Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

আষাঢ় ২৭ ১৪৩২, শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫

ইথানল, কোভিড-১৯ ও বাকৃবি’র ভাবমূর্তি

ডঃ শোয়েব সাঈদ, মন্ট্রিয়ল

প্রকাশিত: ১৩:৩৩, ৯ এপ্রিল ২০২০

আপডেট: ১৩:৩৪, ৯ এপ্রিল ২০২০

প্রিন্ট:

ইথানল, কোভিড-১৯ ও বাকৃবি’র ভাবমূর্তি

-লেখক

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ঋণে আজীবন ঋণখেলাপি থাকতে চাই, শোধ করার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনটাই যে নাই। এর গৌরবে বা ম্লানে আমরাও উদ্বেলিত বা কাতর হই। শুধু পাঠদান নয়, গবেষণার গুণগত মানে এটি বাংলাদেশের সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশের কৃষির সেক্টরের অভূতপূর্ব বিপ্লবের সুতিকাগার এটি। প্রচারসর্বস্ব ছেলেমানুষি গবেষণা কার্যক্রমে এর নাম জড়িয়ে যাক, এই পরিণতি আমরা দেখতে চাই না। ৭১ টিভি’র একটি অনুষ্ঠান আর পত্রিকার রিপোর্ট দেখে বৈশ্বিক রিসার্চ সিস্টেম সম্পর্কে অবহিত যারা তাঁদের মনে কিছু প্রশ্ন উঠতেই পারে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে পরিমাণ ওষুধ/প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে, বিপ্লব হয়ে যাবার কথা! তার উপর বাকৃবি’র নাম জড়িয়ে আবার ইথানল থেরাপি, একটু থতমত খেয়েছি বিষয়টি পড়তে আর শুনতে গিয়ে।

নিজের মধ্যে কিছু পয়েন্টে জিজ্ঞাসা সৃষ্টি হয়েছে-
০১. উচ্চ ঘনত্বের ইথানল জীবানুনাশক, এটি জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দরকার নেই। মুরগী থেকে করোনা ভাইরাস নিয়ে ল্যাবে ইথানল দিয়ে মেরে ফেলার কাজটি কি নতুন আবিষ্কার? কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই এটা সবার জানা, ৬০% এর উপরের ঘনত্বের ইথাইল এলকোহল দিয়ে SARS CoV-2 ধ্বংস করা যায়। এই বুদ্ধিতে এখন ৫০% ইথানল দিয়ে কুলি করলে কেমন হয়?

ইথানলে তো ব্যাকটেরিয়াও মারা যায়, তো টনসিল বা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে এই বুদ্ধিটি মেডিক্যাল সায়েন্সের মাথায় এলো না কেন? টনসিলে কোন ডাক্তার কি আপনাদের ৫০% এলকোহলে গারগেল করার পরামর্শ দিয়েছিল, মনে করে দেখুন তো? দেন নি, না দেবার নিশ্চয় কারণ আছে। ইথানলের ভ্যাপ নিতে বলা হচ্ছে, সাইনাসের ভেতরের করোনা মারা জন্যে? স্পর্শকাতর মিউকাস মেমব্রেন মানুষের পায়ু, চোখ, নাক, নাকের ভেতর থাকে।

গবেষণায় দেখা যায় উচ্চ ঘনত্বের এলকোহলে এই মেমব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রক্তপাত হতে পারে। সাইনাসের ভেতরের ঝিল্লি খুবই স্পর্শকাতর। ইউএস FDA এর নির্দেশনা হচ্ছে ওরাল ড্রাগে ১০% এর বেশী ইথানল ব্যবহার করা যাবে না। বাচ্চাদের ড্রাগে এটি ৫% এর বেশী নয়। ৫০% ইথানল দিয়ে কুলি করার সাদামাটা বিষয়টি NIH, CDC সহ বিশ্বসেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কেন করোনার চিকিৎসায় ব্যবহার করতে ব্যর্থ হলেন বুঝতে পারছেন নিশ্চয়!!

০২. সাইনাসের সমস্যা হলে, লবণ পানি দিয়ে নাক, মুখ রিঞ্জ করতে আমরা অভ্যস্ত। উচ্চ ঘনত্বের লবণ পানি গলা নাক পরিষ্কার করে ব্যাকটেরিয়া ভাইরাল লোড কমিয়ে আপনার আরামের কারণ হয়। কোভিড-১৯ এ যাদের হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয় না, তাঁদের জন্যে এটি সহায়ক, কিন্তু ওষুধ/প্রতিষেধক নয়।

০৩. আচ্ছা ব্লিচিং এবং সাবান তো করোনা ভাইরাস ধ্বংস করে, বুঝলাম ব্লিচিং বিপদজনক, সেই ক্ষেত্রে সাবান পানি দিয়ে কুলি করলে বা নাকের ভেতর নিলে অন্তত করোনা ভাইরাস ধ্বংস হবে, তো এই বুদ্ধিটা কেউ কাজে লাগাচ্ছে না কেন?? নিশ্চয় কারণ আছে। ঐ পথে যাচ্ছি না।

০৪. এটি তো RNA ভাইরাস। আমি তো ২০ বছর যাবত RNA ভাঙ্গার এঞ্জাইম RNase নিয়ে কাজ করছি নিউক্লিওটাইড রিচ অনেক প্রোডাক্ট ডেভেলপে, ফুড গ্রেড RNase, জাপান আর ইউরোপের বিখ্যাত সব এনজাইম মেকারদের, তো এই RNase এর মিশ্রণ গলায়, নাকের ভেতর দিলেও তো হয়, কিন্তু আমরা এই পথে যাচ্ছি না কেন? কারণ যে কোন একশনে ফাংশনের চেয়ে মানুষের সেফটি নিশ্চিত করা বড় বিষয়।

০৫. পত্রিকায় দেখলাম বাকৃবি’র অধ্যাপক আলিমুল ২৫মিলি ইথানল আর ২৫ মিলি পানির কথা বলেছেন, ধরে নিলাম এক্ষেত্রে ইথানলের ঘনত্ব হবে ৫০%। কানাডার দেখছি সেনিটাইজার হিসেবে এই ৫০% ইথানল SARS CoV-2 এর জন্যে রিকমান্ডেড নয়।

০৬. খুব বড় বিষয় হচ্ছে অধ্যাপক আলিমুল সাক্ষাৎকারে আর পত্রিকায় বলা হচ্ছে, গবেষণাগারে কোন গবেষণাই হয়নি, SARS CoV-2 এর উপর টেস্ট করা তো দূরের কথা। মুরগী থেকে ভাইরাস নিয়ে ল্যাবে ইথানল দিয়ে মেরে, গবেষকরা ইথানল দিয়ে কুলি করে আরাম পেয়েছেন। সেই আরামের উপর ভিত্তি করে ৭১’র টিভিতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, পত্রিকায় ছাপাচ্ছেন। একজন অধ্যাপক যদি এরকম চরম অপেশাদার হন, তখন আমাদের দেশের সাংবাদিকতার মান নিয়ে আর কি বলব!!! ন্যুনতম জ্ঞান বা প্রস্তুতি ছাড়াই বিজ্ঞান বিষয়ে প্রোগ্রাম করছেন সাংবাদিকরা!

০৭. আচ্ছা SARS CoV-2 এর মত ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করতে হলে, আপনার হাইটেক আর উচ্চ মাত্রায় নিরাপদ ল্যাব দরকার। বায়ো সেফটি লেভেল (BSL) 3 মাত্রার ল্যাব দরকার। অধ্যাপক আলিমুল এক্ষণে মনে হল উনার তো ঐ লেভেলের ল্যাবই নেই। এখন সরকার যদি কিছু করে। BSL-3 ল্যাব ব্যয়বহুল এবং এটি করতে সময় লাগবে যথেষ্ট। এর অনেক শর্তের দুটো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে

- Sustained directional airflow to draw air into the laboratory from clean areas towards potentially contaminated areas (Exhaust air cannot be re-circulated).

-A self closing set of locking doors with access away from general building corridors।

সুতরাং বুঝতেই পারছেন কতোটা প্রিম্যাচুউরভাবে পুরো বিষয়টি নিয়ে প্রচারণা চালানো হয়েছে।

০৮. অধ্যাপক আলিমুল বলছেন, ইথানল ব্যবহারে সরকারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হবে। কারণ ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজ ছাড়া এর ব্যবহারে অনুমতি নেই। সরকার চাইলেই এটি সম্ভব। সরকার অনুমতি দিবে কোন রেফারেন্সের ভিত্তিতে? এই বিষয়ে USFDA বা WHO এর গাইডলাইন কি? বাংলাদেশ কি এদের অগ্রাহ্য করতে পারবে? টিভি এবং পত্রিকায় দেখলাম এটি কে প্রতিষেধক বলা হচ্ছে। ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে সাধারণত টিকা বুঝায়। ঠিক আছে উনি আংশিক প্রিভেন্ট করতে চাচ্ছেন, সেই ক্ষেত্রে ইথানলের মত ওয়েল স্টাডিড একটি কেমিক্যাল দিয়ে কুলি করলে, ভ্যাপ নিলে হিউম্যান সেফটির কি অবস্থা হবে, সেটি তো প্রমাণ করতে হবে। এটি যে সময় সাপেক্ষ অধ্যাপক আলিমুলের এটি না জানার কথা নয়। একটি পরিসংখ্যানে আছে ১০ হাজার গবেষণা থেকে ২-৫ টির মত চূড়ান্তভাবে ড্রাগ হিসেবে বাজারে আসে।

০৯.আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, অধ্যাপকগণ সাফল্যের চূড়ায় যাক, এটা আমাদের সবার কাম্য। কিন্তু গবেষণা করার বা সুযোগ পাবার আগেই মিডিয়ায় ঘোড়ার আগে গাড়ী জুড়ে দেওয়াটা প্রতিষ্ঠানের সুনামের জন্যে সুখকর তো নয়ই বরং পেশার ওজন, মর্যাদা এবং পেশাদারিত্ব মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। উপযুক্ত গবেষণা ছাড়া একটি ভঙ্গুর হাইপোথেসিস নিয়ে প্রচার বিপদজনক বিশেষ করে বাংলাদেশে।

এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের টক শো বা পত্রিকায় রিপোর্ট উপর ভরসা করে কেউ যদি এটি পরীক্ষা করতে চান এবং বিপদে পড়েন, এর দায় কে নেবে? ইরানে একই কারণে এলকোহল খেয়ে মৃত্যু, কিংবা আফ্রিকায় ডেটল খেয়ে মৃত্যুর উদাহরণ তো আমরা জানি। কানাডার দায়িত্বশীল চ্যানেলগুলো এই ধরণের বিপদের হাত থেকে জনগণকে বাঁচাতে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছে আর হেলথ কানাডা ডাটা বিহীন এই সব টোটকা ব্যবস্থাপত্রের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে।

লেখক: খ্যাতিমান জীবপ্রযুক্তি বিজ্ঞানী 

বহুমাত্রিক.কম