Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

আশ্বিন ২৬ ১৪৩১, শনিবার ১২ অক্টোবর ২০২৪

যেমন দেখে এলাম পাশা ভাইয়ের পূণ্যধাম লাইমপাশা

আশরাফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৪:৫২, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আপডেট: ১৫:১৫, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

প্রিন্ট:

যেমন দেখে এলাম পাশা ভাইয়ের পূণ্যধাম লাইমপাশা

-লাইমপাশা ঘুরে দেখা। ছবিঃ শাকিল আহমেদ

লাইমপাশা (ইটনা, কিশোরগঞ্জ) থেকে ফিরে: জীবদ্দশায় ‘হাওর ভূমিপুত্র’ ড. নিয়াজ উদ্দিন পাশা বহুবার আমন্ত্রণ করেছেন হাওর ঘুরে দেখার। দেশের একটি বিরাট ভূ-ভাগের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি ও জীবনাচারের যে স্বাতন্ত্র্য তা আমরা একজন পাশা ভাইয়ের মুখ থেকে শুনে শুনেই ওয়াকিবহাল হয়েছি। তিনি বলতেন, ভরা বর্ষায় হাওরের যে প্রাণপ্রাচুর্য তা বছরের অন্য সময়ে দেখা যাবে না। তাঁর লেখায় ‘হাওরের আফালের তাফালিং’ দেখার সৌভাগ্য না হলেও গত পরশু অনেকটা অপ্রস্তুত অবস্থাতেই গিয়েছিলাম পাশা ভাইয়ের দেশে। হাওরের বিরাট জলরাশি দেখবার সৌভাগ্য না হলেও শীতের শেষভাগে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের সবুজ মাঠ আমাদের স্বাগত জানিয়েছিল। 

রাজধানীর যাত্রাবাড়ি থেকে বাসে চেপে মধ্যরাতে যখন যাত্রা করি কিশোরগঞ্জের লাইমপাশার পথে তখন তাপমাত্রা বেশ নাতিশীতোষ্ণই।  ভোররাতে আমরা যখন হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ পৌছাই তখন শীতের হিমেল আলিঙ্গনে কিছুটা জবুথবু অবস্থা। কুয়াশায় ঢাকা হাওরের প্রভাত। সকাল ৬টার কাছাকাছি আমরা পৌছে যাই কুশিয়ারার তীরে। নদীর স্বচ্ছ জল যেন আমাদের নদীবক্ষে সাঁতরে বেড়াবার আহ্বান করছিল! ইঞ্জিন চালিত নৌকায় নদী পারাপারের ব্যবস্থা।

নৌকা থেকে নেমে খানিক এগিয়ে যেতেই কুয়াশার চাদর সরিয়ে একজন ‘...ভাই’ বলে এগিয়ে এলেন। এমন অভ্যর্থনার জন্য অপ্রস্তুত আমি হঠাৎই আবিষ্কার করলাম রোকন ভাই (পাশা ভাইয়ের ছোট ভাই) এসছেন আমাদের স্বাগত জানাতে। বেশ লাগলো, এমন শীতের জবুথবু সকালে এগিয়ে নিতে এভাবে অপেক্ষায় রয়েছেন কেউ! এ বোধহয় আমাদের মমতাময় আবহমান গ্রামবাংলাতেই দেখা যাবে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এমন অভিব্যক্তির অনুপুঙ্খ প্রতিচ্ছবিই এঁকেছেন তাঁর গানে, ‘ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ/ওমা তোমার চরন দুটি বক্ষে আমার ধরি/আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।’

অকাল প্রয়াত কৃষিবিদ ড. নিয়াজ পাশার লেখনিতে হাওরের অধিবাসীদের জীবনাচার ও তাদের সিংহহৃদয় নিয়ে যে বিবরণ শুনে এসেছি কৃষক রোকন ভাইয়ের অকৃত্রিম অভ্যর্থনায় আপ্লুত হয়ে সেই উক্তিরই স্বার্থকতা খুঁজে পেলাম লাইমপাশায় এসে। বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার যে বিরাট সঞ্জীবনী শক্তি হাওরের অধিবাসীরা সঞ্চয় করেছেন, সেই অধিবাসীদের মনে এতো প্রগাঢ় মায়া-মমতাও আছে, লাইমপাশায় না এলে বুঝতেই পারতাম না। 

আগেই বলছিলাম পাশা ভাইয়ের চোখে হাওরকে দেখা, হাওরের বৈচিত্র্য-সম্ভাবনা কিংবা সংকটকে যেমন করে চেনার সুযোগ পেয়েছি, প্রথমবার হাওরভূমিতে পা রেখে তার বহু স্বাদৃশ্য চোখে পড়লো। পাশা ভাই তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় হাওরকে যে উন্নততর রূপে দেখার আমৃত্যু সাধ নিয়ে পরলোকে যাত্রা করেছেন, ঘুমিয়েছেন হাওরভূমে তার অনেক স্বপ্নই বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করেছে, তা দেখে ভীষণ আনন্দ হয়েছে। লাইমপাশার পথে যেতে যেতে সুপ্রশস্ত রাস্তা, বিদ্যুতায়িত জনপদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উন্নত অবকাঠামো-এই তো চেয়েছিলেন পাশা ভাই। তাঁর ‘হাওর ইপিজেড’র স্বপ্ন কিংবা ‘হাওর মন্ত্রণালয়’ এমন অনেক কিছুই হয়তো এখনো বাস্তব হয়নি। কিন্তু যা বাস্তবরূপ পেল তাও কম কি!

আমরা জানি, দেশের বিস্তৃত হাওর অঞ্চলের জন্য উপযোগী কৃষি, মৎস্য কিংবা অন্যান্য সুপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাওর বিষয়ক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় আমৃত্যু উচ্চকণ্ঠ ছিলেন পাশা ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী গ্রাজুয়েট ড. পাশার আকুল আবেদন ও নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতেই তাঁর প্রয়াণের পর প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’। যদিও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায়ের এই ইনস্টিটিউট পুরোপুরি সক্রিয় কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকট হতে পারেনি তবু এর প্রতিষ্ঠা হাওর ও চরবাসীদের মনে নূতন আশার সঞ্চার করেছে। আমরা আশা করতেই পারি, অদূর ভবিষ্যতে এই ইনস্টিটিউট সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর হাওর ও চর উন্নয়ন পরিকল্পনা দিয়ে অধিবাসীদের দুঃখ মোচনে অবদান রাখবে। 

শহরের নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক দৃশ্যপটে অভ্যস্ত আমরা লাইমপাশায় গিয়ে প্রত্যক্ষ করি, কিভাবে পরিবারের প্রতিটি সদস্য সংসারে অবদান রাখতে পারেন। আমরা দেখতে পেলাম, অন্তঃপুরবাসিনী নারীরা বাড়ির পাশের জলাশয় থেকে কাঁখে কলসে জল ভরে আনছেন, কেউবা গোয়াল থেকে গোবর এনে পরিত্যক্ত খড় দিয়ে রান্নার জ্বালানির বন্দোবস্ত করছেন, শিশুরা ছাগলের পাল নিয়ে মাঠের পথে ছুটে চলেছে, মাঠে বোরো ক্ষেতে নিড়ানী দিতে ব্যস্ত কৃষক, পরিবারের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ মানুষটিও সদ্যোজাত শিশুটির দেখভালে ব্যস্ত। বিস্তীর্ণ হাওরের মাঝে উঁচু ভূমিগুলোতে বহু পরিবার একত্রে পাশাপাশি ঘর তুলে বাস করছেন। আজ সেই প্রত্যন্ত গ্রাম লাইমপাশাতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। মাটি আর বাঁশের বেড়া বা খড়ের ছাউনিকে পেছনে ফেলে পাকা বাড়ির সংখ্যাই বেশি মনে হল এখানে। নিত্য দারিদ্র্য যেখানকার অধিবাসীদের কুঁড়ে কুড়ে খেতো সেই হাওরে এখন ভিন্ন দৃশ্য দেখা গেল। নিম্নআয়ের মানুষদের সংসারের খানিকটা টানাটানি থাকলেও সিংহভাগ মানুষ আজ মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছেন, লাইমপাশা ঘুরে অন্তত তাই মনে হল। 

ড. নিয়াজ পাশার সমাধি জিয়ারতে লেখক। সঙ্গে রোকন উদ্দিন। 

গ্রামের কেন্দ্র থেকে খানিক দূরে সম্মিলিত এক কবরস্থানে সমাহিত হয়েছেন হাওর ভূমিপুত্র ড. নিয়াজ উদ্দিন পাশা। সকালে লাইমপাশা পৌছেই আমরা ছুটে যাই পাশা ভাইয়ের সমাধিতে। কোলাহলহীন শান্তস্নিগ্ধ এক সমাধিক্ষেত্র। সেখানে চিরঘুমে প্রিয় পাশা ভাই। হাওরের মাটিতে লীন হয়ে যাওয়া পাশা ভাইয়ের পূণ্যস্মৃতি উচ্চে তুলে ধরেছে একখানি ফলক। সেখানে লিপিবদ্ধ তাঁর পার্থিবজীবনের পরিচয়। কবর জিয়ারতে বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে ফেরার পথে আমরা দেখতে পেলাম ইটনা-লাইমপাশা সংযোগ সড়কের সংস্কার কার্যক্রম। স্থানীয় মৃগা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দারুল ইসলাম পাশা ভাইয়ের বাড়িতে এক পারিবারিক আয়োজনে যোগ দিয়ে আলাপচারিতায় জানাচ্ছিলেন, এই হাওরের উন্নয়নে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে যে উন্নয়ন হয়েছে তা এক দশক আগেও কেউ কল্পনা করেনি। বর্তমান বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সবচেয়ে অবহেলিত জনপদ আজ উন্নত এক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। 

এই জনপ্রতিনিধি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করে বলেন, ‘একজন নিয়াজ পাশার মতো দেশপ্রেমিক আবার কবে এই অঞ্চলে জন্মাবে আমরা জানি না। তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের সংকট ও সম্ভাবনা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের কাছে পৌছাতো। তাঁর অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে বর্তমান দৃশ্যমান অনেক কিছুই বাস্তবে রূপান্তর হয়েছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ড. পাশার স্বপ্ন অচিরেই পূর্ণতা পাবে।’ 

হাওরের অনেক কিছু ঘুরে না দেখতে পারার আক্ষেপ নিয়ে বিকেলে সেই কুশিয়ারা পেরিয়ে যখন ঢাকার পথে রওনা হব, তখন লাইমপাশার মায়াময় প্রকৃতি আমাদের পেছনে টানছিল। দুপুরের লাইমপাশার এক অচেনা কিশোরের সঙ্গে কথা হয়েছিল কিলোমিটার দূরে না শুকানো হাওরের কিছু জলাশয় তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে দেখার। অপূর্ণতা নিয়ে ফিরে গেলেও ফের কখনো হয়তো সেই বিলগুলো ঘুরে দেখা সাধ পূর্ণ করব। ততোদিনে লাইমপাশার আরও উন্নত যোগাযোগ, অসমাপ্ত সেতুর কাজও হয়তো ততোদিনে সমাপ্ত হবে। তখনও  অকৃত্রিম অভ্যর্থনার জন্য রোকন ভাইয়ের মতো কাউকে নিশ্চয়ই পাবো। পাশা ভাইয়ের লাইমপাশা মমতা আর ঐক্যে এভাবেই আচ্ছন্ন থাকুক।  

লেখকঃ প্রধান সম্পাদক, বহুমাত্রিক.কম 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer