Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪

হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন:পথ দেখাচ্ছে বিজ্ঞানাচার্যের বেঙ্গল কেমিক্যাল

ডা. সুব্রত ঘোষ

প্রকাশিত: ১৪:৫২, ১১ এপ্রিল ২০২০

আপডেট: ১৮:৪৪, ১১ এপ্রিল ২০২০

প্রিন্ট:

হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন:পথ দেখাচ্ছে বিজ্ঞানাচার্যের বেঙ্গল কেমিক্যাল

-আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ছবি-সংগৃহীত

কোভিড ১৯ ভাইরাস মোকাবিলার ভ্যাকসিনের খোঁজ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। গোটা বিশ্বের গবেষকরা করোনার প্রতিষেধক তৈরির কাজে ব্যস্ত। এই পরিস্থিতিতে মারণ ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসায় সবচেয়ে মূল্যবান হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ওষুধ। এই মুহূর্তের বহু প্রয়োজনীয় এই ওষুধটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের নাম। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালসই ভারতে সর্বপ্রথম ক্লোরোকুইন ওষুধের তৈরি করে। পরে আসে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন।

বিংশ শতকের গোড়ার দিকে স্বদেশি আন্দোলনের সময় দেশীয় শিল্পের উন্নতিসাধনেই প্রফুল্লচন্দ্র রায় গড়েছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালস। বর্তমানে যার নাম বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। ১২০ বছরের এই সংস্থাটি মাঝে বেসরকারিকরণেরও উদ্যোগ নিয়েছিল কেন্দ্র সরকার। সেই বেঙ্গল কেমিক্যালস এখন আলোচনার শীর্ষে।

মারণ ভাইরাস করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে ওষুধকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট `গেম চেঞ্জার` বলেছিলেন, সেই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে সংস্থাটি। ব্যাপক উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে তাদের। এই মুহূর্তে যা কাঁচামাল রয়েছে, তাতে ১০ লক্ষ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেটের জোগান দিতে পারবে তারা। এছাড়াও সংবাদসূত্রে জানা গেছে, ৫ লক্ষ ট্যাবলেট ইতিমধ্যেই তাদের সংগ্রহে রয়েছে। করোনার এই ভয়াবহ সময়ে গোটা দেশ তথা বিশ্বের কাছে ভরসার নাম ১৯০১ সালে তৈরি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বেঙ্গল কেমিক্যালস।

কোভিড ১৯-এর জেরে বিশ্ব হিমসিম খাওয়ার জোগাড়। এর আগে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ওষুধই যে করোনা ভাইরাস রুখতে `গেম চেঞ্জার`-এর ভূমিকা নিতে পারে, তা জানিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি বলেছিলেন, `আমরা খুবই ভাল ফল পেয়েছি। আশাকরি, ওই ড্রাগ শিগগিরই সহজলভ্য হবে। ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) বলছে দারুণ কাজ করেছে। অনুমোদন প্রক্রিয়া চলছে।`

মার্কিন মুলুকে করোনার প্রভাবে তৈরি হয়েছে সঙ্কটজনক পরিস্থিতি। এই অবস্থায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্যে অনুরোধ করে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন সরবরাহের কথা বলেছেন তিনি। আজ গোটা বিশ্বের নজর যে ওষুধের দিকে তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার নাম; জড়িয়ে রয়েছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের নাম।

এই হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন কি?

• হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন; ক্লোরোকুইনেরই কম টক্সিক ভার্সন। এই ওষুধ লুপাস ও আর্থারাইটিস রোগীদের উপরও ব্যবহার হয়। ইদানিং করোনা চিকিৎসায় এর প্রয়োগে; ইতিবাচক ফল মিলেছে বলে দাবি চিকিৎসকদের।

• হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও ক্লোরোকুইন- দুটিই কুইনিন থেকে তৈরি।

• এটি প্রথম পেরু থেকে আমদানি করা হয়। পেশির আরামের জন্য ব্যবহার হত। এর সঙ্গেই, সিঙ্কোনা গাছের ছালের গুঁড়ো মিশিয়ে; তার সঙ্গে মিষ্টি জল দিয়ে তৈরি হত এক জাতীয় টনিক। তাতে তিতকুটে স্বাদ কিছুটা কমত।

• ১৯৩৪ এ জার্মান গবেষকরা সিন্থেটিক ক্লোরোকুইন তৈরি করেন। ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবেই এর ব্যবহার হত। এরই কম টক্সিক ভার্সন হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন।

করোনা রোগীদের উপর হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন ব্যবহার করে উপকার মিলেছে বলে ভারত থেকে এখন এই ওষুধ আমদানি করার কথা ভাবছে আমেরিকা। আগেই বাজারে ঘাটতি আটকাতে এই ধরনের ওষুধ বিদেশে রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভারত সরকার। কিন্তু এর পরই বিধি শিথিল করে ভারত জানায়; করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমাণ হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন রফতানি করা হবে।
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নামক এই ওষুধ নিয়ে এই মুহুর্তে গোটা বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে ভারতের দিকে। সেই ওষুধের উৎপত্তিস্থল আসলে কোথায়? গোটা ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বপ্রথম পশ্চিমবঙ্গেই তৈরি হয় ক্লোরোকুইন ওষুধ যা থেকে পরবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছে হাইড্রক্সি-ক্লোরোকুইন। আর তা প্রথম তৈরি হয় ঐতিহ্যশালী বেঙ্গল কেমিক্যালসে।

বেঙ্গল কেমিক্যাল তৈরির করতে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে শুনতে হয়েছিল ধর্মের হুমকি
যে বেঙ্গল কেমিক্যাল আজ আলোচনার কেন্দ্রে, যে বাঙালির প্রতিষ্ঠান নিয়ে তোলপাড় ভারত। খোঁজ খোঁজ রব, যার প্রতিষ্ঠানে তৈরি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন সেই মানুষটি অর্থাৎ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের উপরেও পড়েছিল ধর্মের গোঁসা।

কারণ তিনি যে মেডিসিন ড্রাগ তৈরির চেষ্টা করছিলেন তা তৈরি করতে তিনি গরুর হাড় ব্যাবহার করেছিলেন। শিল্প ও চিকিৎসাকে এক জায়গায় দেখতে চেয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সেই জন্য তিনি প্রথমে সাইট্রিক অ্যাসিড বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। পরে সাজিমাটি থেকে সোডিয়াম কার্বোনেট। কিন্তু সব জায়গাতেই অন্য দেশের বিপুল ব্যাবসা ছিল ভারতে। প্রথমেই বুঝে গিয়েছিলেন এমন করলে হবে না।

একদম নিজস্ব কিছু করতে চেয়েছিলেন, সেই ভাবনা থেকেই ফসফেট অব সোডা এবং সুপার ফসফেট অব লাইম বানানোর চেষ্টা করলেন। আর সেখানেই তিনি পড়লেন ধর্মের রোষের মুখে। ফসফেট অব সোডা আর সুপার ফসফেট অব লাইম বানানোর প্রধান উপকরন গবাদি পশুর হাড়। তখনকার মত কাজের জন্য প্রফুল্লচন্দ্রর ১০-১৫ মন হাড়ের প্রয়োজন ছিল। তাঁর বাড়ির পাশেই রাজাবাজার এলাকায় কসাইয়ের দোকান থেকে কয়েক বস্তা গরুর হাড় সংগ্রহ করেছিলেল। তিনি এই হাড় তাঁর বাড়ির ছাদে শুকোতে দিতেন।

সময়টা শীতকাল। এমনিতে এই সময় বাংলায় বৃষ্টি খুব একটা হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই বছর জানুয়ারি মাসে টানা পনেরো দিন বৃষ্টি হয়েছিল। ফলে হাড়ের সংলগ্ন মাংস পচে দুর্গন্ধ বেরোতে লাগল। পচা মাংসে সুতোর মত পোকাও দেখা দিল। তার ওপর শুরু হল ঝাঁকে ঝাঁকে কাকের উপ্রদ্রব। তারা মহানন্দে পচা হাড় আর পোকা খেতে শুরু করল। হাড় নিয়ে টানাটানিতে কাকের দল সেগুলো আশপাশের বাড়িগুলোর ছাদেও ছড়াতে লাগল। পাশেই ছিল হিন্দুপল্লী। তারা প্রফুল্লচন্দ্রকে স্পষ্ট নোটিশ জারি করল, গরুর হাড় ছাদ থেকে স্বেচ্ছায় সরানো না হলে তারা সরকারী সাহায্য নিতে বাধ্য হবে।

শেষকালে এক নাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবসায়ী প্রফুল্লচন্দ্রকে সাহায্য করলেন। এই ব্যবসায়ীর মানিকতলার এক জমিতে হাড়গুলি একত্রিত করে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। মধ্যরাতে হাড়ের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। এতে স্থানীয় পুলিশ অফিসারের হল চক্ষুশূল। তিনি মাঝরাতে আগুন জ্বলতে দেখে কোন কুকর্মের গন্ধ পেয়েছিলেন। অনেক কষ্টে তাকে বোঝান গেল ব্যাপারটা কি। সবশেষে হাড় ভস্মতে সালফিউরিক অ্যাসিড যোগ করে সুপার ফসফেট অব লাইম বানান গেল। সেখান থেকে সোডার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয় ফসফেট অব সোডা।

তবেই এই ঘটনায় প্রফুল্লচন্দ্র কিছুটা উৎসাহ পেয়েছিলেন। তিনি আরও পুরোদমে কাজ করেছিলেন। তিনি দেখলেন যে তাঁর তৈরি সিরাপ অব আওডাইড অব আয়রন কিছুদিন পরেই একটু হলুদ হয়ে যায়। অথচ বিদেশ থেকে আনা সেই একই জিনিস অনেকদিন হালকা সবুজ থাকে।

এই সমস্যার সমাধান তিনি পেলেন ওই সিরাপের সাথে সামান্য হাইপো ফসফরাস যোগ করে। এভাবে তিনি বিভিন্ন ‘Trade Secret’ নিজেই উদ্ভাবন করতে লাগলেন। অবশেষে তার তৈরি রাসায়নিক ও ওষুধ বাজারে ছাড়ার সময় হয়। প্রতিষ্ঠা হয় ‘Bengal Chemical and Pharmaceutical Works’। (তথ্যসূত্র: আত্মচরিত, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।)

বেঙ্গল কেমিক্যাল -এর অবদান

১৯১৪ সাল, ইউরোপের মাটিতে বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। ২৮ জুন, ১৯১৪ গ্যাভ্রিলো প্রিন্সেপ নামে এক বসনিয়ান অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সাম্রাজ্যের এক উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দকে সারাজেভোতে খুন করল। ঘটনা ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠতে উঠতে ঘনিয়ে এল যুদ্ধের কালো ছায়া। বলকান অঞ্চলের দুটি দেশের মধ্যে সংঘর্ষে ইউরোপের মহা শক্তিধর দেশগুলোর জড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না একটুও। শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পক্ষে জার্মানি এবং ইটালি। অন্যপক্ষে ফ্রান্স রাশিয়া এবং ব্রিটেন। এই যুদ্ধ ছিল তখনও পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসের রক্তাক্ততম যুদ্ধ। ব্রিস্টল, ফকার, সিমেন্স, হ্যান্ডলি, গোথা নামের যুদ্ধবিমানগুলো থেকে ফেলা বোমার দৌলতে মৃত এবং আহতের পরিমাণ বাড়তে লাগল হু হু করে।

এর সঙ্গে বুলেট, মাইন, কামান ট্যাঙ্কের গোলায় মৃত্যু তো আছেই। রণানঙ্গনে যাদের মৃত্যু হল তারা নয় মুক্তি পেয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াল হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ আহত সৈনিক এবং সাধারণ মানুষ। বোমার আঘাতে ঝলসে যাওয়া মানুষে ভরে উঠল হাসপাতালের পর হাসপাতাল। মৃত্যুযন্ত্রণা, আর্তনাদে বিদীর্ণ হয়ে গেল বাতাস। দগ্ধে দগ্ধে মরতে লাগল অগুণতি মানুষ। এইভাবে শক্তিক্ষয় ব্রিটেনের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াল। খোঁজ পড়ল এমন কোনো ওষুধ আছে কি যা মানুষগুলোর যন্ত্রণা লাঘব করতে পারে, সারিয়ে তুলতে পারে। ফিরিয়ে দিতে পারে স্বাভাবিক জীবনে। মনে রাখতে হবে তখনও পৃথিবী অ্যান্টিবায়োটিক শব্দটাই শোনেনি।

খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে ওষুধ মিলল। মিলল ব্রিটিশের গর্বের উপনিবেশ, লন্ডন অফ দ্য ইস্ট কলকাতার এক ওষুধ উৎপাদক কারখানায়। নাম তার বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস। শহরের পূর্ব প্রান্তে আদিগন্ত জলাভূমি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নের শিক্ষক, এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। এই কারখানার পিছনে রয়েছে অদম্য মানুষটটির সারা জীবনের উপার্জন এবং জ্ঞানভাণ্ডার। প্রথমে নিজের বাড়িতেই বসিয়েছিলেন কারখানা। একা হাতে তৈরি করতেন ওষুধ। সঙ্গী ছিল একমাত্র পরিচারক গফুর। নিজের তৈরি ওষুধ বিক্রি করতে ঝোলায় ওষুধ ভরে ঘুরেছেন কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়। কেউ পাত্তা দেয়নি।

বিলিতি ওষুধ ছেড়ে বিলেতফেরত প্রফেসরের ওষুধ রাখতে রাজি হয়নি কোনো ওষুধের দোকান (কীভাবে বেঙ্গল কেমিক্যাল জনপ্রিয় হল সে গল্প অন্য কোনোদিন বলা যাবে)। এই সংগ্রামে অবশ্য তিনি পাশে পেয়েছিলেন কিছু শিক্ষিত উদারমনা নিঃস্বার্থ বাঙালিকে। যেমন কলকাতা মেট্রোপলিটান কলেজে (এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজ) তাঁর সহপাঠী এবং এম বি ডিগ্রিধারী ডাক্তার অমূল্যচরণ বোস এবং তাঁর ভগ্নীপতি, ১৮৯০ সালে রসায়নে এম এ পাশ সতীশচন্দ্র সিংহকে। এঁদের যোগদানে বেঙ্গল কেমিক্যাল দ্রুত গতিতে ব্যবসা বাড়াতে লাগল। কিন্তু ঠিক তখনই ঘটল অনর্থপাত। সতীশচন্দ্র একদিন কাজ করছিলেন হাইড্রোজেন সায়ানাইড নিয়ে। অসাবধানে সায়ানাইড-সংক্রমিত গ্লাসে জল খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

প্রফুল্লচন্দ্র বেরিয়েছিলেন বৈকালিক ভ্রমণে। ফিরে এসে ডাক্তার ডাকলেন। নিয়ে গেলেন মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু সতীশচন্দ্রকে বাঁচানো গেল না (১৮৯৪)। আচার্য চোখে অন্ধকার দেখলেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরে ঘনিয়ে এল আরেক বিপদ। বিউবোনিক প্লেগের রুগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেই রোগাক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারালেন অমূল্যচরণ। এর পরে আচার্য রায় পাশে পেয়েছিলেন কলকাতার আরেক স্বনামধন্য ডাক্তার আমহার্স্ট স্ট্রিটের কার্তিকচন্দ্র বোসকে। তখন মানিকতলার কারখানা সবে গড়ে উঠছে। কিন্তু কলকাতা থেকে সেখানে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। ডাক্তার বোসের মাথায় এক বুদ্ধি খেলল।

তিনি কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির ঝাড়ুদারদের বললেন মানিকতলা মোড় থেকে তারা যদি বেঙ্গল কেমিক্যালের দিকে ময়লা ফেলতে ফেলতে যায় তবে তিনি বিনামূল্যে তাদের চিকিৎসা করবেন। তাদের ফেলা ময়লা জমাট বেঁধেই জলাভূমির উপর তৈরি হল রাস্তা— যাকে আজ আমরা বলি মানিকতলা মেইন রোড। এইরকম অজস্র ইতিহাস পাথেয় করে বেড়ে উঠেছিল বাঙালির গর্বের প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল কেমিক্যাল।

১৯০২ সালে এই কারখানায় যোগ দেন তরুণ রসায়নবিদ রাজশেখর বসু। একবছরের মধ্যেই কারখানার ম্যানেজার। প্রফুল্লচন্দ্রের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। হাসিমুখ, প্রীতিপূর্ণ কণ্ঠস্বর। তিনিই বানালেন পোড়ার এক অব্যর্থ ওষুধ। কতিলা আঠার (Tragacanth mucilage) সঙ্গে ট্যানিক অ্যাসিডের মিশ্রণ। কতিলা মধ্যপ্রচ্য থেকে এসেছিল এই দেশে। রাজশেখর নতুন ওষুধের নিজেই নামকরণ করলেন ‘ট্যানোলেপ’। বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রায় সমস্ত উৎপাদনের নাম, প্যাকেজিং, বিজ্ঞাপন নিজে হাতে করতেন রাজশেখর।

সঙ্গী ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু চিত্রশিল্পী যতীন্দ্রকুমার সেন। ওরফে নারদ। পরবর্তীকালে রাজশেখর অর্থাৎ পরশুরামের অধিকাংশ গল্প এবং বইয়ের অলঙ্করণ করেছিলেন নারদ। ট্যানোলেপ লাগালে ফোস্কা পড়ে না। ফলে ঝলসানো রুগীর ট্রমাও অনেক কম হয়। ইংরেজ সরকার বেঙ্গল কেমিক্যালের থেকে ৬ লক্ষ টাকার ট্যানোলেপ কিনেছিল। সংখ্যাটা খেয়াল করবেন, ৬০০০০০। অনুমান করুন কত লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছিল এই ওষুধ। বলা চলে ট্যানোলেপের সাফল্যের কারণেই আচার্য রায়কে ১৯১৯ সালে নাইটহুড দিয়ে সম্মান জানায় ব্রিটশ সরকার।

বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, মহেন্দ্রলাল সরকার প্রমুখ বাঙালি নবজাগরণের দূতদের উত্তরাধিকারী ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র বা রাজশেখরের মত মানুষরা। কুসংস্কার এবং ধর্মের কারা ভেঙে কীভাবে তারা নিজেদের যুক্ত করেছিলেন বিশ্বজনীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্রোতে সে এক অসম্ভব ‘সুন্দর’ গল্প যা প্রত্যেকটা বাঙালির জানা উচিত। এটাও জানা দরকার যে আমরা আজ সেই চর্চায় পিছিয়ে পড়েছি কেন? তাদের উত্তরাধিকার আমরা বহন করতে পারিনি কেন? কীভাবে পরাজিত হলেন এই মহানায়করা? সে এক অসম্ভব ‘যন্ত্রণার’ গল্প। সে গল্প অদ্যন্ত রাজনৈতিক। সমাজে রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকলে বিজ্ঞানচর্চা যে নিম্নগামী হয় এ তারই উদাহরণ। সে গল্প বারান্তরে করা যাবে।

আজ করোনার বদৌলতে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন এবং বেঙ্গল কেমিক্যাল নিয়ে সোসাল মিডিয়ায় আলোচনা চলছে, চলছে ইতিহাসকে ফিরে দেখার চেষ্টা। করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় বিনীদ্র রাত কাটাচ্ছেন দেশবিদেশের অসংখ্য বিজ্ঞানী। তাঁদেরকে সম্মান জানাই । (তথ্যসূত্রঃ সাম্পান, রাজশেখর বসু সংখ্যা।)

নজরুলকে জাতীয় কবিরূপে সংবর্ধনা জ্ঞাপনে

ঋষিতুল্য বিজ্ঞানসাধক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বহুমাত্রিক প্রতিভার সঙ্গে বহু কারণেই তিনি বাঙালির হৃদয়ে চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবেন। সমাজসংস্কারক এই সাধক বিজ্ঞানী শিল্পসাহিত্যেরও সমান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ যাবে জাতীয় কবিরূপে অভিষিক্ত করেছেন সেই কাজী নজরুল ইসলামকে তাঁর ত্রিশ বছর রয়েছে জাতীয় কবিরূপে যাঁরা বরণ করেছিলেন তাদের পুরোভাগে ছিলেন এই বিজ্ঞানাচার্য।

কলকাতার ঐতিহাসিক এলবার্ট হলে জাতির পক্ষ থেকে দেওয়া নজরুল সংবর্ধনায় সভাপতিরূপে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সানুগ্রহ উপস্থিতি ওই আয়োজনকে যে মর্যাদাদান করেছিল তা বাংলাসাহিত্যের তো বটেই, বাঙালির চিরকালীন ইতিহাসেও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

সাহিত্য সাময়িকী কালি ও কলম এ প্রকাশিত ফেরদৌস আরা আলীমের এক নিবন্ধে এ সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক অনৈক তথ্য আমরা পাব। প্রাবন্ধিক লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মধর্মের সমাজকল্যাণব্রতে উৎসর্গীকৃতপ্রাণ প্রফুল্লচন্দ্র রায় জাতিভেদ প্রথার উচ্ছেদ, সামাজিক বৈষম্য-বিলোপ ও নারী জাতির কল্যাণসাধনে ব্রতী ছিলেন। নজরুলের সাহিত্যে এসব প্রগতিশীল চিন্তার অনুবর্তন দেখে তিনি নজরুলের গুণগ্রাহী হয়ে উঠেছিলেন। নজরুল জাতীয় সংবর্ধনা পাওয়ার উপযুক্ত কিনা বিশেষভাবে মোহাম্মদী পত্রিকাকেন্দ্রিক সাহিত্যিকবৃন্দ এ-প্রশ্ন তুলেছিলেন। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যখন যথেষ্ট বাদানুবাদ হচ্ছে তখন প্রফুল্লচন্দ্র রায় টেলিফোনে আয়োজকদের জানান যে, ‘আমাদের জাতীয় জাগরণের জন্য তাঁর মতো করে আর কোনো কবি আজ পর্যন্ত লিখতে পারেননি। সংবর্ধনার ব্যাপারে আমি তোমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্ত্তত আছি।’ (আজহার উদ্দিন খান, ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’)

‘‘সংবর্ধনা সভার প্রারম্ভিক ভাষণে তিনি বলেন, ‘নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাংলার কবি।… কবিরা সাধারণত কোমল ও ভীরু কিন্তু নজরুল তা নন। কারাগারের শৃঙ্খল পরে বুকের রক্ত দিয়ে তিনি যা লিখেছেন তা বাঙালির প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগিয়ে তুলেছে।’ প্রাত্যুত্তরিক ভাষণে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রতি কবি যে-ভাষায় সম্মান প্রদর্শন করেন তাতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, তাঁর প্রতি কোনো ধরনের অপমান-অসম্মান, বিদ্বেষ বা বিরুদ্ধাচরণ কিছুই আর তাঁকে বিচলিত করে না। তিনি বলেন, ‘আমি পলাতক বলেই যদি আমায় ধরে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করে থাকেন তাহলে আপনাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছে কলঙ্ক চাঁদকে ধরে এনে তাকে যথেষ্ট লজ্জা দিয়েছেন।’ অতঃপর তিনি কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ়কণ্ঠে বলেন যে, ‘যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি না কেন সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’’

এলবার্ট হলে নজরুল সংবর্ধনার ওই আয়োজনে বাঙালির গৌরব মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর উপস্থিতি আয়োজনের সকলের আদর্শিক সংহতি ও দেশমাতৃকার প্রতি অপরিসীম দায়বদ্ধতাকেই জানান দেয়।

বিজ্ঞানার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সম্পর্কে

২ আগস্ট বাঙালি তথা ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের অগ্রনায়ক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মদিন। ১৮৬১ সালে বাংলাদেশের খুলনা জেলার রাড়ুলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান বিজ্ঞানসাধক। পিতা ছিলেন বহুভাষাবিদ, সুপণ্ডিত, সমাজসেবী ও বিদ্যোৎসাহী হরিশচন্দ্র রায়চৌধুরী এবং মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। জমিদার পরিবারে জন্ম হলেও, তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সাধারণ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত।
১৮৭৯ সালে তিনি কোলকাতার আলবার্ট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েন। ১৮৮২ সালে গিলক্রাইস্ট বৃত্তি নিয়ে লন্ডন থেকে বি.এস.সি পাশ করেন। ১৮৮৭ সালে রসায়ন শাস্ত্রে মৌলিক গবেষণার জন্যে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.এস.সি ডিগ্রী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হোপ পুরষ্কার লাভ করেন।

১৮৮৯ সালে কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং পরাধীন ভারতবর্ষের বিজ্ঞান শিক্ষায় মনপ্রাণ সমর্পণ করেন। পরে তিনি এই বিভাগেই ১৯১১ সালে বিভাগীয় প্রধান এবং অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ১৯০১ সালে `বেঙ্গল কেমিক্যাল এবং ফার্মাসিটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড` -এর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলায় প্রথম সার্থক রাসায়নিক দ্রব্য এবং ওষুধের কারখানা স্থাপন করা।

বিজ্ঞানে বহু মৌলিক আবিষ্কারের কারণে তিনি বাংলা এবং ভারতে তাঁর সমসাময়িক প্রায় সকল বিজ্ঞান সভার সভাপতিত্ব করেন। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বিশেষ করে রসায়ন শাস্ত্র ছাড়াও তিনি বহু সামাজিক সমস্যায় আমাদের করণীয়, বর্জনীয় বিষয় নিয়ে লিখে গিয়েছিলেন আমৃত্যু। বিজ্ঞান, অর্থনৈতিক, সমাজভাবনা, সাহিত্য, শিল্প, শিক্ষা, আত্মবিক্ষা, রাজনীতি, রবীন্দ্রনাথ, প্রকৃতি ও পরিবেশ; কি নেই তাঁর লেখায়! (এ বিষয়ে আগ্রহীরা পড়তে পারেন দে`জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত পিনাকপাণি দত্ত এবং শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রবন্ধসংগ্রহ। ৫৯১ পৃষ্ঠার অসাধারণ একটি বই।)

তাঁর গবেষণার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তিরূপে ধরা হয় প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাসের গ্রন্থ - `হিস্ট্ররি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি (দুই খণ্ডে)` এ অমূল্য গ্রন্থটি। একবুক বিস্ময় নিয়ে এ বইটি পড়লাম। অবাক হলাম যে ১৯০২ সালে তিনি এ বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন; কিন্তু আজ ২০২০ তে এসেও এ বই আমাদের হাতের সীমানার বাইরে! এ বইয়ের প্রত্যকটি তথ্য জানা আমাদের একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু এ সকল প্রাচীন গৌরবের তথ্য জানিনা বলেই, আমরা বাঙালিরা দিনে দিনে হতচ্ছাড়া, লক্ষ্মীছাড়া হয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রাচীন গৌরব যদি সঠিকভাবে নাই জানি, তবে আমাদের মধ্যে স্বাভিমান, আত্মশ্লাঘাবোধ জাগবে কি করে?

বাংলায় রসায়নের চর্চার আকাঙ্ক্ষায় তিনি ১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দুইলক্ষ টাকা দান করেছিলেন। সেই সময়ের দুইলক্ষ টাকা আজ হয়তো তা কয়েকশো কোটি টাকা হবে। ভাবা যায়!

সারা জীবনব্যাপী বাংলা মায়ের সেবা করেছেন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। কিন্তু আজ বলতে খুব খারাপ লাগছে যে, তাঁর মাতৃভূমি এই বাংলাদেশে তিনি কি তাঁর যোগ্য সম্মান পেয়েছেন? এতো কাজের পরেও কেন তিনি তার মাতৃভূমিতে অবহেলিত! যিনি এদেশে বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রনায়ক, তাঁর নামে কি দেশে এতোগুলো বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটিরও নামকরণ করা যেত না! অথবা তাঁর নামে সামান্য একটা হলেরও তো নামকরণ করা যায়! প্রশ্ন রইলো সবার প্রতি।

তাঁর আবিষ্কার কে সহজেই আমরা গ্রহন করেছি, কিন্তু তার মতাদর্শ কে সহজে নিতে পারি না। তাঁর একটি উদ্ধৃতি দিয়েই বলি। একবার প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন, "আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম, যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পড়িয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ।"

যতদিন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের মতো দেবতুল্য ব্যক্তিরা তাঁদের যোগ্যসম্মান না পেয়ে, অবহেলার ধুলোতে পরে থাকবে; ততোদিন এ জাতি, এ দেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

লেখক: চিকিৎসক, কলামিস্ট, সংগঠক ও সমাজকর্মী।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer