Bahumatrik | বহুমাত্রিক

সরকার নিবন্ধিত বিশেষায়িত অনলাইন গণমাধ্যম

চৈত্র ১৪ ১৪৩০, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪

শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের জীবন থেকে

এস এম মুকুল

প্রকাশিত: ১৪:৩৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

আপডেট: ১৪:৩৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রিন্ট:

শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের জীবন থেকে

ঢাকা : ছোট্ট শিশুদের কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে টেনে তোলা হয় যখন তার ঘুমের চাহিদা পূরণ হয়নি। ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তি করে তাকে স্কুলের জন্য তৈরি করা হয়। কী অসম্ভব নির্মমতা বোধ আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে কোন উচ্চাশায় কে জানে।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, অভিভাবকদের নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করা উচিত যে, আমার সন্তানকে আমি কীভাবে গড়ে তুলতে চাই। তাকে শিক্ষিত বোধহীন নাগরিক বানাতে চাই, নাকি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষিত মানুষ বানাতে চাই। নিশ্চয়ই দ্বিতীয়টি সব বাবা-মায়ের চাওয়া। তাহলে আমরা অসম প্রতিযোগিতার পেছনে কেন দৌড়াচ্ছি। এসব করে নিজেদের মানসিক, আর্থিক বিনাশের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি করছি প্রিয় সন্তানের। এ কথা বোঝার জন্য আর কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই যে, পড়ালেখা আর পরীক্ষার চাপে বাচ্চাদের মানসিক বৃদ্ধি হচ্ছে না।

অনুপযোগী বয়সে প্রাথমিক থেকেই বাচ্চাদের ওপর অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার চাপ দিয়ে ব্যস্ত রাখা হয় পুরো শিক্ষাজীবন। এসব চাপে পড়ে শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের শিশুদের জীবন থেকে। ফলে বড় হলেও তাদের মাঝে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ বিকশিত হচ্ছে না। তাহলে এ কেমন শিক্ষায় শিক্ষিত করছি প্রিয় সন্তানকে?

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সেন্টার অব এডুকেশনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিশুদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তাদের মাদকাসক্তির দিকে ঠেলে দেয়। এই ‘চাপ’ বলতে মানসিক, পড়াশোনাবিষয়ক, পারিবারিক, সামাজিক সব ধরনের চাপ বোঝানো হয়েছে। এ গবেষণায় বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে বেশি চাপ অনুভূত হয়েছে পড়াশোনার চাপ।

গবেষক দল তাদের সার্ভের জন্য ১ হাজার ৯৮৭ শিশু-কিশোর এবং ৫০৪ অভিভাবকের ইন্টারভিউ নিয়েছিল। ফলাফলে দেখা গেছে, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের ভেতর যারা প্রায় একঘেয়েমিতে থাকে তাদের মধ্যে ৫০ ভাগই ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন, মদ্যপান ইত্যাদিতে আসক্ত হয়। এসব তথ্য সংগ্রহের পর National

Center on Addiction and Substance Abuse-এর প্রেসিডেন্ট জোসেফ ক্যালিকেনো বলেন, ‘এটা মা-বাবাদের জন্য অশনিসংকেত। তাদের অবশ্যই বাচ্চাদের নিয়ে সতর্ক হওয়া উচিত-তারা কি করছে, কি করতে চাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে ইত্যাদি জানা উচিত। এ তথ্য আমেরিকার শিশুদের এবং কিশোর-কিশোরীদের থেকে সংগ্রহ করা হলেও ঢাকা শহরের শিশুদের মাঝেও এ ধরনের আচরণ দেখতে পাওয়াটা খুব অস্বাভাবিক নাও হতে পারে। কারণ বাংলাদেশের শিশুদেরও প্রচ- চাপে থাকতে হয়।

প্রতিদিন প্রাতরাশে একঝাঁক শিশু তাদের চেয়ে বড় ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যাচ্ছে স্কুলে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য মা-বাবাও তাদের ভীষণ চাপের মধ্যে রাখছেন। ফলে শিশুরা হারাচ্ছে তাদের সুনিপুণ স্বকীয়তার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা অসীম সম্ভাবনার অফুরন্ত উৎস।

আদরের সন্তানকে মানুষ গড়ার নাম করে কি করছি আমরা? অনুপযোগী বয়সে তাকে স্কুলে দিচ্ছি। পরীক্ষার নামে যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দিচ্ছি এতটুকুন শিশুকে। স্কুলে যাওয়া, বাড়ির কাজ, একটু আরবি পড়া, একটু গান শিক্ষা, নাচ শিক্ষা, ক্লাস টেস্ট, পরীক্ষা, প্রাইভেট, কোচিং, গাদাগাদা ভারি ভারি বইয়ের বোঝা কত সহ্য করবে শিশু। ৫ থেকে ৬ বছরের একটা শিশুর ওপর কত না মানসিক নির্যাতন। এতটুকুন শিশু তার কতটুকু চাপ সইবার ক্ষমতা আছে আমরা কি একবারও তা ভেবে দেখি?

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে, দাদা-দাদি, নানা-নানির সাহচর্য শিশুদের দীর্ঘজীবী করে। এখন পড়াশোনার আর পরীক্ষার চাপে দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি বা মামাবাড়ি বেড়ানোর উচ্ছ্বাস শিশুদের জীবনে নেই। আবার ব্রিটেনভিত্তিক দাতব্য সংস্থা রয়েল সোসাইটির এক জরিপে জানা যায়, ব্রিটেনে ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়স্ক মানুষের কোনো সোনালি শৈশব নেই!

প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার মতো অকৃত্রিম অভিজ্ঞতা তাদের জীবনে ঘটেনি! জরিপে সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য শিশুজীবনে প্রকৃতিবান্ধব অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের শিশুরা প্রকৃতির আলিঙ্গন কি পাচ্ছে? নগর সভ্যতা যেন সমৃদ্ধ শৈশবের সব আয়োজনকে গো-গ্রাসে গিলে ফেলছে। সবাই মিলে ঠেলছি, আর বলছি- পড়, পড় এবং পড়।

আমাদের শিশুদের চাপ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী ডা. মেহতাব খানম বলেছেন- শিশুদের জন্য উপযোগী এবং সঠিক জীবন চর্চাই হচ্ছে না। এখন আমাদের পরিবারগুলোতে শ্রদ্ধা, স্নেহ-মমতা, সহিষ্ণুতা ও শর্তহীন ভালোবাসার চর্চা নেই। সবাই স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। কথা হচ্ছে, শিশুদের শিক্ষাদানের নাম করে তাদের জীবন থেকে নির্মল শৈশবের আনন্দমুখরতা কেড়ে নিয়ে আমরা আসলে কেমন প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাইছি?

প্লে ইংল্যান্ড নামের একটি সংগঠন বলেছে, শিশুদের গাছে ওঠা বা সাইকেল চালানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ খেলাগুলোতে উৎসাহিত করা উচিত। তাতে একটু-আধটু ব্যথা পেলে বা কেটে-ছিঁড়ে গেলেও ক্ষতি নেই। সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে শিখবে। বাধা-বিপত্তি সম্পর্কে বুঝবে। আরও বুঝবে যে, কোনো কিছু অর্জন করা অত সহজ নয়। সবকিছুই কষ্ট করে অর্জন করতে হয়। আমরা করছি তার উল্টোটা। চীন একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে।

শহরের শিক্ষার্থীদের গ্রামে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীনের একটি আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ। গ্রামীণ জীবনযাপন সম্পর্কে ধারণা নিতে এবং জীবনযাত্রার পার্থক্য অনুধাবনের জন্য চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চংকিং শহর কর্তৃপক্ষ এ ঘোষণা দিয়েছে। ছয় মাসের জন্য শিক্ষার্থীরা গ্রামে যাবে এবং সেখানে সে পরিবেশে কাজ করবে। গাছ লাগাবে, পরিচর্যা করবে, ফসল তুলবে ইত্যাদি। চীনারা অবশ্য কলেজ লেভেলের জন্য এ উদ্যোগ নিয়েছে। এমন উদ্যোগ আমাদের দেশে নেয়া যেতে পারে।

শিক্ষাজীবনে পরীক্ষা থাকবে, পড়াশোনা থাকবে- এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু আমাদের এখানে যা হচ্ছে তা রীতিমতো একটা অসম, অনুপযোগী ও বুদ্ধিবৃত্তিহীন অপ্রতিযোগিতা চাপিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পুরোটাই হয়ে পড়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রিক।

শিক্ষা ব্যবস্থাটা টাকা কামানো যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। আর এর কবলে পড়ে কোচিংয়ের নামে ৩২ হাজার কোটি টাকা রীতিমতো পকেট কেটে নিয়ে যাচ্ছে একশ্রেণীর শিক্ষা ব্যবসায়ী। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে সন্তানকে শিক্ষিত বানানোর নামে অসহায়ের মতো টাকা তুলে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। টিউটোরিয়াল, ক্লাস টেস্ট, মডেল টেস্ট, প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক আবার বার্ষিক কত নামের যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে এ কোমলমতি বাচ্চাদের ওপর ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। অবস্থাটা এমন হয়েছে, যেন পরীক্ষার ফাঁকে পড়াশোনা করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। অথচ হওয়া উচিত ছিল, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে পরীক্ষা দিতে হবে।

আরেকটি খবর দিই, ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আদর্শিক শিক্ষা ব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে। ফিনিশ শিক্ষা ব্যবস্থার সফলতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূলমন্ত্র- ফিনল্যান্ডের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর অহেতুক নজরদারি চালানো হয় না। কোনো ধরনের বাহ্যিক খবরদারি বা মান যাচাইয়ের লক্ষ্যে ঘনঘন পাবলিক পরীক্ষা- এর কোনোটাই সেখানে চলে না।

মা-বাবারা তাদের সন্তানদের ভার শিক্ষকদের ওপর ছেড়েই নিশ্চিন্ত। ফলে ফিনল্যান্ডে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ১ শতাংশেরও কম। আর অর্জন পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা শিক্ষাপ্রণালি আর শিক্ষা ব্যবস্থার খেতাব। অতিসম্প্রতি ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোতে হাতে লেখা শেখানো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। পরিবর্তে তাদের টাইপিং শেখানো হবে।

বলা হয়েছে, দেশটির স্কুলগুলোতে ছেলেমেয়েদের আর হাতে লিখতে হবে না, হাতে লেখা শেখানোও হবে না। ফিনল্যান্ডের ন্যাশনাল বোর্ড অব এডুকেশনের মিনা হারম্যানেন জানিয়েছেন, টাইপিং শেখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিত্যদিনের কাজে এটা দরকার হয়। এজন্যই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

রমরমা কমিশন বাণিজ্যের কারণে পাঠ্যবইয়ের ভারে ক্লান্ত আমাদের অবুঝ শিশুরা। মাত্রাতিরিক্ত সিলেবাসের ভারে ন্যুব্জ শিশুদের অসহায় আর্তি অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রী কি শুনতে পাচ্ছেন? প্রধানমন্ত্রী অবশ্য শিশুদের বাড়তি বইয়ের বোঝা কমানোর পক্ষে উপায় খুঁজতে বলেছেন। দ্রুত, খুব দ্রুতই এ কাজটি করা উচিত। সঙ্গে পরীক্ষার চাপও কমাতে হবে। শিক্ষার্থীরা বেশি বেশি বই পড়–ক, তবে তা একাডেমিক শিক্ষার বাইরে জ্ঞান বিকাশে সহায়ক বই হোক।

প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে তোলা হোক। সেখান থেকে বই নিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়ুক, জানুক, শিখুক আমাদের দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা-পরাধীনতা, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর চিরায়ত বাঙালি সভ্যতা সম্পর্কে। পরীক্ষায় প্রশ্ন হোক সেসব বিষয় থেকেও। তবেই না এরা মানবিক গুণসম্পন্ন শিক্ষিত সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। আসুন আমরা সবাই এক হই। প্রতিটি শিশুকে তার স্বপ্নিল সমৃদ্ধ শৈশবের আনন্দমুখরতায় বড় হতে দিই। এ দায় আমাদের, দায়িত্বও আমাদের।

লেখক : বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক
[email protected] 

বহুমাত্রিক.কম

Walton Refrigerator Freezer
Walton Refrigerator Freezer