-পুলিশের হাতে আটক ঘাতক বাবা। ছবি: সংগৃহীত
বহুল আলোচিত মাদ্রাসা ছাত্র বিপ্লব আকন্দ (১৪) হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন এবং ঘাতক বাবা ও সহযোগী আসামী আটক করলো পিবিআই গাজীপুর। মামলা ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আসামী বাবুল হোসেন আকন্দ (৪২)-কে গত ৯ জুন এবং এমদাদুল (৩৫)-কে ২০ জুন গাজীপুর জেলার পিরুজালী এলাকা থেকে অভিযান পরিচালনা করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, গত ৮ মার্চ (২০২১) রাতে বিল্পব আকন্দ মসজিদে নামাজ পড়ার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। বাড়িতে ফিরে না আসায় তাঁর মা ছেলেকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুজি করে। ৯ মার্চ (২০২১) সকালে জেলার জয়দেবপুর থানাধীন পিরুজালী বকচরপাড়া গ্রামের সানাউল্লাহ মুন্সির বাঁশ ঝাড়ের পাশে বিপ্লবের রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ অবস্থায় পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে বিপ্লবের মা খাদিজা আক্তার জয়দেবপুর থানায় অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করলে জয়দেবপুর থানার মামলার (নং-১২ তারিখ-১২/০৩/২০২১ ধারা-৩০২/৩৪) রুজু হয়। মামলাটি গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানা পুলিশ ১ মাস তদন্ত করে রহস্য উদঘাটন করতে না পারায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ঢাকার নির্দেশে মামলাটি তদন্তভার পিবিআই গাজীপুর জেলার উপর অর্পণ করা হয়।
ডিআইজি পিবিআই বনজ কুমার মজুমদার, বিপিএম (বার), পিপিএম এর তত্ত্বাবধানে ও দিক নির্দেশনায় পিবিআই গাজীপুর ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান এর সার্বিক সহযোগিতায় মামলাটি তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মাহমুদুল হাসান মামলাটি তদন্ত করেন।
আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, আসামী বাবুল ১১/১২ বছর আগে তার আপন ছোট ভাইয়ের স্ত্রী জুলিয়াকে বিয়ে করে এবং পৈত্রিক ২ কাঠা জমি বিক্রি করে টাঙ্গাইলে তার ছোট স্ত্রীর বাবার বাড়িতে ঘর তৈরী করে দেয়। জুলিয়া সেখানে বিভিন্ন ছেলেদের সাথে চলাফেরা করায় বাবুল তাকে নিয়ে পিরুজালী গ্রামে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকে। জুলিয়া প্রায়ই বাবুলের বড় স্ত্রীকে মারধর করত। ফলে বাবুলের প্রথম স্ত্রী খাদিজার সাথে দ্বিতীয় স্ত্রী জুলিয়ার ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকতো।
পুলিশ জানায়, মামলার ঘটনার অনুমান ৩ মাস পূর্বে আসামী বাবুল এর সাথে দ্বিতীয় স্ত্রী জুলিয়া ঝগড়া করে তার ছোট মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি টাঙ্গাইল চলে যায় এবং মোবাইল ফোনে তার স্বামী বাবুলকে প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে বলে। তালাক না দিলে সে তার ছোট মেয়েকে খুন করে বাবুল এবং তার পরিবারের সকলকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। বাবুল তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কথাবার্তায় সব সময় অতিষ্ঠ থাকতো।
মামলার অপর আসামী এমদাদ সম্পর্কে বাবুলের ভাগ্নী জামাই। এমদাদ এর সাথে বাবুল এর ২য় স্ত্রীর গোপন সম্পর্ক ছিল, যা এমদাদ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে। এই সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে বাবুলের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলিয়া এমদাদকে বিভিন্ন বুদ্ধি পরামর্শ দিত যাতে করে বাবুলে প্রথম স্ত্রীকে ঘড় ছাড়া করা যায়। ঘটনার অনুমানিক ১০ দিন পূর্বে জুলিয়া পিরুজালী এসে এমদাদের সাথে দেখা করে বিপ্লবকে হত্যা করার জন্য বাবুলকে রাজী করাতে বলে। ঘটনার কয়েক দিন পূর্বে বাবুল এমদাদকে জানায় তার ছোট ছেলে বিপ্লবকে হত্যা করতে হবে এবং বাবুলকে তার কথা শুনতে বলে। পরবর্তীতে বাবুল এমদাদুল এর পরামর্শে তার ছোট ছেলে ভিকটিম বিপ্লব আকন্দকে খুন করার পরিকল্পনা করে কারণ আসামী বাবুল তার দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতি খুবই দুর্বল ছিল।
পুলিশ জানায়, নারায়নগঞ্জ মাদ্রাসা থেকে বাসায় ছুটিতে আসার কয়েকদিন পরে ঘটনার দিন বাবুল ছেলে বিপ্লবকে নিয়ে এশার নামায পড়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়। তখন বাবুল তার ছোট স্ত্রীকে তাবিজ করার কথা বলে বিপ্লবকে প্রতিবেশী খালেকের বাসা থেকে একটি কোদাল আনার জন্য বলে। বিপ্লবের স্বাস্থ ভালো থাকায় এমদাদ ভিকটিমকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেভেন আপ এর সাথে নেশা জাতীয় ঔষধ মিশিয়ে খাওয়ায়। পরে বাবুল তার ছেলে বিপ্লব আকন্দকে নিয়ে পিরুজালী বকচরপাড়া গ্রামের সানাউল্লাহ মুন্সির বাঁশ ঝাড়ের পাশে ফাঁকা স্থানে উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণ পর বিপ্লব ঝিমিয়ে পড়তে থাকে এবং বাড়ি যাওয়ার কথা বলে মাটিতে শুয়ে পড়ে।
‘তখন বাবুল তার হাতে থাকা কোদাল দিয়ে ভিকটিম অচেতন ছেলে বিপ্লবের গলায় কোপ দেয়। বিপ্লব লাফিয়ে উঠার চেষ্টা করলে বাবা বাবুল পুনরায় কোদাল দিয়ে ভিকটিমের শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং কোদালটি পাশ্ববর্তী ঢাকাইয়ার ধানের জমিতে ফেলে বাসায় চলে যায়। পরে এমদাদ বাবুলের কথামত কোদালটি সেখান থেকে নিয়ে তার বাসায় লুকিয়ে রাখে।
এই বিষয়ে পিবিআই গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বলেন, মামলার বাদীনি তার স্বামীর প্রথম স্ত্রী। আনুমানিক ১১/১২ বছর আগে বাবুল তার আপন ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে ফুসলিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ করে এবং ছোট স্ত্রীর ২ মেয়েকে নিয়ে নিজের গ্রামে আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করত। মূলত পারিবারিক কলহের জের ধরে ঘটনার দিন বাবুল কোদাল দিয়ে নিজের ছেলে বিপ্লবের গলা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে নিজের নির্মমভাবে হত্যা করে। গ্রেপ্তারকৃত এমদাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১০ জুন তার নিজ বাড়ী হতে হত্যাকান্ডের সময় ব্যবহৃত কোদালটি উদ্ধার করা হয়।গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতে সোপর্দ করলে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
বহুমাত্রিক.কম