Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ২৫ ১৪৩২, শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫

ব্লু জোন রহস্য: রোগহীন দীর্ঘজীবী সম্প্রদায়ের খোঁজে

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:২৭, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

প্রিন্ট:

ব্লু জোন রহস্য: রোগহীন দীর্ঘজীবী সম্প্রদায়ের খোঁজে

ফাইল ছবি

সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সঠিক খাবার ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ। কিন্তু যখন দীর্ঘায়ুর কথা আসে, তখন তালিকায় যুক্ত হয় সুষ্ঠু জীবনধারণ পদ্ধতি। খাদ্যাভাসের ওপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সার্বিকভাবে বদলে দিতে পারে মানুষের জীবনযাত্রাকে। আর তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে ব্লু জোন। সেখানকার মানুষগুলো কেবল দীর্ঘজীবীই নয়, জীবদ্দশার সময়গুলোতে তারা নিজেদের সুস্থতাকেও ধরে রাখে। আজকের নিবন্ধটিতে উদ্ঘাটিত হবে সেই ব্লু জোনের রহস্য। চলুন, জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে ব্ল জোন নিবাসীরা রোগহীনভাবে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে।

ব্লু জোন কী
ব্লু জোন ধারণাটির সূত্রপাত হয়েছে মূলত ২০০৪ সালে প্রকাশিত জিয়ান্নি পেস এবং মিশেল পউলেইনের জনসংখ্যা সংক্রান্ত গবেষণা থেকে। তারা ইতালির সার্ডিনিয়ার নুরো প্রদেশকে শতবর্ষী পুরুষদের অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে তার নাম দিয়েছিলেন ‘ব্লু জোন’। পরবর্তীতে এই গবেষণালব্ধ ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আমেরিকান লেখক ড্যান বুয়েটনার খুঁজে বের করেন আরও ৪টি অঞ্চল।

প্রকৃতপক্ষে ব্লু জোন হলো বিশ্বের সেই অঞ্চলগুলো, যেখানকার অধিবাসীদের আয়ু পৃথিবীর মানুষের সাধারণ গড় আয়ুর তুলনায় বেশি। চলুন, ব্লু জোন হিসেবে চিহ্নিত সেই জায়গাগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেই।
বিশ্বের ৫টি ব্লু জোন

নুরো প্রদেশ, সার্ডিনিয়া, ইতালি
এটি ইতালির সার্ডিনিয়ার স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপ অঞ্চলের একটি প্রদেশ। সার্ডিনিয়া হলো ইতালির মূল ভূখণ্ডের অদূরে বনে ঘেরা এক রুক্ষ দ্বীপ, যার সম্মুখে রয়েছে সুন্দর বালুকাময় সমুদ্র সৈকত।

এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় মাথাপিছু শতবর্ষজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় দশগুণ বেশি। এমনকি নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে এই আয়ুর অনুপাত সমান।

নুরো নিবাসীদের প্রধান খাবার সেখানকার ঐতিহ্যগত ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য। এই তালিকার বেশিরভাগই শস্যজাত, শাক-সবজি, দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং একদম স্বল্প পরিমাণ মাংস।
পাহাড়ী দ্বীপ সার্ডিনিয়ার মানুষেরা গাড়ির বদলে পায়ে হেটেই বেশি পাহাড়ী পথসহ অন্যান্য রাস্তাগুলো অতিক্রম করে। এখনও সেখানকার অধিকাংশ অধিবাসীদের মেষ চড়াতে দেখা যায়। অফিস থেকে লোকেরা সরাসরি বাড়িতে এসে পরিবারের সঙ্গে দুপুরের খাবার খায়।

সার্ডিনিয়ানরা পরিমিত পরিমাণে অ্যালকোহল পান করে। স্থানীয় এই ওয়াইন ক্যানোনৌ বা গ্রেনেচ নামে পরিচিত।
ওকিনাওয়া, জাপান
এটি জাপানের দক্ষিণে একটি উপক্রান্তীয় দ্বীপপুঞ্জের বৃহত্তম দ্বীপ। এখানকার লোকেরা কয়েক প্রজন্ম ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসছে।

১৯৮০ সালে ওকিনাওয়ার পুরুষদের আয়ু ছিলো কমপক্ষে ৮৪ এবং মহিলাদের সর্বোচ্চ আয়ু ছিলো ৯০ বছর।
সকাল হতে না হতেই ঘুম ভেঙে বাইরে পড়তে দেখা যায় বয়স্ক ওকিনাওয়ানদের। তাদের নিত্যদিনের খাদ্যাভাসে রয়েছে উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাদ্য যেমন ভাজা সবজি, মিষ্টি আলু, তোফু। তারা শুকরের মাংসও খায় তবে বেশ অল্প পরিমাণে।

প্রায় সব ওকিনাওয়ান শতবর্ষীদের সাধারণ কাজ হলো বাগান করা।

নিকোয়া, কোস্টারিকা
এটি কোস্টারিকার একটি উপদ্বীপ, যেখানকার বাসিন্দাদের গড় আয়ু ৮৫ বছর। এদের প্রাত্যহিক খাবার হচ্ছে স্কোয়াশ, ভুট্টা, কলা, এবং প্রচুর পরিমাণে মটরশুটি। এখানে মাংসের পরিমাণ থাকে অনেক কম।

সকালে ভাত, মটরশুটি এবং কফির নাস্তা শেষে নিকোয়ান পুরুষরা ঘোড়ায় চড়ে পাহাড় আরোহন করেন। এরা প্রতিদিনি দ্বীপের যত্রতত্র ঘুরে বেড়ান, এবং বাগান করার মত বিভিন্ন কায়িক পরিশ্রমে নিজেদের ব্যস্ত রাখেন।
নিকোয়া নিবাসীরা অতিরিক্ত সময় জীবিকা নির্বাহে ব্যয় করার চেয়ে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বেশি সময় কাটান।

ইকারিয়া, গ্রিস
গ্রিসের সামোস থেকে ১০ নটিক্যাল মাইল (১৯ কিলোমিটার) দক্ষিণ-পশ্চিমে এজিয়ান সাগরের বুকে জেগে একটি দ্বীপ এই ইকারিয়া। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় গড়ে দশ বছর বেশি বাঁচে এখানকার অধিবাসীরা। প্রতি তিনজন ইকারিয়ানের মধ্যে একজনের বয়স ৯০-এর কোঠায়।

এদের খাদ্যতালিকায় আছে জলপাই তেল, শাক-সবজি, রসুন, সার্ডিন, স্যামন, হেরিং, ট্রাউট, বাদাম, আখরোট, গোটা শস্যের রুটি, পাস্তা এবং ভাতের মত ভূমধ্যসাগরীয় খাবার।
নিকোয়া নিবাসীরা অতিরিক্ত সময় জীবিকা নির্বাহে ব্যয় করার চেয়ে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বেশি সময় কাটান।

ইকারিয়া, গ্রিস
গ্রিসের সামোস থেকে ১০ নটিক্যাল মাইল (১৯ কিলোমিটার) দক্ষিণ-পশ্চিমে এজিয়ান সাগরের বুকে জেগে একটি দ্বীপ এই ইকারিয়া। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় গড়ে দশ বছর বেশি বাঁচে এখানকার অধিবাসীরা। প্রতি তিনজন ইকারিয়ানের মধ্যে একজনের বয়স ৯০-এর কোঠায়।

এদের খাদ্যতালিকায় আছে জলপাই তেল, শাক-সবজি, রসুন, সার্ডিন, স্যামন, হেরিং, ট্রাউট, বাদাম, আখরোট, গোটা শস্যের রুটি, পাস্তা এবং ভাতের মত ভূমধ্যসাগরীয় খাবার।
শহরে অ্যালকোহল বিক্রি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ। গির্জার মালিকানাধীন মুদির দোকানে মাংস বিক্রি হয় না।

দীর্ঘজীবীদের মধ্যে প্রায় ৯ হাজার লোক সেভেন্থ-ডে অ্যাডভেন্টিস্ট-এ বিশ্বাসী। এই প্রোটেস্টেন্ট খ্রিস্টানদের খাদ্যের বিশাল অংশ দখল করে আছে উদ্ভিজ্জ খাবার। কালো মটরশুটি, বাদাম এবং অ্যাভোকাডো তাদের খাদ্যের কেন্দ্রীয় উপাদান। স্বল্প কিছু সেভেন্থ-ডে অ্যাডভেন্টিস্ট শেলফিশ এবং লাল মাংস (বিশেষ করে শূকরের মাংস) গ্রহণ করেন।

মাংসের পরিবর্তে স্থানীয় লোমা লিন্ডা মার্কেট ভরা থাকে শিম এবং শস্য বীজ দিয়ে।

সেভেন্থ-ডে অ্যাডভেন্টিস্টরা অ্যালকোহল পান করেন না। সাধারণ ধর্মাবলম্বীরা নিকোটিন এবং ক্যাফেইনও এড়িয়ে চলেন।
লোমা লিন্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিটনেস সেন্টার এর সকল বাসিন্দাদের জন্য উন্মুক্ত। পরিবারের সঙ্গে প্রকৃতি ভ্রমণ সেভেন্থ-ডে অ্যাডভেন্টিস্টদের জন্য বেশ সাধারণ একটি ব্যাপার।

যেসব কারণে ব্লু জোনের মানুষ দীর্ঘদিন রোগমুক্তভাবে বেঁচে থাকে
সম্পূর্ণ উদ্ভিদজাত খাদ্য গ্রহণ

ফল, শাক-সবজি, মটরশুটি, লেবু, গোটা শস্য, বাদাম এবং বীজ ব্লু জোনের মানুষের ক্যালোরির সিংহভাগ সরবরাহ করে। এই জাতীয় খাবারগুলোতে ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন, খনিজ এবং জৈবিক যৌগগুলোর মতো পুষ্টি থাকে। এই পুষ্টি কোলেস্টেরল কমাতে, রক্তে শর্করার মাত্রা উন্নত করতে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

