
ঢাকা : গত ১৬ এপ্রিল ছিল স্বাস্থ্যসপ্তাহ পালনের উদ্বোধনী দিন। রাজধানী ঢাকায় উক্ত সপ্তাহের উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন সাফল্যের কথা তুলে ধরে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
সেখানে তিনি বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের সাফল্যের কথাও বলেন। সেইসাথে তিনি বাংলাদেশের চিরায়ত ও ঐতিহ্যবাহী ভেষজ চিকিৎসার উপর গুরুত্বারোপ করেন। শুধু তাই নয় তিনি সেখানে ভেষজ, আয়ুর্বেদ, ইউনানী এবং হোমিওপ্যাথিসহ এ ধরনের সকল ট্র্যাডিশনাল চিকিৎসার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সেগুলোর মান উন্নয়নের বিষয়টি তাঁর সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করেন।
অমরা ছোটবেলায় দেখেছি গ্রামবাংলায় চিরায়ত সেই ভেষজ ওষুধের চিকিৎসা। মানুষ, গবাদি পশু, এমনকি হাঁস-মুরগীদের পর্যন্তও ভেষজ চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
সেটাকে বলা হতো কবিরাজি চিকিৎসা। বাড়িতে কারো পেটের ব্যথা হলে কাঁচা বেল, আমাশয় হলে এঁটে বা বিচি কলা সেইসাথে খারাজরা গাছের ছাল কিংবা পাতা দিয়ে বিশেষ ধরনের শরবত বানিয়ে খাওয়ালে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যেতো। মাঠে কাজ করতে করতে কোথাও একটু কেটে কিংবা ছিলে গেলে সেখানে তাৎক্ষণিক কচু গাছের পাতাসমেত ডাল কেটে তা থেকে কচু ডালের ফেনাযুক্ত রস লাগিয়ে দিলেই সে জায়গা তাৎক্ষণিক একটা কামড় দিয়ে এন্টিবায়োটিকের কাজ করতো। সাথে সাথে দুর্বা ঘাস চিবিয়ে কিংবা থানকুনি পাতা কচলিয়ে তার রস ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে রাখলে খুব সহজেই ভালো হয়ে যেতো।
এখানে থানকুনি গাছের ভেষজ গুণ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত অলোচনা করবো। থানকুনি এক ধরনের ছোট বর্ষজীবী ভেষজ উদ্ভিদ। গ্রামাঞ্চলে থানকুনি পাতার ব্যবহার আদি আমল থেকেই চলে আসছে। ছোট্ট কিন্তু গোলাকৃতির এ পাতার মধ্যে রয়েছে অনেক ভেষজ গুণ। এ পাতার রস রোগ নিরাময়ে অতুলনীয়। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, উত্তর অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি এবং এশিয়ার অন্যান্য প্রান্তে এ অতি প্রয়োজনীয় উদ্ভিদটি পাওয়া যায়। এর গুণগুলোর মধ্যে রয়েছে- নিয়মিত সপ্তাহে অন্তত ২-৩ দিন খেলে চুলপড়া বন্ধ হয়, পুষ্টির ঘাটতি দূর হয়, শরীরের টক্সিক উপাদান বেরিয়ে যায়, ব্যাথা উপশম হয়, হজমের উন্নতি ঘটে, বদহজম ও গ্যাস বন্ধ করে, ত্বকের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে। এমন নিরাময়ের কারণ হলো এতে অ্যামাইনো এসিড, বিটা ক্যারোটিন, ফ্যাটি এসিড, ফাইটোক্যামিক্যাল ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক বিদ্যমান।
রাস্তার ধারে, পুকুর পাড়ে সৌন্দর্য বর্ধন এবং ওষুধি গুণাগুণসম্পন্ন সকলের অতিপরিচিত আরেকটি গাছ হলো সোনালু। ঢাকার বিভিন্ন স্থান এবং অন্যান্য সড়ক-মহাসড়ক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বন-জঙ্গলসহ গ্রামীণ রাস্তার ধারে ছোট-বড় সোনালু গাছ দেখতে পাওয়া যায়। সোনালী রঙের সুদর্শন ফুলের জন্য এর নাম সোনালু। সোনালু গাছের বাকল এবং পাতায় ওষুধি গণাগণ রয়েছে। এ গাছের বাকল এবং পাতা যকৃত ভালো রাখতে জীবাণুনাশক, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ডায়রিয়া ও বহুমূত্র রোগে ব্যবহূত হয়।
অপরদিকে বলা হয় ভিটামিন সি এর সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক উৎস হলো আমলকি। এটি ত্রি-ফলার একটি অন্যতম উপাদান। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী এ গাছের ফল ও পাতা দুটিই ওষুধরূপে কার্যকর। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে এতে রয়েছে টানিন ও কলয়ডাল পদার্থ ফাইলেমব্লিক এসিড, গ্যালিক এসিড, ইমাব্লিকোল ছাড়াও ফাইলেমব্লিন ও মিউসিক এসিড। পেট ফাঁপা বা অম্ল নিরাময়ে চোখ ওঠা রোগে, পিত্ত বেদনায়, বমি বন্ধ করতে, শে^তপ্রদর রোগ হলে,অশর্^, ডায়রিয়া, আমাশয়, রক্তস্বল্পতা, জন্ডিস ও ত্বকের সমস্যায় কাজ করে। ভিটামিন সি, ভিটামিন বি-১ এবং ভিটামিন বি-২ এর অভাবজনিত রোগসমূহে আমলকি বেশ ফলপ্রদ।
প্রকৃতিতে এমনিভাবে ভেষজ গুণসম্পন্ন আরো হাজারো গাছ-গাছরা রয়েছে যাদের আলাদা আলাদা ভেষজ গুণ বিদ্যমান। এখন এগুলো নিয়ে গবেষণা চলছে। তেমনি কয়েকটি ভেষজ উদ্বিদের নাম এখানে উল্লেখ করা হলো। যেমন- দ-কলস, হাতিশুড়, বিষকাঁটালী, অগ্নিশ্বর, ভেরে-া, চিকরাশি, পান, শিয়ালমুর্তা, জয়ত্রী, আপাং, চালধোয়া, শ্বেতচন্দন, কল্পনাদ, কষ্টকারী, রক্তজবা, ওলটকম্বল, ধুতরা, বাসক, কর্পূর, আগর, রিঠা, পানবিলাস, নিশিন্দা, সর্পগন্ধা, অর্জুন, পুদিনা, তুলসি, আমলকি, নয়নতারা, রক্তকরবী, যজ্ঞডুমুর, গন্ধবাদালী, টগর, জয়তন, বেত, মহুয়া, মেহেদি, কুমারিলতা, বহেড়া, হরীতকী, দাদমর্দন, গিলা, গুলঞ্চ, ঝুমকোলতা, জয়ন্তী, তেলমাখানা, কলকে, সন্ধামালতী ইত্যাদি।
এদের কোনটি স্থানীয় কিংবা কোনটি প্রচলিত বা কোনটি অপ্রচলিত নামে ও কাজের জন্য পরিচিত। তবে এদের প্রত্যেকটি বাংলাদেশের মাটি, বায়ু ও জলে উৎপাদন উপযোগী এবং সারাদেশে সারাবছরই কোন না কোনটি পাওয়া যায়। এমন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ ওষুধি গাছের নাম হলো স্টেভিয়া। এটি চিনিগাছ হিসেবেও পরিচিত।
গবেষণায় দেখা গেছে এটি চিনির চেয়ে প্রায় তিনশ গুণ বেশি মিষ্টি। স্টেভিয়ার একটি বিশেষত্ব হলো এ মিষ্টি গাছটির পাতার রস মিষ্টি হলেও তা ডায়াবেটিস রোগীরাও খেতে পারে। এ গাছের পাতা দিয়ে চা, সেমাই, হালুয়া, মিষ্টি, পায়েস ইত্যাদি তৈরী করা যায়। এভাবে হয়তো আরো অনেক ওষুধি গাছের আলাদা আলাদা গণাগুণ বর্ণনা করা যাবে।
ঠিক এভাবে ইউনানী, আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ এগুলো চিকিৎসা একদিকে যেমন পাশর্^প্রতিক্রিয়া বিহীন এবং অন্যদিকে তেমনি কার্যকর এবং খরচও অনেক কম। সারাদেশের সবধরনের শ্রেণিপেশার মানুষ এসব চিকিৎসা সহজেই গ্রহণ করতে পারে। তবে এসব ভেষজ গাছ-গাছালি আবাদের জন্য উদ্যোগীদের নার্সারী স্থাপন করতে হবে যাতে সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু এসব চিকিৎসার নামে যাতে যেসব অপচিকিৎসা প্রচলিত চলছে সেগুলোর দিকে তীক্ষè নজর রাখতে হবে।
লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
email: [email protected]
বহুমাত্রিক.কম