Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সৈয়দপুর

মাকামে মাহমুদ চৌধুরী

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ২৬ মে ২০২০

প্রিন্ট:

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সৈয়দপুর

ছবি- সংগৃহীত

‘জাত মাল্লে পাদির ধরে,
ভাত মাল্লে নীল বাঁদরে`

বড় কষ্ট নিয়ে ছড়াটা বানিয়েছিল নীল চাষিরা। এই ছড়া শোনানো সেই দীনবন্ধু মিত্রও আর নেই, নেই নীল বাঁদরেরাও। ভারতজুড়ে চাষিদের বিদ্রোহের মুখে নীলকর সাহেবরা ল্যাজ গুটিয়েছিল প্রায় দেড়শ বছর আগে। এরপর ধীরে ধীরে ইতিহাস হয়ে গেছে খোদ ব্রিটিশ শাসকেরাই। ( তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো)


নীলফামারী জেলাকে নীলের দেশ বলা হয়। ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজদের কর্তৃক চাষিদের বাধ্যতামূলকভাবে নীলচাষ করার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে জেলার নীলফামারী নামটির আবর্তন ঘটে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভূ-সংস্থান এ জেলার বেশ সমৃদ্ধ যা অন্যান্য জেলা থেকে এই জেলাকে কিছুটা হলেও স্বতন্ত্র করেছে।

জেলার উত্তর দিক সামান্য উঁচু এবং খরা পিরিত অঞ্চল, পূর্ব দিক তিস্তার বালুকাময় এলাকা, এই উঁচু ও বালুমকায় ভূমি ধীরে ধীরে দক্ষিণপশ্চিম দিকে উর্বর কৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে যেখানে প্রতিনিয়ত উৎপন্ন করা হচ্ছে নানা প্রকার ফসল-ফসলাদি যা এদেশের মানুষের খাদ্য চাহিদার সিংভাগই মিটাতে ব্যবহৃত হচ্ছে।

নীলফামারী জেলা বহু অতীত ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে। এ জেলায় সত্যপীরের গান, হাঁস খেলা, মাছ খেলা সহ নানা ধরনের উৎসব ও মেলার আয়োজন করা হয়। এছাড়া গ্রামগুলোতে এককালে অত্যন্ত সুনিপুণ হস্তে মাটির তৈরি বাসনপত্র এবং বাঁশ দিয়ে তৈরি করা নানা জিনিসপত্র ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং পরিচিত এক শিল্প। তবে কালের বিবর্তনে আধুনিকতার সংস্পর্শে পুরাতনকে সঙ্গে নয় বরং বর্জন করে নতুনকে আঁকড়ে ধরার হীন মানুসিকতায় কালের অতল গর্ভে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে চমকপ্রদ এ শিল্প-সংস্কৃতিগুলো। নীলফামারী জেলার প্রাণজুড়ে রয়েছে ছোট-বড়, মাঝারি আকারের বহু গ্রাম ও শহর যা জেলাটির প্রাণশক্তির যোগান দিয়ে যাচ্ছে।

এ জেলার শহরগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্র একটি অংশজুড়ে রয়েছে সৈয়দপুর নামক একটি শহর যা উত্তরের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত। এখানে রয়েছে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা। মৃতপ্রায় এই কারখানাটিকে হাজার হাজার শ্রমিক তাদের ঘাম নিংড়ানো শ্রম আর ভালোবাসা দিয়ে লাইফ সাপোর্টে রেখেছে। প্রতিনিয়ত পুরণো ইঞ্জিন ও ট্রেনের বগি মেরামত করে তৈরি করা হচ্ছে নতুনভাবে যা দেশের সর্বত্র জনসাধারণের পরিবহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

কারখানাটি নিজে লাইফ সাপোর্টে থাকা সত্ত্বেও এখানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে একটি বড় অংশ অর্থের যোগান দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ঠিকই সাপোর্টে রেখেছে। সরকারের একটুখানি সহানুভূতি এবং তীক্ষ্ম নজরদারি পারে লাইফ সাপোর্ট থেকে কারখানাটিকে দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইনে পরিণত করতে।


সৈয়দপুরের ইসলামবাগ নামক স্থানে রয়েছে খ্রিস্টানদের কবরস্থান (Cemetery)। যেখানে অসংখ্য খ্রিস্টান চিরনিদ্রায় শায়িত। তাদের কবরস্থানের পূর্ব-উত্তর দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে শতাব্দীরও বেশি প্রাচীন দৃষ্টিনন্দন অপূর্ব নির্মাণশৈলীর কারুকার্যময় নান্দনিক মোঘল নির্মাণ শৈলীর তাজমহল আকৃতির চিনি মসজিদ। যেখানে প্রতিনিয়ত নামায, জিকির, তারাবিহ, ইত্যাদি চলে।

এ মসজিদটি বর্তমানে একই নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে অনেকাংশে বর্ধিত এবং প্রসারিত করা হয়েছে। তবে আগের অংশটি বেশ প্রাচীন হওয়ায় কিছুটা লালচে ভাব ধরেছে। মসজিদটিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে মনে হবে যেন নবনির্মিত অংশটির সঙ্গে পুরণোটির রয়েছে এক গভীর মিলবন্ধন যেমন মিলবন্ধন এখানকার মানুষের মধ্যে রয়েছে।


সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি চমৎকার উদাহরণ হল সৈয়দপুর। এখানকার মানুষেরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ এবং শান্তি প্রিয়। তাইতো বলাই যায়-

Come and see (আসুন এবং দেখুন)
How peacefully both the inhabitants are living! (কত শান্তিতে উভয় সম্প্রদায়ের অবস্থান।)
No malice and no hatred among themselves. (কোনো হিংসা নেই, নেই কোনো বিদ্বেষ।)

এছাড়া এখানে রয়েছে সেনানিবাস সংযুক্ত বিমানবন্দর যা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে ঘোষণার অপেক্ষায় মাত্র, যা এই জনপদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিমানবন্দরটি আন্তর্জাতিক করার লক্ষ্যে কাজ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে করা হচ্ছে এবং কাজটি সম্পন্ন হলে প্রাণপ্রিয় এই শহরটি দেশবাসীর কাছে নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করবে।


এখানকার মানুষেরা অত্যন্ত অতিথি পরায়ন যার তুলনা হয় না। কমপক্ষে একটি পানের খিলি নতুবা এক কাপ চা দিয়ে আপ্যায়ন করার যার পর নাই চেষ্টা। বাঙ্গালী অবাঙ্গালীর দৃষ্টান্তমূলক শান্তিপূর্ণ বসবাসের স্থান সৈয়দপুর। এই শহরের অনেক পরিত্যাক্ত রেলওয়ে জমি রয়েছে। শিক্ষানগরী হিসেবে শহরটি পরিচিত হলেও এখানে নেই কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

যার ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়ত অবহেলিত এই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জীবন ঝুঁকি নিয়ে ছুটতে হয় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। যেখানে কমপক্ষে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই পারে অবহেলিত এই জনপদের অনেক শিক্ষার্থীদের কম খরচে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ করে দিতে। আর এই জন্য প্রয়োজন উচ্চ মহলের একটু করুণা আর সুদৃঢ় প্রচেষ্টা। সরকারের প্রচেষ্টায় নিজের শহরে থেকেও যাতে উচ্চশিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারে শিক্ষার্থীরা এই কামনায়।

পরিশেষে প্রাণপ্রিয় এ শহরটিকে একবার হলেও বেড়াতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলতে চাই-
“আমার বাড়ি যাইয়ো ভ্রমর
এই বরাবর পথ,
সৈয়দপুর নামক জায়গায় এসে
থামিও তব রথ। “

(সহযোগিতায়ঃ মুকুল চৌধুরী, সিনিয়র ইংরেজি শিক্ষক, লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজ, সৈয়দপুর)

লেখক: শিক্ষার্থী, পুরকৌশল বিভাগ-চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer