ছবি : ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশন
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে তাঁর দেশের অর্থায়নে চালু হওয়া নতুন মুক্তিযোদ্ধা বৃত্তি প্রকল্পের আওতায় পরবর্তী ৫ বছরে ১০,০০০ শিক্ষার্থীকে স্নাতক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বৃত্তি প্রদান করা হবে।
তিনি জানান, এই উদ্দেশ্যে ৩৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। পুরাতন এবং নতুন প্রকল্পগুলি একত্রিত হলে, ভারত সরকারের দ্বারা মুক্তিযোদ্ধা বৃত্তি প্রকল্পের জন্য মোট ৫৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।
শনিবার বরিশালের শের-এ-বাংলা মেডিকেল কলেজে ‘মুক্তিযোদ্ধা বৃত্তি চেক বিতরণ’ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানান হাই কমিশনার। বরিশালে বৃত্তির চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে বরিশাল বিভাগের ১২০ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তির চেক হস্তান্তর করা হয়। এর মধ্যে স্নাতক স্তরের শিক্ষার্থীদের ৫০,০০০ টাকা এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ২০,০০০ টাকা বৃত্তি প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ অভিন্ন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশীদার এবং একসাথে যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ত বিসর্জন করেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম প্রচেষ্টায় মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করেছিল এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী তাঁদের লক্ষ্য অর্জনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বীরোচিত প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ, ভারত সরকার কয়েকটি পদক্ষেপ ও প্রকল্প চালু করেছে। মুক্তিযোদ্ধা বৃত্তি প্রকল্পটি এমনই একটি উদ্যোগ যা ২০০৬ সালে চালু হয়েছিল। এই প্রকল্পের আওতায় ১২ হাজার ৬২১ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে এবং ২১ কোটি টাকার একটি তহবিল ব্যবহার করা হয়েছে।’
হাই কমিশনার বলেন, ‘আপনারা স্মরণ করতে পারেন যে, ২০১৭ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে তিনটি উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। যা হচ্ছে-নতুন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান বৃত্তি প্রকল্প, অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও সকল মুক্তিযোদ্ধার জন্য পাঁচ বছরের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা।’
প্রতিশ্রুত সেসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, ‘২০১৭ সালে নতুন মুক্তিযোদ্ধা বৃত্তি প্রকল্প চালু হয়। এই প্রকল্পের আওতায় পরবর্তী ৫ বছরে ১০,০০০ শিক্ষার্থীকে স্নাতক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বৃত্তি প্রদান করা হবে এবং এই উদ্দেশ্যে ৩৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। পুরাতন এবং নতুন প্রকল্পগুলি একত্রিত হলে, ভারত সরকারের দ্বারা মুক্তিযোদ্ধা বৃত্তি প্রকল্পের জন্য মোট ৫৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।’
তিনি জানান, ভারতীয় হাই কমিশন ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী ও রংপুরে একই ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে এবং ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সিলেটেও চেক বিতরণ অনুষ্ঠিত হবে। আমি আনন্দের সাথে ঘোষণা করছি যে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য বৃত্তিপ্রার্থীদের তালিকা তৈরির কাজটি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে এবং এ প্রকল্প ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে।
ভারত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নতি ও কল্যাণের জন্য ভারত সরকার সন্নিহিত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে-জানিয়ে বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারতের এই কুটনীতিক আরও জানান, ১০০ জন অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা লাভ করবে। এ প্রকল্প অনুমোদন হয়ে গেছে এবং খুব শিগগির অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাগণ ভারতে যাওয়া শুরু করবেন। মেডিকেল প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের সকল জেলা থেকে ১০০ অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাকে বাছাই করেছে। এটি একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া ছিল যেখানে জেলা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিগণ একসাথে অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করেছে। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ তালিকা চূড়ান্ত করেছে এবং শিগগির অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাগণ ভারতে চিকিৎসা সেবা লাভ করা শুরু করবেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঁচ বছরের ভিসার সুযোগ সৃষ্টির প্রসঙ্গে হাই কমিশনার বলেন, ‘ভারত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘পাঁচ বছরের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা’ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন এবং এ পর্যন্ত ১৩৬১ জন মুক্তিযোদ্ধা এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। এ প্রক্রিয়ার সুবিধার্থে অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসেবে ভিসা আবেদন জমাদানের জন্য আলাদা কাউন্টারের ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। আজকে আমি খুবই আনন্দিত কারণ এ সকল প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে।’
ভারত সরকারের অন্যান্য উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে হাই কমিশনার বলেন, ‘‘ভারত সরকার নাগরিকদের সুবিধার্থে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। ভারতীয় হাই কমিশন এই ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প অনুযায়ী উল্লিখিত উদ্যোগগুলি বাস্তবায়ন করবে। পরবর্তী বছর থেকে, বৃত্তির পরিমাণ ভারতের সরকারের ‘ডিরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার’ এবং `জন ধন যোজনা` প্রকল্প অনুযায়ী তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি হস্তান্তর করা হবে। এই প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হলে সুবিধাভোগীকে তাৎক্ষণিক অর্থ প্রদান নিশ্চিত হবে এবং এ কাজে সময় ও শ্রম লাঘব হবে। অডিটোরিয়ামে ভারত সরকারের অন্যান্য ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্পসমূহ প্রদর্শিত হয়েছে।’’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘আমি খুলনা ও কলকাতার মধ্যে একটি অতিরিক্ত রেল সংযোগ চালু করার কথা উল্লেখ করতে পেরে আনন্দিত। এই দুটি স্টেশনকে সংযোগকারী ট্রেনটির নাম ‘বন্ধন এক্সপ্রেস। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এই ট্রেনটি অতীতে ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’নামে পরিচিত ছিল। এই রেল সংযোগটি ১৮৮৪ সালে চালু হয় এবং ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে, এটি যুদ্ধের পরে বন্ধ হয়ে যায়। এটি ২০১৭ সালের নভেম্বরে ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’নামে পুনরায় চালু হয়। রেল সংযোগটি আমাদের দু’দেশের দু’টি শহরের মাঝে ঐতিহাসিক সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে।’
‘আমি এটি ও ঘোষণা করতে পেরে আনন্দিত যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’ এবং ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’ নামক রেল সংযোগগুলোতে বিরতিহীন ইমিগ্রেশন সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মানে আপনি বাংলাদেশে ইমিগ্রেশন আনুষ্ঠানিকতা শেষে ট্রেনে উঠার পর সীমান্তে কোন প্রকার বিরতি ছাড়াই ভারতে আপনার গন্তব্যস্থলে সরাসরি নেমে যেতে পারবেন, যেটা পূর্বে চালু ছিল। এটি ভ্রমণ সময় হ্রাস করেছে এবং যাত্রার সুবিধা বৃদ্ধি করেছে’-যোগ করেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কল্যাণমূলক উদ্যোগ বাস্তবায়নকালে আমরা বাংলাদেশের সব জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। আমি হাই কমিশনকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করতে সহযোগিতা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া আমাদের পক্ষে প্রান্তিক অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। আমাদের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে যারা সমর্থন করেছেন তাদের প্রতি আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মুক্তিযোদ্ধা একাডেমি ট্রাস্ট, যারা সফলভাবে হাই কমিশনকে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছে।’
দু’দেশের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করে হর্ষ বর্ধন বলেণ শ্রিংলা বলেন, ‘১৯৭১ সালের ভারত ও বাংলাদেশ একসাথে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জনের গৌরবের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারী, যেখানে দুই দেশের সেনাবাহিনী সমন্বিত ভাবে লড়াই করেছে এবং একই শত্রুকে পরাজিত করেছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান এবং আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দিই এবং সম্মান করি। আপনারা আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং আমরা আপনাদের `মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বজায় রাখার` ভূমিকার প্রশংসা করি।’
তিনি আশপ্রকাশ করে বলেন, ‘আজ যাঁরা বৃত্তি পাচ্ছেন, আপনারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এবং তাঁদের গৌরবের উত্তরাধিকার বহন করার জন্য গর্ব হওয়া উচিত। এটি একটি অনন্য গৌরব যা তাঁদের ঐতিহ্য এবং চেতনাকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বহন করে। আমি নিশ্চিত যে, আপনারা সবাই উভয় দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে শুভেচ্ছাদূত হিসেবে প্রতীয়মান হবেন।’
অনুষ্ঠানে বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ, মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ, মুক্তিযোদ্ধা একাডেমি ট্রাস্ট এর চেয়ারম্যান ড. আবুল আজাদ প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।