Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

বৈশাখ ৫ ১৪৩১, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪

সর্বস্তরে প্রয়োগই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চ্যালেঞ্জ

ড. মো. হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

প্রিন্ট:

সর্বস্তরে প্রয়োগই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চ্যালেঞ্জ

মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম করে সে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছেন এমন জাতি বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। কিন্তু আমরা সৌভাগ্যবান কিংবা দুর্ভাগ্যবান যা-ই হই না কেন, পৃথিবীর বুকে আমাদের বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে কতশত মানুষকে। যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয়েছিল, তখনই এর বীজ রোপিত হয়েছিল। কারণ তখন একটি অপপ্রচার চালানো হতো বিকৃত ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যক্তিবর্গের দ্বারা। তখন তাদের তরফ থেকে এভাবে অপপ্রচার করা হতো যে, যেহেতু হিন্দু ও মুসলমান-এই দুই ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাগ হয়েছে, সেজন্য বাংলা হলো হিন্দুদের ভাষা এবং উর্দু হলো মুসলমানদের ভাষা।

কাজেই মুসলমানিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই সেদেশের ভাষা বাংলা হওয়া বাঞ্ছণীয়। সেখান থেকেই শুরু। তারপর ১৯৪৮ সালে থেকেই বাংলাভাষা রক্ষার আন্দোলন শুরু হতে লাগলো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তখন ভেবেছিল যে, যদি পূর্ববাংলাকে তাদের নিজস্ব বাংলা ভাষায় কথা বলা, লেখাপড়া, জ্ঞান চর্চা করতে, প্রয়োগ, ব্যবহার ইত্যাদি করতে দেওয়া হয় তাহলে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক বেশী এগিয়ে যেতে পারে। তাহলের আর তাদেরকে শাসন- শোষণ করা যাবে না।

সেজন্যই উর্দুভাষাকে জোরপূর্বক পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল বারবার। সেখানে আরো একটি দূরভিসন্ধি ছিল এরকম যে, যদি কোনভাবে পূর্ববাংলার উপর উর্দূভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া যায় তাহলে বাঙালি জাতি তাদের মুখের ভাষা হারিয়ে, তাদের বিরুদ্ধে সবধরণের অন্যায়-অত্যাচর মুখবুজে সহ্য করবে। কোন প্রতিবাদের ভাষা খুজে পাবে না তারা। কিন্তু রাখে আল্লাহ, মারে কে? দেখা গেল ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে পূর্ব বাংলার মানুষের ভিতর বাংলা ভাষা হারানোর চক্রান্ত ক্রমশই পরিষ্কার হতে থাকে দিনদিন।

তারপরে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সে মাতৃভাষার আন্দোলন চরম পরিণতির দিকে গিয়ে শেষপর্যন্ত সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ব্যাক্তিবর্গসহ সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় আরো অনেক শহীদের তাজা প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানি স্বৈরাচারেরা পিছু হঠে বাঙালির দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এতে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই পরবর্তীতে লক্ষণীয়। প্রথমত বাঙালি জাতি তাদের আগামীর দাবি আদায়ের একটি পথ পেয়ে যায়। রচিত হয় একটি সুগম পথের যা ধরে আমাদের পরবর্তী স্বাধীনতার আন্দেলনের সুদূরপ্রসারী রাস্তা-ঘাট আস্তে আস্তে নির্ভয়ে এগোনোর প্রেরণা যুগিয়েছে।

অপরদিকে পাকিস্তানিরা ভবিষ্যতের জন্য আরো সতর্ক হয়ে গিয়ে বাঙালিকে আর কোন ধরনের ছাড় না দেওয়ার বিষয়ে অনড় ও ফন্দি-ফিকিরে আবৃত হতে থাকে। তাদের ভিতরে অদম্য স্পৃহা সৃষ্টির মাধমে বাঙালির উপর শোষণ, অত্যাচার ও নির্যাতন আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে লাগল। কারণ এর মাধমে তারা বাঙালির ভিতর যে চেতনাবোধ ও দেশপ্রেম উপলব্ধি করতে পেরেছিল, তাতে তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল মনে মনে। আর এও তাদের মনে ছিল যে, সহ¯্রাধিক মাইল দূরের একটি ভূখ-ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি জাতি-রাষ্ট্রের উপর খুব বেশীদিন জুলুম, কর্তৃত্ব, অত্যাচার করা যাবেনা।

সেজন্যই তারা ‘যা পারো নিয়ে নাও’ এর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তখন। তারপর ১৯৪৮ সালের পর থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের সাফল্য অর্জনের পর ১৯৫৮ তে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টিতে শিক্ষা আন্দোলন, ছিষট্টির ছয়দফা, উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, সর্বোপরি ১৯৭১ সালে ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রাম আসলে একইসূত্রে গাথা। সবগুলোই স্বৈরাচারী, নিপীড়ক, শোষক পাকস্তানিদের হটানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাষা পুণরুদ্ধার ও দেশের স্বাধীনতার জন্য করা হয়েছিল। ভাষা সংগ্রামে সেসময় যেমন ছিলেন শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবার ছিলেন প্রবীণ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়র্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সাথে সে সময়ের তরুণ ও উদীয়মান নেতা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানও ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

তারপর যখন বাংলা পূর্ববাংলার মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো, সেই পথ ধরে একই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তখন ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুই লক্ষাধিক মা-বোনের ইজ্জত এবং ত্রিশ লক্ষাধিক শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ১৯৫২ সালের পর থেকেই দাবি উঠেছিল যে পূর্ব বাংলায় সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু বাংলাভাষা রক্ষার জন্য একমাত্র আমাদের বাংলাদেশকেই কেবল ভাষার জন্য রক্ত ও জীবন দিতে হয়েছে, সেজন্য সেই ভাষা বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ১৯ বছর বাংলা ভাষা সে কাজটি খুবই ধীর গতিতে হয়েছে। কারণ ভাষা স্বাধীন হলেও দেশ যে ছিল পরাধীন। তখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষা দিবসকে শ্রদ্ধা জানাতে দেওয়া হতো না। তৈরী করতে দেওয়া হতো না কোন শহীদ মিনার। তখন লুকিয়ে লুকিয়ে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে ও সংক্ষিপ্ত কলেবরে পালন করা হতো ভাষাশহীদ দিবস।

তবে পরবর্তীতে আস্তে আস্তে বীর বাঙালিকে আর কেউ-ই রুখতে পারেনি। ঠিকই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠিত হলো সবচেয়ে বড় শহীদ মিনার। তার পর থেকেই পালিত হচ্ছে ভাষাদিবস যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে অনেক আগেই। তারই ধারাবাহিকতায় মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠিত হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এর পিছনেও রয়েছে একটি কাকতালীয় ইতিহাস। ১৯৯৯ সালে কানাডা প্রবাসী কয়েকজন বাংলাভাষা প্রেমীদের মধ্যে সেখানেও আব্দুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম নামের ব্যক্তিবর্গ উদ্যোগী হয়েছিলেন।

তাদের উদ্যোগেই জাতিসংঘের ইউনেস্কোর আহবানে তৎকালীন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকারে নেতৃত্বে শিক্ষামন্ত্রী এএইচএসকে সাদেকের সহযোগিতায় তা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সেই ১৯৯৯ সাল থেকেই জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিবছরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এ দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এরই উদাহরণ হিসেবে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে বিরাট বড় এক শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠিত করে সেখানে বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক অনেক আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন করেছিল। এবছর (২০২১) সারা বাংলাদেশে এবং বিদেশের সব মিশন এবং জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রসমূহ সেই গৌরবময় অমর একুশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সীমিত আকারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পালন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে।

কিন্তু দঃখের বিষয় হলো এখনো সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু যখন সঙ্গত কারণেই পরাধীন পূর্ববাংলায় ইচ্ছা করলেই সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত করার অনেক বাধা-বিপত্তি ছিল। কিন্তু তখনো দেখা গেছে, ১৯৭১ সালের পর যখন দেশ ও ভাষা দুটোই স্বাধীন তখনও সর্বস্তরে বাংলাভাষা ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়নি। এখনো অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছুই এখনো চলছে বিদেশি ভাষাতেই। আমরা জাতি হিসেবে আবেগ তাড়িত হয়ে সবকিছুই আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জন করতে পারি, কিন্তু এর সুফল পুরোপুরি ভোগ করতে যেন এতটা আগ্রহ বোধ করিনা।

যেখানে রাশিয়া, চীন, জাপানের মতো দেশ তাদের মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিল্প-সাহিত্য চর্চাসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমরা আমাদের দেশে সর্বস্তরে বাংলাভাষা ব্যবহার করতে পারছিনা। এখানো নিজের শিশুদের ইংরেজি স্কুলে পড়িয়ে গর্বকরে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করিনা। অথচ আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহারের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। তারপরও আমরা তা ব্যবহারে সার্বজনীন হতে পারছিনা। বাংলাভাষা চর্চা যেন এখন শুধু ফেব্রুয়ারি মাসকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা বাংলাভাষাকে নিয়ে মাতামাতি করে থাকি। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস শেষে সারাবছর যেন আমার তা বেমালুম ভুলে যাই।

ভাষা সত্ত্বাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, এর চর্চা বাড়ানোর জন্য, শুদ্ধভাবে ভাষা চর্চার জন্য, ভাষা বিষয়ে গবেষণা করার জন্য দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা একাডেমি নামের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। সেই বাংলা একাডেমি প্রতিবছর মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করে থাকে যা এখন চলমান রয়েছে। কাজেই বাংলা একাডেমি, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর কর্তৃক সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের একাধিক নির্দেশনা বিভিন্ন সময়ে জারি করা হয়েছে। কিন্তু তা সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছেনা কোনখানেই। কাজেই সঠিকভাবে পালন করতে হলে এটি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে অবশ্যই সকলের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। তা না হলে আমাদের সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত ভাষা এবং সংগ্রাম দুটোই বিফলে যেতে পারে।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

email: [email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer