ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের মহামারিতে সিঙ্গাপুরে এ পর্যন্ত ১৯ হাজারের বেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৮০ ভাগই সিঙ্গাপুরের অভিবাসী শ্রমিক যাদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যাই বেশি। করোনা প্রতিরোধে সিঙ্গাপুর সরকার এরই মধ্যে সার্কিট ব্রেকার বাড়িয়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিক।
লকডাউন ঘোষিত ডরমিটরিতে সরকারের পক্ষ থেকে খাবার, ইফতার ও অন্যান্য সামগ্রী দেয়া হয়েছে, করোনায় আক্রান্তদের আলাদা জায়গায় থাকা খাওয়া চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে সিঙ্গাপুর সরকার। অন্যদিকে সরকারি সাহায্য ছাড়া ডরমিটরি ও সাধারণ বাসস্থানে অভিবাসী শ্রমিকরা একপ্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছে। লকডাউন চলায় সেখান থেকে বাহিরে যেতে পারছে না, যে কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহ ইফতার সামগ্রীর চরম সংকট দেখা দেয় তাদের মাঝে।
এমন এক দূযোর্গময় সময়ে সাহসী মনোভাব নিয়ে প্রবাসীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন বাংলাদেশি বংশভূত সিঙ্গাপুরের নাগরিক ব্যবসায়ী ব্রুকলিঞ্জ স্টেইনলেস স্টিল প্রাইভেট লিমিটেড brooklynz.com.sg এর সিইও কবির হোসেন ও তার সিঙ্গাপুরীয়ান স্ত্রী নূরিয়া বেগম।
রমজানের শুরু থেকে স্ত্রী ও দুইজন সহকারী নিয়ে নিজের দুইটি লরিতে (ডেলিভারি ভ্যান) করে সিঙ্গাপুরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ডরমিটরি থেকে ডরমিটরিতে প্রবাসীদের বাসস্থানে ইফতার সামগ্রী পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে এ সকল কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।
কবির হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, প্রতিদিন দুইটা লরি (ডেলিভারি ভ্যান) দিয়ে ৮ থেকে ১৬টা ট্রিপ দিতে হচ্ছে সারা সিঙ্গাপুরে। প্রথমদিকে এত কল আসত যে আমরা হিমশিম অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম। কোন দিকে যাব,কাকে দিব। একেক জন একেক জায়গায় থেকে ফোনে,ম্যাসেজে প্রচুর অর্ডার দিতে থাকল। পরে এদের ঠিকানামত খোঁজে বের করে জিনিসপত্র পৌঁছে দেয়াটা সত্যিই কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। একটা ডরমিটরি থেকে আরেকটা ডরমিটরিতে যেতে অনেক দূর, এ কারণে আমরা সময়মত ইফতারিও করতে পরিনি অনেক দিন। এমন হয়েছে ইফতারের আধাঘন্টা পর রাস্তায় শুধু পানি একটু খেজুর দিয়ে ইফতারি সেরেছি।
সিঙ্গাপুরে এক লাখের বেশি বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের কাছে সাহায্য পৌঁছানের ব্যাপারে তিনি বলেন, ব্যস্ততার কারণে অনেকের ম্যাসেজ, ফোন রিসিভ করতে না পারায় তাদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। তাই অভিবাসীদের চাহিদার ও দ্রুত সময়ে পৌঁছানোর কথা ভেবে আমরা একটি অ্যাপস বানিয়েছি। তাদের কি কি পণ্য, কি পরিমাণ, কোথায় পৌঁছে দিতে হবে তা অ্যাপসের মাধ্যমে অর্ডার দিয়ে রাখে আমরা সময়মত তাদের চাহিদামত পণ্য সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছি।
তিনি জানান, অনেক ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় গিয়েছি, করোনার ভয়ে যেখানে কেউ যেত না। সবচেয়ে ইনফেক্টট এরিয়া সেগুলো। এস এলিভেন ডরমিটরি যেখানে ২০ হাজার শ্রমিক আটকা পড়ে আছে করোনার জন্য। সেখানেও আমরা ইফতার সামগ্রী দিয়ে আসছি।
সার্কিট ব্রেকারের মাঝে ইফতার সামগ্রীর স্বল্পতার ব্যাপারে তিনি জানান, মালয়েশিয়ান সাপ্লাইয়ার্সের কাছ থেকে ফলমূলসহ বেশির ভাগ মাল আনা হচ্ছে। সিঙ্গাপুরে ইফতার সামগ্রীর সংকটের কারণে মালয়েশিয়া থেকে বেশি দামে আনতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। আমাদের কাছে টাকা আছে কিন্তু সিঙ্গাপুরে পর্যাপ্ত ইফতার সামগ্রী নেই, এটা নিয়ে চিন্তিত।
করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে অভিবাসীদের পাশে দাঁড়ানো ব্যাপারে কবির হোসেন বলেন, সিঙ্গাপুরে সার্কিট ব্রেকারের ১৩ দিন পর্যন্ত আমি নিজেও বাসায় ছিলাম করোনার ভয়ে, একদিনের জন্যও নিচে নামিনি। এ সময় প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত বাংলাদেশীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ডরমিটরি ও বাহিরে অনেকে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছিল, এসব দেখে আমার স্ত্রী নূরিয়া প্রথমে আমাকে আইডিয়া দেয় অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য কিছু করার। দেরি না করে কাজে লেগে যাই। রমজান মাস জুড়ে তাদেরকে ইফতার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেয়ার জন্য নিজের অর্থে একটি তহবিল গঠন করে কাজ চালিয়ে যাই। এরপর স্বেচ্ছায় অনেকে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এই তহবিলে অনুদান ও স্বেচ্ছাশ্রমে এগিয়ে আসতে থাকে।
এই কাজটি করতে গিয়ে করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি, ভয়ের বিষয়টি মনেই আসে না কিন্তু শারীরিক মানসিকভাবে আমি কঠিন সময় পাড় করেছি। তারপরও আমার বাংলাদেশের প্রবাসী ভাইদের জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়ে গর্বিত আমি। ইচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে যে কেউ যে কোন স্থান থেকে মানবকল্যাণে আসতে পারে বলে জানান কবির হোসেন।