Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩২, রোববার ১৮ মে ২০২৫

যান্ত্রিকতায় বিলীন ঐতিহ্যের লাঙল-জোয়াল!

মাহ্ফুজুর রহমান, রাজবাড়ী প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ১ মার্চ ২০১৫

আপডেট: ২০:২০, ৩ মার্চ ২০১৫

প্রিন্ট:

যান্ত্রিকতায় বিলীন ঐতিহ্যের লাঙল-জোয়াল!

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

রাজবাড়ী: কৃষি প্রধান বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লাঙল-জোয়াল। চিরায়ত বাংলার রূপের সন্ধান করতে গেলে এই দুই কৃষি উপকরণের কথা যেমন অবশ্যই আসবে, তেমনি আসবে হালের গরুর কথাও।

বাংলা সাহিত্যে কিংবা সঙ্গীতে গ্রামীণ জনপদের হাজারো কৃষক-কৃষাণীকে নিয়ে যতো আখ্যান রচিত হয়েছে-ওইসবের পুরোভাগে তাদের বন্দনা উৎকীর্ণ।

সভ্যতার ক্রমবিকাশের হাত ধরে যান্ত্রিকতা নির্ভর কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় অনেকখানিই উপেক্ষিত ঐতিহ্যের লাঙল-জোয়াল আর হালের গরুর ব্যবহার।

দেশের কৃষিপ্রধান অন্যান্য অঞ্চলের মতো পদ্মাপাড়ের জনপদ রাজবাড়ীর চিত্রও একেবারেই অভিন্ন। একসময় পদ্মার পলিবাহিত উর্বর এই জনপদের মানুষদের ঘুম ভাঙতো লাঙল-জোয়াল আর হালের গরুর মুখ দেখে। যন্ত্রপ্রকৌশলের আধিপত্যে এখন সেই জনপদের মানুষদের ঘুম ভাঙে হালচাষ যন্ত্র ‘ট্রাক্টর’ এর শব্দে।

স্থানীয় প্রবীণরা জানালেন, এক সময় রাজবাড়ীতে অনেক কৃষক গরু পালন করতেন শুধু হাল চাষ করার জন্য। তাজা ঘাস আর ভাতের মাড়-খৈলের ভুঁসি ইত্যাদি খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করে তোলা হালের জোড়া বলদ দিয়ে বিঘার পর বিঘা জমি চষে বেড়াতেন কৃষক।

হালচাষের জন্য ‘প্রশিক্ষিত’ জোড়া বলদের মালিককে সিরিয়াল দিতে হতো জমি চষে দেওয়ার জন্য। চাষের মৌসুমে তাদের উপরি আয়ের ব্যবস্থা হতো।

রাজবাড়ীর সদর উপজেলা মূলঘর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা মোঃ জলিল সেক (৭০)। জীবনের সিংহভাগ সময় কেটে তাঁর লাঙল-জোয়াল আর গরুর পালের সঙ্গে।

হালচাষের দীর্ঘ স্মৃতি হাতড়ে এই বয়োবৃদ্ধ বলেন, ‘আমার বয়স ৯ কী ১০ বছর হবে। ছোট বেলায় বাবা-মা মারা যায় আমার। ছোট বেলা থেকে চাচার সাথে হাল চাষের কাজ করতাম। বাড়িতে হাল চাষের বলদ গরু ছিল ২ জোড়া। চাষের জন্য দরকার হতো বলদ গরু। ১ জোড়া বলদ, কাঠ-লোহার তৈরি লাঙ্গল, জোয়াল, চঙ্গ (মই), নড়ি (বাঁশের তৈরি গরু তাড়ানো লাঠি), গরুর মুখের টোনা এই লাগতো আমাদের।’

‘প্রায় ১২ বছর হলো, শরীর খারাপের জন্যে হাল চাষ ছাইরা দিছি। খুব কষ্ট লাগে। এখন তো আর তা নাই হইছে নতুন নতুন ম্যাশিন, তাই দিয়ে এখনকার লোকজন চাষ করে’-বলেন জলিল সেক।

গরু দিয়ে হাল চাষের উপকারিতা বর্ণনা করে গোয়ালন্দ উপজেলার ছোট ভাকলা ইউনিয়নের চরবালিয়াকান্দি গ্রামের হালচাষী কৃষক ফজলু সেক (ফজো) বলেন, ‘গরু দিয়ে হাল চাষ করলে জমিতে ঘাস কম হতো, হাল চাষ করা হতো অনেক সময় গরুর গোবর সেই জমিতেই পড়তো। এতে করে জমিতে অনেক জৈব সার হতো এই জন্য ফসল ভালো হতো।’

আধুনিক চাষ পদ্ধতি পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে এই কৃষক বলেন, ‘হালের গরু গোবর আমরা বাড়ি থেকে জমিতে দিতাম। সার কেনা লাগতো কম। পরিবেশ দুষণ কম হতো। গরু গোবর দিয়ে তৈরি করা হতো ঘোষি ও পাটকুরির (পাটকাঠি) সাথে গোবর দিয়ে বুইন্দা বানানো হতো। রান্নার কাজে কাঠ এ সব ব্যবহার করতাম। কাঠ লাগতো না’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রতিদিন এক বিঘা জমি চাষ করতে পারতাম। বলদ দিয়ে চাষ করতে লাঙ্গল ব্যবহার করতে হতো। লাঙ্গল জমিতে অনেক খানি মাটির নিচ দিয়ে জমি চাষ করা যেত। উপরের মাটি নিচে পড়তো আর নিচের মাটি উপরে। এখন তো আর তা নেই। ম্যাশিনের গন্ধ সয়না শরীরে। মেশিনের ধোঁয়া আর তেল পোড়া গন্ধ শরীরের অনেক ক্ষতি করে।’

‘আমরা মাঝে মাঝে জমিতে ধনিচা চাষ করতাম। হাত খানেক লম্বা হলে আমরা লাঙ্গল দিয়ে চাষ দিতাম জমিতে। শিক্ষিত লোকের মুখে শুনছি, ধুনিচা গাছে সবুজ সার হয়। জমির জন্য উপকার’-যোগ করেন ফজলু সেক।

ধীরে ধীরে পাওয়ার টিলারের প্রচলন হওয়ায় গরু দিয়ে হাল চাষের কদর কমে গেছে জানিয়ে গোয়ালন্দ উপজেলার দেওয়ান পাড়ার কৃষক জুয়েল দেওয়ান বলেন, কম সময়ে বেশি জমিতে চাষ দিতে সক্ষম হওয়ায় জমির মালিকরা পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করে নিচ্ছে। এক সময় গরুই হাল চাষের একমাত্র মাধ্যম ছিল।

বর্তমানে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার কৃষি ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য নিয়ে এসেছে স্বীকার করে তিনি বলেন, যাঁরা কৃষক গরু দিয়ে হাল চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতো কালক্রমে তারা পেশা বদল করে অন্য পেশায় ঝুঁকেছেন।

তবে এখনো গ্রামের অনেক কৃষক জমি চাষের জন্য গরু দিয়ে হাল চাষের পদ্ধতি এখনো টিকিয়ে রেখেছেন ঐতিহ্যের লালন করতেই। তবে যান্ত্রিকতার দাপটে ঐতিহ্যের এসব কৃষি উপকরণ কতদিন টিকে থাকে কৃষকের ঘরে ভবিষ্যতই তা বলে দেবে।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer