Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৪ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪

সৌদি গমনেচ্ছুদের পাঁচ ধরণের সমস্যা

বহুমাত্রিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ২২:০১, ৯ অক্টোবর ২০২০

প্রিন্ট:

সৌদি গমনেচ্ছুদের পাঁচ ধরণের সমস্যা

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে গত ২৫শে মার্চ থেকে সৌদি আরব সরকার সব দেশের সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এতে করে বাংলাদেশে আটকা পড়েন ছুটি কাটাতে আসা বহু প্রবাসী কর্মী।

আবার চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত শুধু সৌদি আরবের ৭৭,৪০০ নতুন ভিসার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছিল। এসব ভিসার মেয়াদ তিন মাস হওয়ার কারণে ইতিমধ্যে সব ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।

সম্প্রতি লকডাউন উঠে যাওয়ার পর সৌদি আরবে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতেই নানা ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হন প্রবাসে গমনেচ্ছুরা। সৌদি আরবে যেতে ইচ্ছুক এমন কয়েকজন প্রবাসী জানিয়েছেন তাদের পাঁচটি সংকটের কথা।

ভিসার মেয়াদ নবায়নে জটিলতা

প্রায় ১২ বছর ধরে সৌদি প্রবাসী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। পরে করোনাভাইরাসের কারণে সৌদি সরকার সব দেশের সাথে বিমান চলাচল বন্ধ করে দিলে তিনি বাংলাদেশে আটকা পড়ে যান। এরই মধ্যে শেষ হয়ে যায় তার ভিসার মেয়াদ।

এখন নতুন করে ভিসার সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেন তাকে পাসপোর্টের সাথে নিয়োগকর্তা বা কফিলের রিক্রুটিং এজেন্সির নামে আসা পাওয়ার অব অ্যাটর্নির সনদ, বিএমইটি থেকে নিবন্ধন পত্র জমা দিতে হবে। সেইসঙ্গে ঢাকার অনুমোদিত কেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ এমনকি বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকার পরেও আলাদা করে পুলিশের ছাড়পত্র দিতে হবে।

এত কাগজপত্র জোগাড় করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে রফিকুল ইসলাম এবং তার মতো আরও অনেক প্রবাসীকে। এই ভিসা নবায়ন করতে সৌদি দূতাবাস যেসব নির্দেশনা দিয়েছে, সেগুলো অনেক সময়স্বাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল বলে জানিয়েছে বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী।

এ কারণে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কর্মীকে সৌদি আরবে পাঠানো রীতিমত অসম্ভব বলে তিনি জানিয়েছেন। এই বিপুল সংখ্যক কর্মীর ভিসা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে সেটা নিয়ে বিপাকে পড়েছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোও।

এদিকে টাঙ্গাইলের আরেক বাসিন্দা রকিবুল ইসলাম তার কোম্পানির কফিলের কাছে অনুরোধ করে ভিসার মেয়াদ ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একবার বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তিনি টিকেট না পাওয়ায় যেতে পারেন নি।

পরবর্তীকালে এই মেয়াদ আরেক দফা বাড়াতে অস্বীকৃতি জানায় তার কফিল। এই অবস্থায় সৌদি আরবে থাকা বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের সাহায্য নিয়ে ২০০ রিয়েল খরচ করে তিনি আরও এক মাসের জন্য ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে নেন।

কিন্তু টানা কয়েকদিন সকাল থেকে বিকেল লাইনে দাঁড়িয়েও টিকেট পাননি তিনি। এমন অবস্থায় শেষ এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায় কিনা সেই শঙ্কায় আছেন মি.ইসলাম।

পাসপোর্ট নবায়নে অতিরিক্ত টাকা দাবি

রফিকুল ইসলামের কোম্পানির নিয়োগকারী কর্মকর্তা তাকে পুনরায় সৌদি আরবে কাজ দেয়ার আশ্বাস দিলেও তার পাসপোর্টের মেয়াদ না থাকায় তিনি ভিসা নিতে পারছেন না।এখন জরুরি ভিত্তিতে এই পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে নানা ভোগান্তির কথা জানান তিনি।

প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে এক অসাধু কর্মকর্তা তার কাছে ৪০,০০০ টাকা দাবি করেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, "সে আমারে বলল, পাসপোর্টে ডেট (তারিখ) বহায় দিব কম্পিউটারে। বলল যে, আমি কাজ কইরা দিতে পারমু আমার ৪০ হাজার টাকা লাগবো। সৌদি আরবে থাকলে এই পাসপোর্ট রিনিউ করতে ১০০ রিয়েল খরচ হইতো, বাংলাদেশে ২২০০ টাকার একটু বেশি। আর তারা এতো টাকা চাইতাসে।"

সরকার যদি অটোমেটিক পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়িয়ে দিলে প্রবাসীদের এই ভোগান্তির মুখে পড়তে হতো না বলে তিনি জানান।

স্বাস্থ্য পরীক্ষা

এদিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে এসে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন বরিশালের বাসিন্দা এমদাদ হোসেন। বিদেশ যাত্রীদের বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ নিতে হয় ঢাকার মহাখালীর একমাত্র অনুমোদিত কেন্দ্র থেকে।

কিন্তু দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পর পর দু`দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও তিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারেননি। বরং স্বাস্থ্য পরীক্ষার ওই কেন্দ্রে মানুষের ভিড় দেখে তিনি নিজের স্বাস্থ্য নিয়েই শঙ্কায় পড়ে যান।

মি. হোসেন বলেন, "মাস্ক পরসে ঠিক আছে, কিন্তু সামাজিক দূরত্ব নাই। এখন আমরা করোনাভাইরাস না থাকলেও তো আমার ওইখানে করোনা হয়ে যাইবে।" আবার এই মেডিকেল পরীক্ষা হতে হবে ভ্রমণের সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টা আগে। রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে ২৪ ঘণ্টা আগে।

কিন্তু ভিড় ঠেলে তিনি পরীক্ষা করাতে পেরেছিলেন যাত্রার আগের দিন। এ কারণে রিপোর্টও হাতে পাননি। পরে রিপোর্ট ছাড়াই তিনি বিমানবন্দরের পথে রওনা হন। টিকেট পাসপোর্ট সব হাতে থাকা সত্ত্বেও করোনাভাইরাসের পরীক্ষার ফলাফল না থাকায় তিনি শেষ পর্যন্ত বিমানে উঠতে পারেননি।

এখন সৌদিয়া এয়ারলাইন্স যেন তাকে পুরানো টিকেটেই পরবর্তীতে ভ্রমণ করতে দেন সেজন্য তিনি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। না হলে পুনরায় তাকে পূর্ণ খরচে টিকেট কিনে দ্রুত সৌদি আরবের পথে যাত্রা করতে হবে বলে তিনি আক্ষেপ করেন।

এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কেন্দ্র আরও বাড়ানোর প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

"বাংলাদেশের সব মানুষ কি ঢাকায় থাকে? ঢাকার বাইরে কয়েকটা সেন্টার করলে বা ঢাকার ভেতরেই কয়েকটা সেন্টার করলে তো মানুষের এতো কষ্ট হয় না। আমার টিকেট যদি নতুন কাটা লাগে, এই খরচাটা আমারে কে দিবে?" বলেন মি. হোসেন।

সৌদি আরবের ভিসার জন্য আবেদন জানাতে ৪টি ডকুমেন্ট জমা দিতে বলা হচ্ছে।

পুলিশ ভেরিফিকেশন

বাংলাদেশের পাসপোর্ট থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ নতুন নিয়ম বেঁধে দিয়েছে যে প্রত্যেক যাত্রীকে পুলিশ ভেরিফিকেশন সার্টিফিকেট বা পুলিশের ছাড়পত্র সনদ জমা দিতে হবে।

যেখানে বাংলাদেশে পাসপোর্ট করার সময় পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় সেখানে আলাদাভাবে এই ছাড়পত্র জমা দেয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই বলে জানিয়েছে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন-বায়রা। তাছাড়া এই পুলিশ ভেরিফিকেশন মানেই অতিরিক্ত খরচ বলে জানিয়েছেন প্রবাসীরা।

বাংলাদেশে আটকে পড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সৌদি প্রবাসী কর্মী জানান, যে "পুলিশ ভেরিফিকেশনে গেলে যেটা দুই হাজার টাকার কাজ, সেটার জন্য ২০ হাজার টাকা চাইবো। কারণ হেরাও জানে আমার ১৫-২০ দিনের মধ্যে যাইতে হইবো, ইমার্জেন্সি কাজ। যার যেমন মন চায় টাকা নেয়।"

টিকেট বিড়ম্বনা

শুক্রবার ছুটির দিনেও ঢাকার কারওয়ান বাজারে সৌদিয়া এয়ারলাইন্সে ও মতিঝিলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অফিসের বাইরে ভিড় করেছেন টোকেন ও টিকেট নিতে আসা অনেক সৌদি প্রবাসী কর্মী। তবে সেখানে শুধু তারাই এসেছেন যারা তাদের ভিসার মেয়াদ ২০ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত বাড়াতে পেরেছেন। বাকিরা এখন মেয়াদ বাড়ানোর অপেক্ষায় আছেন।

করোনাভাইরাসের কারণে অনেক সৌদি আরবের অনেক নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং কিছু প্রকল্পে জনবল অর্ধেকে নামিয়ে আনায়, সময় মতো সৌদি আরব যেতে না পারলে চিরতরে কাজ হারাতে পারেন বলে আশঙ্কায় আছেন প্রবাসীরা।

নরসিংদীর বাসিন্দা আপেল হায়াত জাকি গত ১৫-২০ দিন ধরে প্রতিদিন সকাল থেকে সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন টোকেন এবং টিকেটের অপেক্ষায়। কিন্তু আজও দেখা মেলেনি টিকেটের।

এদিকে, সৌদি আরবে তার নিয়োগকারী কর্মকর্তা বা কফিল ভিসার মেয়াদ ৩০শে অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ালেও এই সময়ে মধ্যে না আসলে এই মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। এমন অবস্থায় সময় মতো কর্মক্ষেত্রে ফিরবেন কিনা সেই শঙ্কায় আছেন তিনি।

"৩০ তারিখের ভেতরে না গেলে কফিল আমাদের ভিসা রিনিউ করবে না। চাকরি চলে যাবে। আর সৌদি আরব যাইতে পারবো না।" বলেন, তিনি। টিকেটের এই দীর্ঘ লাইন ও ভিড়ভাট্টার মধ্যে নগদ টাকা ও মোবাইল চুরির অভিযোগও করেছেন অনেক প্রবাসী।

সৌদি কর্তৃপক্ষ এই নিয়ম আরোপ করলেও বাংলাদেশ চাইলে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার বা এক জায়গাতেই সব কাজ সম্পন্ন করার সেবা চালু করে এই প্রক্রিয়াটিকে সহজ ও কম সময়ের মধ্যে করতে পারে বলে জানিয়েছে বায়রা।

এদিকে, সব কর্মীর ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর ব্যাপারে পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে বলে জানান বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড বোয়েসেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল হাসান বাদল। সূত্র: বিবিসি বাংলা 

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer