Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

আষাঢ় ২৭ ১৪৩২, শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫

ঘুর্ণিঝড় ফণী ও আবহাওয়ার সতর্কবার্তা

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ১২:৩৭, ৪ মে ২০১৯

প্রিন্ট:

ঘুর্ণিঝড় ফণী ও আবহাওয়ার সতর্কবার্তা

সাগর মহাসাগরে আবহাওয়ার বাতাসের গতিবেগ, পানির পরিচলন ইত্যাদি নানা কারণে ঝড় সৃষ্টি হয়ে থাকে। এলাকা, সময় ইত্যাদি বিবেচনায় প্রত্যেকটি ঘূর্ণিঝড়কে আলাদা আলাদা নামাকরণ করা হয়ে থাকে। আবহাওয়া ও জলবায়ুর বিগত অর্ধশতকের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কিছুদিন পরপর একটি বড় ধরনের ঘূুর্ণঝড় বাংলাদেশের উপকুলীয় এলাকায় আঘাত হানে এবং ব্যাপক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। প্রতিবছরই ছোট ছোট একাধিক ঘুর্ণিঝড় আঘাত হানলেও ১৯৭০, ১৯৮৮, ২০০৭ এবং ২০০৯ এসব বর্ষগুলোতে বড় ধরনের ঘুর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল যাতে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। কখনো সিডর কখনো আইলা কখনো নার্গিস আবার এবার আসছে ফণী নাম নিয়ে। সাপের মতো ফেনা তুলে একেবেকে আসছে বলে নাকি এবারের ঘুর্ণিঝড়কে ফণী নামে ডাকা হচ্ছে।

কিন্তু সেসময়ে আবহাওয়ার এসব পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে এত অত্যধুনিক ও ডিজিটাল ব্যবস্থা ছিলনা। ছিলনা রেডিও টেলিভিশনসহ গনমাধ্যমের এত প্রচার-প্রচারণা ছিলনা। সুযোগও ছিলনা। কারণ তখন রাষ্ট্রীয় একটি টেলিভিশন ও রেডিও ছাড়া তাৎক্ষণিক আর প্রচারণার কোন মাধ্যম ছিলনা। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই দেখা যাচ্ছে এসব ঘুর্ণিঝড়ের তীব্রতা বাড়তে থাকে। এর অন্যতম কারণ হলো জলবায় পরিবর্তনের কুফল। কিন্তু আগের তুলনায় এখন ঘুর্ণিঝড়ের তীব্রতা বাড়লেও ক্ষয়ক্ষতি আস্তে আস্তে কমে আসছে। তার একটি বড় কারণ হলো জনগণের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি হওয়া। তাছাড়া সরকার আগের তুলনায় অনেক সক্ষম এবং সতর্ক। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা এখন সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হচ্ছে। কারণ শুধু ঘুর্ণিঝড় নয় যেকোন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে শুধু সরকারই নয় অনেক সাধারণ মানুষও উপদ্রুত সহমর্মীদের কাছে ছুটে আসছেন।

যেমন এবার ফণীর বিষয়ে যা বলা হচ্ছে, সেটি হলো- বিগত ৪৩ বছরের মধ্যে এটি নাকি শক্তি ও আকারে অনেক বড়। অর্থাৎ ফণী বেশ আগে থেকেই গভীর সমুদ্রের অনেক দূরবর্তী স্থানে সৃষ্টি হয়েছে। এটির ব্যাস ৭৪ কিলোমিটার, ভিতরকার বাতাসের গতিবেগ ২০০-২১০ কিলোমিটার যা স্থলভাগের দিকে ধেয়ে আসছে। প্রথমে ভারতের উপকুলীয় এলাকায় আঘাত হেনছে, তারপর তার আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে খুলনা অঞ্চলের দিকে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। এজন্য সারাদেশেই এর প্রভাব বিরাজ করছে। বাংলাদেশ উপকুল অতিক্রম করে তা রাজশাহী ও রংপুরের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ফণীর প্রভাবে শুধু যে বাতাসের দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তাই নয়, এর প্রভাবে ৪-৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস এবং জোয়ারে মাধ্যমে নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

আর এগুলো এখন সহজেই জানা যাচ্ছে ঘুর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা (সিগনালিং) প্রচার করা। তবে ঘুর্ণিঝড়ের এসব সিগনালিং ভাষা সারাদেশের সব সাধারণ মানুষ বুঝে না। কাজেই এগুলো মানুষের বুঝার জন্য আরো বেশি সহজ করে প্রচার করা অতীব জরুরি। এখন আমি ১ থেকে ১১ পর্যন্ত সিগনালগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

১ নং দূরবর্তী সংকেত: জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সম্মুখীন হতে পারে। দুরবর্তী এলাকায় একটি ঝড়ো হাওয়ার অঞ্চল রয়েছে। এ সময়ে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬১ কিমি।

২ নং দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত: দূরে গভীর সাগরে একটি ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বাতাসের একটানা গতিবেগ ৬২ থেকে ৮৮ কিমি। বন্দর এখনই ঝড়ে কবলিত হবে না তবে বিপদ হতে পারে।

৩ নং স্থানীয় সতর্ক সংকেত: বন্দর ও বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলো দুর্যোগ কবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। ঘূর্ণি বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৫০ কিমি হতে পারে।

৪ নং স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত: বন্দর ঘুর্ণিকবলিত। বাতাসের সম্ভাব্য গতিবেগ ঘণ্টায় ৫১ থেকে ৬১ কিঃমিঃ। তবে ঘুর্ণিঝড়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়ার মতো সময় এখনো আসেনি।

৫ নং বিপদ সংকেত: বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের একটানা গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিমি। ঝড়টি বন্দরকে বামদিকে রেখে উপকুল অতিক্রম করতে পারে।

৬ নং বিপদ সংকেত: বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের একটানা গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিমি। ঝড়টি বন্দরকে ডানদিকে রেখে উপকুল অতিক্রম করতে পারে।

৭ নং বিপদ সংকেত: বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের একটানা গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিমি। ঝড়টি বন্দরের ওপরে বা এর নিকট দিয়ে উপকুল অতিক্রম করতে পারে।

৮ নং মহাবিপদ সংকেত: বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতর ঘুর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে পারে। ঝড়ে বাতাসের একটানা গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৮৯কিমি বা এর বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে বামদিকে রেখে উপকুল অতিক্রম করবে।

৯ নং মহাবিপদ সংকেত: বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতর ঘুর্ণিঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের একটানা গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৮৯কিমি বা এর বেশি হতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়টি বন্দরকে ডানদিকে রেখে উপকুল অতিক্রম করবে।

১০ নং মহাবিপদ সংকেত: বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঘুর্ণিঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের একটানা গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮৯কিমি বা এর বেশি হতে পারে।

১১ নং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সংকেত: আবহাওয়ার বিপদ সংকেত প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এবং স্থানীয় আবহাওয়া কর্মকর্তা পরিস্থিতি দুর্যোগপূর্ণ বলে মনে করেন।

এগুলো সিগনালিং বা সংকেতের আবার ইংরেজি ভার্সনও রয়েছে। এগুলো জনগণের মাঝে যতবেশি প্রচার করা যাবে ততবেশি লাভবান হবেন উপদ্রুত মানুষ। কারণ অনেক শিক্ষিত সচেতন মানুষও এসব সিগনালিং প্র্যাকটিস না করলে মনে রাখতে পারবেন না। কাজেই জনস্বার্থের কথা চিন্তা করে তা বেশি বেশি প্রচারের ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম