Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ১১ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সাম্প্রদায়িকতার ট্রামকার্ড, সাকাচৌ’র ‘জিয়ানো মাছ’ ও আমরা

অধ্যাপক ড. উত্তম কুমার বড়ুয়া

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ২০ ডিসেম্বর ২০২১

আপডেট: ২১:৩৫, ২০ ডিসেম্বর ২০২১

প্রিন্ট:

সাম্প্রদায়িকতার ট্রামকার্ড, সাকাচৌ’র ‘জিয়ানো মাছ’ ও আমরা

-লেখক

বাঙালি জাতিসত্ত্বার সুপ্রাচীন ইতিহাসের স্বরূপ বোঝাতে চাইলে বোধহয় একবাক্যে এটি বলাই শ্রেয়, ‘বৈচিত্র্যের মাঝে অপূর্ব ঐক্য’। চিরায়াত এই ঐক্যের নিগূঢ় তত্ত্বই হচ্ছে সম্প্রীতি। হাজার বছরের বহমান সম্প্রীতির এই ঐকতানই আমাদের অনন্য করে তুলেছে বিশ্বে। তবে ঔপনিবেশিক শাসকদের বর্বরতা আর চক্রান্তে আমাদের অনন্য উত্তরাধিকারের উপর যে অশুভ ছায়া পড়েছিল তিন শতাব্দি পূর্বে, সমকালেও আমরা সেই রাহু থেকে মুক্ত হতে পারিনি। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, সম্প্রীতির মূলে কুঠারাঘাত করে ঔপনিবেশিক শক্তি যে ‘দ্বিধাবিভক্ত সম্প্রদায়’ তৈরি করে গিয়েছিল তা পরবর্তী শাসনতান্ত্রিক শক্তিগুলো আরও ঘণীভূত করেছে ‘সাম্প্রদায়িকতা’কে। চিরায়াত সমাজের বৈচিত্র্যের ঐক্যকে কবর দিয়ে স্বার্থান্বেষী রাজনীতিক অপশক্তিগুলো এর ডালপালা এতোটাই বিস্তার করেছে যে আমাদের গৌরবের মূলটাই আমরা হারাতে বসেছি। সময়ের সঙ্গে এই ধারা ক্রমেই প্রলম্বিত হচ্ছে। 

তবে এই আগ্রাসন রুঁখে দেয়ার চেষ্টাও সূচনাপর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল। ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসনামালে অষ্টাদশ শতাব্দীর ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, প্রজা বিদ্রোহ বা নীল চাষী বিদ্রোহের মতোই অসংখ্য ছোট-বড় লড়াই সবই ছিল সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সম্মিলিত লড়াই। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৫ এর আগস্ট অবধি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত মুক্তির অভিযান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যেখানে আমরা হিন্দু-মুসলিম, শিখ-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধসহ সকল ধর্মের মানুষের স্বতোঃস্ফূর্ত মরণপণ এক সংগ্রামে লিপ্ত হতে দেখি। যদিও ১৯৪৭ এর দ্বি-জাতিতত্ত্ব আবার ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠা রাজনৈতিক দলের উন্মেষ এই সাম্প্রদায়িকতাকে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বড় ভূমিকা রাখে।

উল্লেখ করতেই হবে, ইংরেজদের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার ষড়যন্ত্রে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রুপ দেয়। ১৯০৩ সালে ইংরেজ শাসকরা মুসলিম ও হিন্দুদের মদদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক দল ‘মুসলিম লীগ’ ও ‘হিন্দু মহাসভা’ গঠন করে সাম্প্রদায়িকতা মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ১৯৪৭ পরবর্তী যুগে বিভক্ত ভারতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির হৃতগৌরব ফেরানো এক মাইলফলক হিসেবেই অভিহিত করতে হবে। বলা যায়, একটি বিরাট সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির বিপরীতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নিয়ে রাজনীতির মূলধারায় সংযুক্ত করতে সক্ষম হন। তাঁর নেতৃত্বে সকল গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলনে, সংগ্রামে- ৫২, ৫৪, ৬৪, ৬৬, ৬৯, ১৯৭০-৭১ সবই ছিল হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সকলের ঐক্যবদ্ধ সম্প্রীতির লড়াই। এই লড়াই জাতীয়তাবাদের, অসাম্প্রদায়িক চেতনার, বাংলা ভাষার, অধিকার প্রতিষ্ঠার সর্বোপরি স্বাধীনতা লড়াই।

কেবল রাজননীতির মাঠেই নয়। সম্প্রীতির চিরায়ত বাণীতে উচ্চকিত বাংলা সাহিত্য। চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্য, চন্ডীমঙ্গলকাব্য, ধর্মমঙ্গলকাব্য, সত্যপীরের পূজা, সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী, পদ্মাবতী, নসীরনামা, সপ্তপয়কর, সুলতানী আমলের রামায়ণ রচনা, আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় দৌলত কাজী, মারদান কোরেশী, মাগন ঠাকুর, মহাকবি আলাওল ও আব্দুল করিম খোন্দকার, মহাকবি জয়দেব, চ-ীদাস, কবি শাহ মোহাম্মদ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যে নিয়ে আসে সম্প্রীতির বারত।
এ বাংলার শাসন কখনো হিন্দুদের হাতে, কখনো বৌদ্ধদের হাতে, কখনো মুসলমানদের হাতে, কখনো ইংরেজদের হাতে ছিল। এসব শাসনামলে হাজার বছর ধরে সম্প্রীতির ইতিহাস যেমন দেদীপ্যমান, তেমনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ইতিহাসও কম নয়।

সংখ্যাতত্ত্ব কখনো আশীর্বাদ, কখনো অভিশাপ। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত এবং প্রধান উপাদান সংখ্যা। এই সংখ্যাতত্ত্বে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, মানবিক মূল্যবোধ, জন্মগত অধিকার ভূলে গিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে আমরা কেউ হই সংখ্যালঘু, কেউ হই সংখ্যাগুরু। সংখ্যালঘু মানে সংখ্যালঘুকে সংখ্যাগরিষ্ঠের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে, দুষ্কৃতিকারী, দূর্বৃত্তায়ন, অধার্মিক হয়েও ধর্মের অপব্যবহার করে উপাসনালয় ভাংচুর, লুণ্ঠন, জমিদখল, ধর্ষণ, দেশত্যাগে বাধ্যকরণ ইত্যাদি।

এ মাটিতেই তাদের জন্ম, হাজার বছরের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার, এ দূর্বাঘাসে তাদের পথচলা, কৃষি, শিক্ষা, তাদের হাতে গড়া, এদেশের পানি, রোদে, বাতাসে, আকাশে, বৃক্ষে বেড়ে উঠা, এদেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে বড় হওয়া। চলুন একবার তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল কোথায় হতে পারে আমরা খূঁজে দেখি। এদের নিরাপদ আশ্রয় কোথায়? যারা সংবিধানে “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” করে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়েছে তাদের কাছে, যারা সাম্প্রদায়িক শক্তির ভিত্তিতে গড়া, জঙ্গী ও মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক বা চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীর গাড়িতে লাল সবুজের পতাকা তুলে দিয়েছে, যারা- পূর্ণিমা, মহিমা, দোলন ও ছোট্ট ওজুফাকে যৌনাঙ্গ কেটে ধর্ষণ করেছে তাদের কাছে, না যারা ১৯৭১ সালে এদেশের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠণ করেছিল, হিন্দু বাড়িঘর পুড়িয়ে লুণ্ঠণ করেছে তাদের কাছে? আমার প্রশ্ন এরা যাবে কোথায়?

হত্যা ও সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার সংস্কৃতির কারণেই দেশের জাতীয় সম্প্রীতি বারবার হোঁচট খেয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা নামক দানবীয় শক্তির টার্গেট কারা, যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ^াসী. বিজ্ঞানমনস্ক লেখক, বুদ্ধিজীবি, মুক্তচিন্তক, প্রকাশক, একুশ, বৈশাখ, বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, লালন অনুসারী, মুক্তমনের অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, ভিন্ন জীবনধায় যারা বিশ^াসী।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সালে টানা ২১ বছর পাকিস্তানী লিগেসিকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, ধর্মকে অপব্যবহার করে ধর্মীয় উম্মাদনা সংস্কৃতির আগ্রাসন প্রতিষ্ঠা করেছে।

১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ স্বপরিবারে এমন জঘন্যতম হত্যাকা- পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটিও ঘটেনি। ৩রা নভেম্বর নিরাপদ কারা অভ্যন্তরে নির্বিচারে ৪ জাতীয় নেতাদের হত্যা, তাদের টার্গেট ৭২ এর সংবিধান ও ক্ষমতা দখল ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘গো এহেড’, উপ সেনাপ্রধান, সেনাপ্রধান, সামরিক আইন প্রশাসক, হ্যাঁ-না ভোটে রাষ্ট্রপতি, ‘‘I will make politics difficult for politician, Money is no problem”, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের পুনর্বাসন, ১৪০০ বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকদের প্রহসনের বিচারের নামে হত্যা, গুম-এভাবেই জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাজনীতির যাত্রা। একই পথে জেনারেল এরশাদও হেঁটেছেন। সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার, ফ্রিডম পার্টি গঠন, কর্ণেল ফারুককে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বানানোর চেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করানো, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সৃষ্টি, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, ৫ম সংশোধনী ইত্যাদি।

এদিক থেকে বেগম খালেদা জিয়া আরো এক ধাপ এগিয়ে।  রাজাকারদের মন্ত্রিপরিষদে অন্তর্ভূক্তি, জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতা, মুফতি হান্নান, শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই এর সৃষ্টির মাধ্যমে হত্যার রাজনীতি অব্যাহত রেখে রমনার বটমুলে, যশোরে উদীচীর সমাবেশে, ৬৩ জেলায় একসাথে ৫০০ সিরিজ বোমা হামলা, পল্টনের ময়দানে, বানিয়ারচরে, কোটালীপাড়ায়, শাহজালাল মাজারে, ময়মনসিংহে সিনেমা হলে, নারায়নগঞ্জে আওয়ামী লীগ অফিসে, নেত্রকোনায়  নাট্যদলে বোমা হামালা করে, অধ্যাপক ডঃ হুমায়ুন আজাদ, গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী, জ্ঞানজ্যোতি ভিক্ষু, একুশে আগস্ট আইভি রহমানসহ ২৩জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা-এর সবই খালেদা সরকারের প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন মদদে ঘটেছে।

ব্লগার হত্যা, অভিজিৎ রায়, অশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয়, নিলয়, রাজীব হায়দার, জুলহাস মান্নান, তন্ময়, টাঙ্গাইলের দর্জি নিখিল জোয়ারদার, সিলেটের নাজিমুদ্দিন সামাদ, রাজশাহীর অধ্যাপক রেজাউল সিদ্দিকী, পুরোহিত, পাদ্রী, রাষ্ট্রদূত, জাপানি সমাজসেবক, হলি আর্টিজান, শোলাকিয়ায়, পরিকল্পিত হত্যা- আহসানউল্লাহ মাস্টার, এস এম কিবরিয়া, মমতাজউদ্দীন, মঞ্জুরুল  ইমাম, সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু, মানিক সাহা, রাধারানী, সুবল, পিরেন, তালা মাই (জাপানি), নীলাদ্রি, দীপন, আসিফ মহিউদ্দিন, সানিউর, শফিউল আলম, জগৎজ্যোতি তালুকদার, আহমেদ রশীদ টুটুল, বাঁশখালীতে হিন্দু পরিবারকে গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া, আগুন সন্ত্রাস, পুলিশ হত্যার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ২২ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। সজীব ওয়াজেদ জয়কে বিদেশের মাটিতে হত্যার পরিকল্পনা করেছে।

২০০১ এর নির্বাচনের পর ১৫০০ দিনে এদেশে কি ঘটেছিল সবই আমাদের জানা। ধর্ষণ: ‘বাবা আমার মেয়ে ছোট, তোমরা এক এক করে যাও’-অসহায় বাবার আকুতি-মানবিকতা বিপন্ন, বীভৎস সাম্প্রদায়িকতা। ১৯৭১ সালে যারা আমাদের মা বোনদের ধর্ষণ, নির্যাতন করেছিল, তারা এবং তাদের প্রেতাত্মারাই বারবার সবুজ শ্যামল বাংলাকে ধর্ষণ করছে, রক্তাক্ত করছে সম্প্রীতির ও সৌহার্দের সকল পথ। কুমিল্লার  এবারের দুর্গাপূজার ইস্যূ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। একসূত্রে গাঁথা।

তাস খেলায় আমি পারদর্শী নই, তবে আমি জানি তাস খেলায় একটা ‘ট্রাম’ কার্ড থাকে। যখনই প্রয়োজন হবে তখনই  ‘সম্প্রদায়িক সহিংসতা’ নামক ট্রাম কার্ডটি আমরা রাজনীতিতে ব্যবহার করে থাকি। আমার বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান, মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাড়ি, অবশ্য বর্তমান প্রজন্ম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বেশি চিনে, কারণ তিনি সংসদে ও টেলিভিশনে বক্তৃতায় মুখ ভেংচিয়ে অশোভন কথা বলতেন বলেই হয়তবা বেশি পরিচিতি পেয়েছিল। রাউজানে ছোটবেলায় দেখেছি নির্বাচন আসলেই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী সভা করতে আসতেন।

তার বক্তৃতা শোনার কয়েকবার সুযোগ হয়েছে। তিনি বলতেন, মাসিমারা নমস্কার, আমি জানি আপনারা আমাকে ভোট দিবেন, আপনাদের ভোট আমি পেয়ে গেছি, কষ্ট করে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নাই। দ্বিতীয়টা বলতেন- ‘হিন্দু, বৌদ্ধরা আমার এলাকার জিয়ানো মাছ, যখন দরকার হবে তখন মাছ তুলে খাব। বেঁচারা এখন বেঁচে নেই, শুনেছি ফাঁসিতে ঝোলার আগে মাটিতে শুয়ে গিয়েছিল, অবশ্য পরে ফাঁসির দড়িতেই তার মৃত্যু হয়েছে। সাকাচৌ সংখ্যালঘুদের জিয়ানো মাছ বলতেন। প্রকৃতপক্ষে সাকাচৌ স্বাধীনতা বিরোধী অপবাদের জন্য রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে অপরাধী জিয়ানো মাছ।

নির্বাচন মানে যড়যন্ত্র, নির্বাচন মানে সহিংসতা, নির্বাচন মানে ধর্মের অপব্যবহার, নির্বাচন মানে অপপ্রচার, নির্বাচন মানে সংখ্যালঘু, সম্প্রদায়ের ওপর পাশবিক নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, ধর্ষণ- এসব নির্বাচনের পূর্বে, নির্বাচনকালীন সময়ে এবং নির্বাচন পরবর্তী ঘটে থাকে। নির্বাচন আসলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শঙ্কিত থাকে। কথিত আছে ১৯৫৪ এর নির্বাচনে বলা হয়েছিল, নৌকায় ভোট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে। ১৯৭০ এর নির্বাচনে পাকিস্তান ভাঙ্গা মানে ইসলাম শেষ হয়ে যাওয়া।

বেগম খালেদা জিয়ার আমলে- আওয়ামী লীগ জিতলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে, ‘কুকুরের মাথায় টুপি পরিয়ে অপপ্রচার’, ‘ধানের শীষে বিসমিল্লাহ’, জয় বাংলা  জয় হিন্দ’, ‘লুঙ্গি খুইল্লা ধূতি পিন্দ’ এভাবে নির্বাচনী প্রচারনায় ধর্মকে ব্যবহার করা হয়। এই সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি দখল, চাঁদাবাজি, ভোটদানে ভয়-ভীতি প্রদর্শন, বাধা দান, লুটতরাজ, ধর্ষণ, এমনকি হত্যা এবং দেশত্যাগে বাধ্য করা হত। এ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অবশ্য  বিগত ২-৩ টা নির্বাচনে অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। সাম্প্রদায়িক দল বা জঙ্গি মৌলবাদী শক্তিকে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার সফলভাবে দমন করতে পেরেছে। দেশে এখন বোমা নেই, হরতাল নেই, চাঁদাবাজি নেই, দেশত্যাগ নেই, বাংলাভাই-ইংরেজিভাই নেই, তবে মাঝে মধ্যে এই শক্তি মাথাচাড়া দেয়ার চেষ্টার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

সাম্প্রদায়িকতার পথ বড় ভয়ঙ্কর, অন্ধকার, রক্তাক্ত-যেখানে  মনুষ্যত্বকেবাধ নেই, মানবিকতা নেই, সৌভ্রাতৃত্ববেকাধ নেই, সম্প্রীতি তো সুদূরপরাহত। এদেশের মানুষ ঐতিহ্যগত ও নৃতাত্ত্বিক ভাবেই শান্তিপ্রিয়, অসাম্প্রদায়িক, উদারমনা ও গণতান্ত্রিক । কোন ধর্মেই হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্মের অধিকার হরণ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সমর্থন করে না। সেকারণেই জোর দিয়ে বলতে হচ্ছে-বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকশিত না হলে, ধর্মীয় জাতীয়তার উম্মাদনা বৃদ্ধি পাবেই। এক কথায় বাঙালি জাতীয়তাবাদই পারে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে পরাভূত করতে, যেমনটি পেরেছিল ১৯৭১ সালে। মূলত ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই জয় হয়েছিল।

স্বাধীনতার পর সাম্প্রদায়িকতার যাত্রা শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমলে, শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, আর বেগম খালেদা জিয়ার আমলে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার উত্থান, হত্যার রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা মামুলি ব্যাপারে দাঁড়িয়েছিল। এই জঙ্গী-খুনি চক্রকে ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাসহ সকল আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে ২০০৪ এর ২১ আগস্ট হত্যার চেষ্টায় সেদিন আইভী রহমানসহ ২৩ জনের মৃত্যু হলেও তাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সময়ে আজ মনে হয় বঙ্গবন্ধুর সেই ৭২’র সংবিধান কোথায়, বাঙালী জাতীয়তাবাদ কোথায়, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা আজ কোথায়, নজরুলের ‘গাহি সাম্যের গান’ কোথায়, চণ্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য কোথায়?

কতিপয় অধার্মিক লোকের ধর্মের অপব্যবহারে চেনা মানুষগুলো যেন অচেনা হয়ে যায়। নির্বাচন ছাড়া অন্য সময়ে এ দেশে আমরা সবাই মানুষ, সবাই চেনা, মানবতাবাদী নেত্রী শেখ হাসিনার স্লোগান-‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ সবই ঠিকঠাক থাকে। নির্বাচনের হাওয়া এলেই আমরা মানুষ, আমরা বাঙালি আর থাকি না, তখন সে হিন্দু, সে মুসলিম, সে বৌদ্ধ, সে খ্রিস্টান, সে সংখ্যালঘু, সে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়। চেনা মানুষগুলো অনেক দূরের হয়ে যায়। যেন অপরিচিত কোন এক দেশে বসবাসের অনুভূতি হয়ে যায়। এ সংস্কৃতি বড় বেদনার, বড়ই দুঃখের। মাঝে মাঝে নিজেকে চেনা বড় দায় হয়ে দাড়ায়। সব মানুষের রক্ত কি লাল, আমি কি বাঙালি, আমি কি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ, এদেশ কি সবার? আমরা কি সবাই ধীরে ধীরে ২১ বছরের সাম্প্রদায়িকতার মনস্তত্ত্বে সংক্রমিত?

লেখক: যুগ্ম-মহাসচিব, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও আহ্বায়ক, নেতাজী-বঙ্গবন্ধু জনচেতনাযাত্রা বাস্তবায়ন কমিটি, বাংলাদেশ। ইমেইল: [email protected]

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer