনে আরবি জুব্বা-জাব্বা ওয়ালা পোশাক ও আরবি ধরনের পাগড়ী মাথায় বেঁধে তিনি নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। আর কখনো তাকে নামাজ পড়তে দেখিনি। এমনকি পরবর্তী কোন সময় ঈদের জামাতেও শামিল হননি। অথচ কখনো আল্লাহ নাই এ কথা যেমন বলেননি তেমনি কোন ধর্মের বিরুদ্ধেও কথা বলতে দেখিনি"।

’গ্রেস কটেজ’ এ নজরুল প্রসঙ্গে এমন অনেক কথাই বলার আছে। জানার আছে। জানানোর আছে। সুজন বাসরের উদ্যোগে প্রকাশিত গ্রেস কটেজ- এ বিষয়ে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য তারা অবশ্যই এক অসম্ভব কৃতিত্বের দাবিদার। তাদের কাছে ঋণী হিসেবে থাকলাম। (চল‌বে)

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক। 

সুজন পাঠাগার ও নজরুল গবেষণা কেন্দ্র হতে প্রকাশিত গ্রেস কটেজ  এর স্মারক সংকলন হতে গৃহীত

নতুন রূপে ফিরছে নজরুলের কৃষ্ণনগরের সেই বাড়ি (ভিডিও)

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer