Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

আষাঢ় ২৮ ১৪৩২, রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫

কিশোর অপরাধ: রুখতে চাই সম্মিলিত প্রয়াস

ইনামুল আসিফ লতিফী

প্রকাশিত: ১৭:৪৮, ৮ মার্চ ২০১৯

আপডেট: ১৭:৪৯, ৮ মার্চ ২০১৯

প্রিন্ট:

কিশোর অপরাধ: রুখতে চাই সম্মিলিত প্রয়াস

-লেখক

বর্তমান পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় অসংগঠিত ও অপরিকল্পিতভাবে দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের নেতিবাচক ফলাফল হলো কিশোর অপরাধ। পরিবারিক কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন, বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত বস্তিঅঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ এবং সমাজে বিরাজমান নৈরাজ্য ও হতাশা কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

সম্প্রতি কিশোর অপরাধের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে চলেছে। সারাবিশ্বে ক্রমবর্ধমান হারে কিশোর অপরাধ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ফলে এটি অল্প সময়ের মধ্যেই একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি হিসেবে পরিণত হতে পারে। পত্রপত্রিকা একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই দেখা যায় কিশোর অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। চুরি বা ঘর পালানোর মতো অপরাধ পেছনে ফেলে কিশোরদের ছিনতাই-খুন-ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে।

দেশে কিশোর অপরাধী কী হারে বাড়ছে, তার একটি তথ্য পুলিশের রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে কিশোর অপরাধের ঘটনায় সারাদেশে মামলা রেকর্ড হয়েছে এক হাজার ৫৯৬টি। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল এক হাজার ১৮৪টি। এ হিসাবে এক বছরে কিশোর অপরাধের মামলা বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশের বেশি (১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, দৈনিক সমকাল)। দেশের দুই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলার আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশির ভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা (২৮ জানুয়ারি ২০১৭, দৈনিক প্রথম আলো)।

২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট এরকমই এক কিশোর অপরাধ পুরো বাংলাদেশকে স্থম্ভিত করে ফেলে, রাজধানীর চামেলীবাগে নিজের বাসায় পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যা করে তাদেরই কিশোরী মেয়ে ঐশী রহমান । ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবীরকে খেলার মাঠে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে হত্যা করা হয়, এ ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায় পুলিশ ও প্রশাসন। কদিন আগে আমি নিজেই মানসিকভাবে বিরাট একটা ধাক্কা খাই একটা খবর পড়ে, খবরটির শিরোনাম ছিল “ফেনীতে চার বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার,কিশোর গ্রেপ্তার” (২০ জানুয়ারি ২০১৯, দৈনিক মানবজমিন) - এগুলো খন্ডচিত্র মাত্র। এরকম ছোট-বড় বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরীরা।

সাধারণত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব, পারিবারিক অস্থিতিশীলতা,অতিরিক্ত শাসন বা স্নেহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদের মত পারিবারিক বিষয়গুলো শিশুকাল থেকেই মানুষের জীবনে মারাত্মক আগ্রাসী প্রভাব ফেলে যার চূড়ান্ত আগ্রাসীরূপ প্রকাশ পায় যখন মানুষ শিশুকাল অতিক্রম করে কৈশোরে পা রাখে। সমাজজীবনে বিরাজমান নৈরাজ্য, হতাশা, উচ্চাকাঙ্ক্ষার মত কারনগুলোর জন্য চুরি-ছিনতাই-অপহরণের মত বিষয়গুলোর সাথে কিশোর বয়সীদের জড়িয়ে ফেলে।

সামাজিক চিত্তবিনোদনের উপাত্ত ও অপসংস্কৃতির প্রভাব আর সীমাহীন কৌতূহল একজন কিশোরের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টিতে পার্শ্ব ভূমিকা পালন করে। আর এসব কারণের সঙ্গে বর্তমানে সংযুক্ত হয়েছে বীরত্ব দেখানোর প্রবণতা যা রূপ নিয়েছে ‘গ্যাং কালচারে’, এই ‘গ্যাং কালচার’ মূলত গড়ে উঠছে প্রভাবশালী হিসেবে খ্যাত এলাকাভিত্তিক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক বড় ভাইদের দ্বারা, যারা রাজনৈতিক পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ান কিন্তু রাজনীতির যে মূল নীতি বা আদর্শ আছে তা থেকে তারা পথভ্রষ্ট। মূলত এক শ্রেণির কিশোর তথাকথিত বড় ভাইদের ছত্রছায়ায় নিজেদের বাহাদুরি প্রমাণ করতেই জড়িয়ে পড়ছে এ ধরনের সংস্কৃতিতে এবং এ ধরনের আচরণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মদদ জোগাচ্ছে বিভিন্ন মুভি, সিরিয়াল ও ভিডিও গেমস।

মাদকের ভয়াবহতাও কিশোর অপরাধের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। হরহামেশাই যে কিশোর অপরাধগুলো সংগঠিত হয় -এগুলো হচ্ছে মোটর সাইকেল বা গাড়ি নিয়ে উচ্চ গতিতে রেসিং, এলাকার দোকানগুলোতে বড় ভাইদের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজি, প্রকাশ্যে ধূমপান ও মাদকাসক্তি, ইভটিজিং ইত্যাদি। শিশু-কিশোর-তরুণদের অপরাধের পথে পা বাড়ানোর যত কারণ রয়েছে তার মধ্যে বর্তমান সময়ে অশুভ বিনোদনও অনেকাংশে দায়ী। বর্তমান প্রজন্ম অতিমাত্রায় ভার্চুয়াল জগতের মানুষ হয়ে যাচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে তারা অনেক সময় আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন অনেক বিষয়ে অভ্যস্থ হয়ে উঠছে। অনেকে পর্নগ্রাফি দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এসবই তরুণ সমাজ ও আগামী প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রশ্ন হচ্ছে দ্রুত ছড়িয়ে পরা কিশোর অপরাধ থামানোর উপায় কি? আমার ব্যক্তিগত চিন্তা-ধারণা হচ্ছে প্রথমেই অপসংস্কৃতির হাত থেকে আমাদের শিশু-কিশোরদের রক্ষা করতে হবে। বিদেশে নির্মিত প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য বানানো বিভিন্ন মুভি, সিরিয়াল ও ভিডিও গেমস যেন কোনভাবেই আমাদের দেশের শিশু-কিশোরদের হাতে না যায়, এই বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে পরিবারের সদস্যদেরই। সরকার ও প্রশাসনের পক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশু-কিশোরদের জীবনযাপন সামলানো কোনরকমেই সম্ভব না।

সরকার ও প্রশাসনকে যে দায়িত্ব কঠোরভাবে পালন করতে হবে তা হচ্ছে রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শ বিবর্জিত তথাকথিত বড় ভাইরা যেন কোনভাবেই নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য শিশু-কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ বা ‘গ্রুপিংয়ে’  জড়ানোর মাধ্যমে অপরাধের সাথে জড়িয়ে ফেলতে না পারে তা নিশ্চিত করা। সরকার এই মেয়াদে এসে মাদক ও পর্ণগ্রাফির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং বর্তমান সময়ে সরকার অনেকাংশেই এক্ষেত্রে সফল হচ্ছে। 

স্কুল কলেজের সম্মানিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে হবে, ছাত্রছাত্রীরা ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে এরকম কিছু বোঝার সাথে সাথেই পরিবারকে অবহিত করতে হবে এবং তাদেরকে মানসিকভাবে সাহস ও শক্তি যোগাতে হবে এধরনের বিষয় থেকে বের হয়ে আসার। যেসব কিশোর এরই মধ্যে অপরাধে যুক্ত হয়েছে তাদের কাউন্সেলিং করানোর মতো ভালো ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই। চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৬ সালের ‘চীনা শিশু উন্নয়ন রূপরেখা’য় বলা হয় ২০১৬ সালে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা ২০১০ সালের চাইতে ৪৭.৬% কম; কারণ তারা প্রাধান্য দিচ্ছে শিশুর মধ্যে নৈতিকতাবোধ সৃষ্টির পাশাপাশি আবেগগত, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপক্কতাকে (২৮ মে ২০১৮, দৈনিক ইত্তেফাক)। সরকারের উচিত এদিকে শুভ দৃষ্টি দেওয়া, উন্নত কিশোর সংশোধন কেন্দ্র ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা।

আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, আমরা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখি। আমরা স্বপ্ন দেখি বিশ্ব মানচিত্রের বুকে উজ্জ্বলভাবে জ্বলে থাকতে। এই স্বপ্নগুলো পূরণের হাতিয়ার আমাদের এই শিশু-কিশোররাই। আজকের এই কিশোররাই আমাদের আগামীর হাল ধরবে। তাই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কর্তৃক তাদের সঠিক পরিচর্যাই আমাদের স্বপ্নগুলো পূরণ করবে। আমার-আপনার-জনগণের-রাষ্ট্রের সকলের সম্মিলিত প্রয়াসই সমাজকে রক্ষা করতে পারে কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা থেকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ; শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

বহুমাত্রিক.কম