মাংস ও অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ
ব্লু জোনের বাসিন্দারা একেবারেই যে মাংস খান না তা নয়। মাংসের পাশাপাশি তারা মাছ, দুধ ও ডিমও খান, তবে অবশ্যই প্রতিদিন নয়। ফলে, তাদের শরীরে প্রাণীজ পণ্যগুলোতে থাকা দ্রুত বয়স বৃদ্ধির হরমোনের মতো বিপজ্জনক কৃত্রিম রাসায়নিকের পরিমাণ কম থাকে।
ব্লু জোনের লোকেরা দিনে ১ থেকে ২ গ্লাস ওয়াইন পান করেন। এই অভ্যাস তাদেরকে বিভিন্ন রোগসহ বয়স-সম্পর্কিত জ্ঞানীয় পতন থেকে দূরে রাখে। এছাড়া এই নিয়ন্ত্রণ তাদেরকে হৃদরোগ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং এমনকি ক্যান্সারের মতো দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো থেকেও মুক্ত রাখে।

কাজের মাধ্যমে শরীরচর্চা ও পর্যাপ্ত ঘুম
বাগান করা, হাঁটা এবং পর্বত আরোহণ ব্লু জোনের লোকেদের জন্য নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাদের জিম করতে হয় না বা ভোরে উঠে স্বাস্থ্য গঠনের উদ্দেশ্যে আলাদা করে ব্যায়ামের প্রয়োজন হয় না। তাদের জীবনধারণ পদ্ধতিই তাদের ৯০-এর বছর বয়সের সময় তাদেরকে শারীরিকভাবে সক্রিয় রাখে।

দৈনিক কায়িক শ্রম সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ুত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, কারণ এটি টক্সিন ভাঙ্গন বাড়ায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং হাড় ও পেশীকে মজবুত রাখে।তারা ঘুমের সময়রেখাটা বেশ ভালোভাবেই মেনে চলেন। তাদের প্রায় সকলেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই জেগে ওঠেন। অন্যদিকে সূর্যাস্তের পরে বেশি তারা ঘুমানোর জন্য বেশি রাত করেন না। কেউ কেউ কাজের মাঝে নিজেকে সতেজ রাখার জন্য দিনের বেলাতেও হাল্কা ঘুম দিয়ে নেন।

এই চর্চা শুধু শরীরকেই নয়; তাদের মনকেও সুস্থ রাখে।

দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা
শরীর ভালো থাকাটা মনকে অনেকটাই দুশ্চিন্তা মুক্ত করে দেয়। এরপরেও ব্লু জোনের জনগণ প্রতিদিন প্রার্থনা বা ধ্যান করে এবং পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটায়। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে তারা অতিরিক্ত কাজ করার দিকে ধাবিত হন না। এছাড়া পরস্পরের সঙ্গে তারা সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখেন। পিতামাতা এবং দাদা-দাদীসহ যৌথ পরিবারে তারা একত্রে বসবাস করেন। শুধুমাত্র কুশল বিনিময় ছাড়াও প্রতিবেশীদের সঙ্গে তারা নিয়মিত দেখা করেন। ফলে দীর্ঘস্থায়ী চাপ থেকে সৃষ্ট প্রদাহ এবং বিষণ্নতার মতো ব্যাধির ঝুঁকি থেকে তারা দূরে থাকেন।
জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে আত্মবিঃশ্বাসী
ব্লু জোন নিবাসীরা জীবন নিয়ে হতাশাগ্রস্ত নন। তারা নিজেদের কর্মকান্ড নিয়ে বেশ খুশী। তারা জানেন যে, তারা কোথায় যাচ্ছেন এবং কেন যাচ্ছেন। আর এর জন্য তাদের মধ্যে কোনও রকম তাড়াহুড়ো নেই।

এই আত্মবিঃশ্বাস তাদের ব্যক্তিগত বৃদ্ধি এবং বিকাশের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। গবেষণা দেখা গেছে যে, এ ধরনের অনুভূতি সুখ এবং আত্মসম্মানকে বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং এমনকি ব্যক্তির আয়ু আরও ৭ বছর বাড়িয়ে দিতে পারে।

ব্লু জোন-এর এই রোগহীন দীর্ঘজীবী সম্প্রদায় গোটা পৃথিবীর বিস্ময়। সেই সঙ্গে এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্তও বটে বাকি বিশ্ববাসীর জন্য। জীবনধারণকে কিছুটা আলাদা বলতে যাবতীয় মিষ্টতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা নয়। বরং এই উদ্ভিজ্জ খাবার, নিয়মিত ও পরিমিত পরিশ্রম, পর্যাপ্ত ঘুম এবং বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তার বজায় রাখার মত কর্মকান্ডেই নিহিত আছে প্রকৃত সুখ।

নিয়ন্ত্রণের নিয়ম-কানুনগুলো যখন নিত্য-নৈমিত্তিক অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন সেই নিয়মানুবর্তিতা আর চাপের সৃষ্টি করে না। বরং এর প্রতি নিবেদিত হওয়া সীমিত জীবনে যুক্ত করতে পারে আরও কয়েকটি বছর।

ইউএনবি

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer